কামিল ( স্নাতেকাত্তর) ১ম ও ২য় পর্ব পরীক্ষা ২০২৩ এর কেন্দ্র পর্যবেক্ষকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলাম মীরসরাই লতিফীয়া কামিল মাদরাসায়। মীরসরাই নামটার সাথেই এক অন্যরকম আবেগ জড়িয়ে আছে। কারণ এখানেই আমাদের সকলের শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদ উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আব্দুল হাই নিজামী ( আওয়াল ছাহেব হুজুর) হাফিজাহুল্লাহ এর বাড়ি। পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে হুজুরকে এক  নজর দেখার জন্য রওয়ানা দিলাম উনার বাড়ির উদ্দেশ্যে। পথে যেতে যেতে স্মৃতিকাতর হলাম। চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদরাসায় অধ্যয়নকালীন সময় হুজুর মাদরাসার প্রধান গেইটের পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে কিতাব পড়তেন। হুজুরকে দেখলে উনার সামনে দিয়ে হেটে আসতে পা কাঁপত। একদিন হুজুরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ডাক দিলেন এমুই আয়, যাওয়ার পর আমার নাম বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন। আব্বার কথা শুনার পর বললেন কাল থেকে এখানে পড়তে আসবি। হুজুরের ছোট ছেলে শ্রদ্ধেয় বড় ভাই গোলামুর রহমান আজহারী ভাইকে নির্দেশ দিলেন আমাকে পড়াতে। এভাবেই প্রথম হুজুরের ছুহবতে আসলাম। ২০১৫ সালে UCBL Bank এ চাকরী হলে হুজুরের কাছে পরামর্শ চাইতে গেলে হুজুর খুব কৌশলে আমাকে বলেছিলেন তুমি কি আমার মুখ দিয়ে সুদ হালাল এটা বের করতে চাচ্ছ? আমি তখন হুজুরের কথা বুঝে গিয়েছিলাম। আওয়াল ছাহেব হুজুরের ব্যক্তিত্ব, ছাত্রদের প্রতি দরদী মনোভাব এগুলোর বর্ননা এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে করা সম্ভব নয়। হুজুর নিজের জায়গা জমি সবকিছু উৎসর্গ করে দিয়ে নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ছাত্রদের পড়াতেন। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তৈরী করেছেন হাজার হাজার যোগ্য আলেম। যারা আজ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ইলমে নববীর খেদমত আন্জাম দিচ্ছেন। হুজুরের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে দেশ বিদেশের হাজার হাজার দূর্লভ কিতাব, যা তিনি আপন সন্তানের চেয়েও বেশী মমতায় বাঁধাই করে রেখেছেন। আজকে হুজুরের সাথে সাক্ষাত হৃদয়টা শীতল করে দিয়েছে। অনেক বছর ধরে পরিকল্পনা করেও যাওয়া হয়নি। আজ আশাটা পূর্ণতা পেল। হুজুরের বাড়িতে পৌছে অনুমতি নিয়ে ভিতরে ডুকলাম। হুজুর আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করলেন আমার আব্বার পরিচয় দেওয়ার পর হুজুর কতক্ষণ চুপ করে থেকে স্মৃতিচারণ করলেন বাবার। তখন নিজের অশ্রুকে আর সংবরণ করতে পারিনি। হুজুর বললেন আপনার বাবার অনেকগুলো ভাল গুন ছিল। একটা গুণের কথা এখনো মনে পড়ে প্রতি বছর শীতকাল আসলে চুনতি মাদরাসার হুজুরদের শীত পিঠা খাওয়াতেন। কোন বছর এর ব্যত্যয় ঘটেনি। পরে আমার মরহুম বড় ভাই আব্দুল হাকিমের কথা মনে করে হুজুর নিজেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। বারবার বলছিলেন আমার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল আব্দুল হাকিম। হুজুরের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় আমি বিনয়ের সাথে দোয়া করতে বললে হুজুর বললেন আমিও দোয়া চাই। হুজুর কত মেহমানদারি করলেন নিজে। আর বারবার বলছিলেন কোন খেদমত করতে পারলামনা। হুজুরের রুমের চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য কিতাব। এখনো দিন কাটে শুধু কিতাব অধ্যয়নে। আল্লাহ এরকম সোনার মানুষ দিয়ে ইলমের যে খেদমত আন্জাম দিয়েছেন তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না। হুজুর বয়সের কারণে বাইরে চলাফেরা করতে পারেন না। তারপরও কিতাব সংগ্রহের নেশা নাকি এখনো ঠিক আগের মতই। আল আজহার পড়ুয়া হুজুরের এক ভাইপোকে নাকি কয়েকদিন আগেও নতুন কিতাব পাঠানোর তালিকা পাঠিয়েছেন। সত্যিকারের হাক্কানী আলেম চিনতে হলে হুজুরের কাজগুলো ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই যথেষ্ট। এই আলোকিত মানুষটা কোন ধরনের যশ, খ্যাতির পিছনে ছুটেননি। সব সময় লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে ইলমে নববীর এক বিশাল খেদমত আন্জাম দিয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহ পাকের কাছে কায়মনোবাক্যে ফরিয়াদ জানাই আল্লাহ যেন হুজুরকে সুস্থতার সাথে হায়াতে তাইয়্যেবা দান করেন। ইলমের যে বাগান হুজুর সাজিয়েছেন তা যেন কিয়ামত পর্যন্ত জারী রাখেন আর তার সুঘ্রাণ সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেন। আমিন।