ড. শফিক আহমদ খান (মানিক মিয়া) এর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল আমার ১৯৮৮ সন থেকে। তিনি তখন সিলেটে বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৮ সনে কোন এক সময় সিলেটে পেট্রোবাংলার কোম্পানি 'জালালাবাদ গ্যাস' এ আমার চাকরির জন্য পরীক্ষা দিতে যাওয়া। অতঃপর ১৯৮৯ সনের ফেব্রুয়ারিতে সিলেটে আমার সরকারি চাকরিতে যোগদান। যে কয়টি বছর উনাকে সিলেটে পেয়েছি উনাকে খুব কাছ থেকে দেখার ও জানার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। আত্মীয়তার সূত্রে সম্পর্কে আমার নানা হলেও ১৯৮৮ সনের আগ পর্যন্ত উনার সংস্পর্শে যাওয়ার তেমন সুযোগ ছিল না। ঐ বয়সে সেরকম তাগিদও অনুভব করিনি। যখন চুনতি আসতেন দূর থেকে দেখতাম। আমার সিলেটে চাকরি করার সুবাদে উনার সাথে এত বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলাম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তিনি স্নেহ ও ভালোবাসা দিয়ে যেভাবে কাছে টেনে নিয়েছিলেন পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রামে বদলী হয়ে আসলেও কখনো আমাকে ভুলে যাননি। আমি যখন ছুটিতে চট্টগ্রাম আসতাম উনার সাথে দেখা সাক্ষাৎ না করে উপায় ছিল না। উনার স্নেহময় নির্দেশ - যখনই চট্টগ্রাম আসি অবশ্যই যেন দেখা করি। উনার মৃত্যু বার্ষিকীতে স্মৃতি চারণ করতে গেলে এখানে স্বল্প পরিসরে তা লিখে শেষ করা যাবে না। তবে দু'একটা কথা লিখার আগ্রহ বোধ করছি। ড. শফিক আহমদ খান এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যার তুলনা হয় না। দীর্ঘ সুঠামদেহী সুদর্শন চেহারার অধিকারী এই মানুষটি ছিলেন বহু গুণে গুণান্বিত একজন আদর্শ মানুষ। সদালাপী ও বিনয়ী ছিলেন। উচ্চ শিক্ষিত এবং অত্যন্ত মেধাবী সম্পন্ন একজন সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ঐ সময়ে তিনিই ছিলেন বন বিভাগে সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী কর্মকর্তা। স্মার্টনেস বলতে যা বুঝায় তিনি ছিলেন খুব উঁচু মাপের একজন স্মার্ট মানুষ। কথাবার্তায়, পোশাক পরিচ্ছদে, চালচলনে উনার স্মার্টনেস ফুটে উঠতো। উনার কন্ঠস্বর বাচনভঙ্গি আচার-আচরণ এমন ছিল, যে কেউ সহজে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়তো। প্রায়শ দেখতাম সন্ধ্যার পর সিলেটের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উনার সরকারি বাংলোতে আসতেন। উনার সাহচর্য পাওয়ার জন্য, উনার সাথে অবসরে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য তাঁরা আসতেন। জেলা প্রশাসক, সরকারি বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের উচ্চ পদস্হ কর্মকর্তা, উচ্চ পদস্হ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তা, গভঃ কলেজের প্রিন্সিপাল এরকম অনেকের যাতায়াত ছিল। মাঝেমধ্যে বাসায় আসর বসতো। তিনি কৌতুকপ্রিয় রসবোধ সম্পন্ন মানুষ ছিলেন। আসর মাতিয়ে রাখতেন। কখনো বা গান শুনিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করতেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত বেশি পছন্দ করতেন তিনি।
একদিন আমাদের কোম্পানিতে অফিসের কাজে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাগজ দরকার হয়ে পড়েছিল যা সাধারণত বাইরে সরবরাহ করা হয় না। আমার দুই জন ইঞ্জিনিয়ার বস উনার অফিসে গিয়েছিলেন। ডিএফও অনুমতি না দেয়ায় তাঁরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। পরে আমার উর্ধ্বতন বস আমাকে পাঠান। আমি নানার সামনে বসা। এসিএফ কে তলব করেন। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন,"আমাদের জন্য দু'কাপ চা পাঠিয়ে দেন। জালালাবাদ গ্যাস থেকে যে কাগজটা চাওয়া হয়েছে তা উনাকে দিয়ে দেন"। উল্লেখ্য, উনার বাসায় অতিথিদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় তিনি আমার অফিসিয়াল পরিচয় ও আত্মীয়ের পরিচয় দু'টাই প্রকাশ করতেন। কিন্তু আজ উনার অফিসে শুধু আমার অফিসিয়াল পরিচয়টাই তুলে ধরলেন। এবং এসিএফ এর সামনে আমাকে সম্মানিত করলেন। তিনি কি রকম প্রজ্ঞাবান এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি সেটা বুঝা গেল। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি বাইরের মানুষের কাছে তিনি আত্মীয় স্বজনদের হাইলাইট করেন, উর্ধ্বে তুলে ধরেন। এটা উনার চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল।
