১৯৮৯। দক্ষিণ চট্টগ্রামে নারী শিক্ষার বিস্তার ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন কাজ করে চলা একদল স্বপ্নপথিক সহসা আনন্দে মেতেছিলেন। কারণ তারা একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। সেই স্বপ্নবাজ লোকেদের ভীড়ে আমার বাবাও ছিল। মজার বিষয় হল, আমার জন্মও সে বছর। দীর্ঘদিনের একটি স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার ক্ষণে পুত্রের জন্ম। ইংরেজি সাহিত্য পড়ুয়া পিতা শখ করে পুত্রের নাম দিয়েছিলেন - "ফরচুন"। কয়েক বছর আছে, আমার বাবাকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখর শিরোনাম দিয়েছিলাম- " আমার বাবা: একজন ‘অভিজাত ভিক্ষুকে’র দূরদর্শিতা "! স্মৃতিচারণমূলক লেখায় আমি লিখেছিলাম, " ... কলেজের প্রতি বাবার একাগ্রতা ও একনিষ্টতা আমি কাছে থেকে অনুভব করেছি। আমার মা রেগে গেলে এই কলেজকে নিজের সতীনের সাথে তুলনা করে মনের ঝাল মেটাতেন। আমরা ভাই-বোনেরাও এই অতি একাগ্রতা নিয়ে অনেকবার বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু বাবার মন-প্রাণ আর অস্তিত্বজুড়েই ছিল কলেজটি। এমনকি আমার জন্মের বছরই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন বলেই আমার নাম রেখেছিলেন 'ফরচুন' (যার বাঙলা অর্থ ‘ভাগ্য’ )... ... সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজের জন্য অর্থ সহযোগিতা ছাড়াও অনান্য উন্নয়নের জন্য তিনি মানুষের দুয়ারে গিয়েছেন। যেসব কাজে বাবা মাথা না ঘামালেও পারতেন, সেসব কাজও স্বপ্রণোদিত হয়ে করেছেন। কলেজের কাজে তাঁর রাত -দিন কোন তফাৎ ছিল না, প্রিন্সিপাল-কেরাণীর কাজের বিভাজন ছিল না, শুক্রবারেও ছুটি ছিল না। এতসব অভিযোগ মনে আসা মাত্রই নিজে বিব্রত হতাম আর একদিন পেয়ে গেলাম চমৎকার সেই প্রত্যয়- ‘অভিজাত ভিক্ষুক’।" আজ শেহজাদ ভাইয়ের মারফতে জানলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক চুনতি মহিলা ডিগ্রী কলেজকে সরকারি কলেজ হিসাবে ঘোষণা করার আনন্দঘন সেই ঐতিহাসিক পত্র ইতোমধ্যেই তাদের (কলেজ কমিঠি) হস্তগত হয়েছে। খুবই আনন্দ লাগছে। সেই ১৯৮৯ থেকে ২০১৫। দীর্ঘসময়জুড়ে বড় হয়েছি আমরা। আমি আর আমার সমান্তরালে একটি প্রতিষ্ঠান। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ সেই ব্যক্তিটি (বাবা) অবসরে গেছেন বহু আগে। সেদিনের ছোট্ট শিশুটিও অনেক বড় হয়ে গেছে। এখন সে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। দেশজুড়ে চলমান নারী নির্যাতন- নিপীড়ন ও ধষর্ণের বিরোদ্ধে অন্দোলনে আমরা সোচ্চার।সমাজের অবক্ষয় দেখতে দেখতে আমরা আর বিস্মিত হই না; হই ক্ষুব্দ। এত অপ্রাপ্তি ও হতাশার মধ্যেও আমরা আশার আলো দেখি। সত্যি, পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। বেঁচে থাকার রসদ এখনো ফরিয়ে যায় নি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদের অনেককিছু দিয়ে গেছেন। সেই প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ, তার বেড়ে উঠা সন্তান কেউ থাকবে না, কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি বেঁচে থাকুক। আলো জ্বালাক অন্ধকারাচ্ছন্ন মনের গভীরে- এই প্রত্যাশা।