একবার রোজার ঈদে চুনতিতে ঈদ করে ২য় কি ৩য় দিন শহরে ফিরছি। সিলেট থেকে ঈদের ছুটিতে চট্টগ্রাম এসেছিলাম। শাহ সাহেব গেইটে বাসে উঠার জন্য দাঁড়িয়েছি। একটা গাড়ি চুনতি ঢুকছে। কিছুদূর গিয়ে গাড়ি পেছনে ব্যাক করলো। দেখি মানিক নানা, সাথে উনার পরিবার। আমাকে দেখে গাড়ি ব্যাক করিয়েছিলেন। ঈদ মোবারক করলেন। বললেন, কালকে যেন অবশ্যই শহরে উনার বাংলোতে আসি। এবং দুপুরে আমাকে সেখানে খেতে হবে। যথাসময়ে সেখানে পৌঁছে যাই। একসাথে সবাই খাওয়ার টেবিলে বসেছি। বিশাল আয়োজন। ঈদের সময় সাধারণত যা হয়ে থাকে। তিনি চেয়ার থেকে উঠে এসে আমাকে পরিবেশন করা শুরু করে দিলেন। অত্যন্ত স্নেহভরে পেছন থেকে আমার দুই বাহুতে হাত রেখে নানিকে বলছেন, আমার আলমগীর ভাইকে প্লেটে আরও কিছু দাও। খাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম, এত আদর স্নেহ ভালোবাসা পাওয়ার কতটুকু যোগ্যতাই বা আমি রাখি।মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে সিলেট থেকে এসে উনাকে শেষবারের মত হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে দেখতে যাই। উনাকে অক্সিজেন দেয়া হচ্ছিল। আমাকে দেখে কাছে ডাকেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমার হাত উনার হাতের মধ্যে রেখে বলেন,"তুমি যতদিন সিলেটে আছ আমার রনীকে 'পেরেন্টস ডে' তে দেখতে যেও। তুমি ওখানে ওর লোকাল গার্ডিয়ান"। তখন আমার দুই চোখে অশ্রু টলমল করছিল। সে সময় ওখানে জুনু নানা (আমিন আহমদ খান) পাশে বসা ছিলেন। বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। সহকর্মীদের সুখে দূঃখে পাশে থাকতেন। সবার খোঁজ খবর নিতেন। বিপদে সাহায্য করতেন। সিলেট থেকে বিদায় নেয়ার দিন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। সেদিন সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা কর্মচারীগণ সবাই ছুটে এসেছিলেন। অশ্রু সজল চোখে ডিপার্টমেন্টের লোকজন উনাকে বিদায় জানিয়েছিলেন। যে দৃশ্য দেখেছি, সচরাচর কোন সরকারি কর্মকর্তার বিদায়ে এটা ঘটে না। গাড়িতে উঠার সময় দারোয়ান পিয়ন মালী থেকে শুরু করে সহকর্মীগণ একে একে উনার হাত চেপে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। ভীড়ের মধ্যে কান্নার রোল উঠে। গাড়ি সামনে এগুতে পারছিলো না। ভালোবাসার প্রতিদান যথার্থই পেয়েছিলেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে যেখানেই গিয়েছেন ভালোবাসা দিয়ে এমনিভাবেই জয় করেছেন কর্মকর্তা- কর্মচারী সহকর্মীদের মন। আত্মীয় স্বজন এবং নিজ গ্রাম চুনতি ও চুনতির মানুষদের প্রতি ছিল উনার গভীর মমত্ববোধ। দানশীল এবং ধর্মভীরু ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। ভোরে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। জীবনের শেষের দিকে তাহাজ্জুদ নামাজও বাদ দিতেন না। তিনি সন্তানদের নিজের মত করে গড়ে তুলেছেন। পিতার আদর্শে বেড়ে উঠা সন্তানগণ একাডেমিক ও প্রফেশনাল ক্যারিয়ারে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। আমার জীবনে নানা পেশাজীবী শীর্ষ স্হানীয় ব্যক্তি, বহু উচ্চ পদস্হ সরকারি কর্মকর্তা দেখেছি। অনেকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু আমার দেখা সেরা ব্যক্তিত্ব ড. শফিক আহমদ খান। তিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ এবং তিনিই আমার জীবনে আমার আইডল। উনার মধ্যে ঐতিহ্যবাহী ডেপুটি পরিবারের স্বনামধন্য পিতা কবির উদ্দীন আহমদ খান ডেপুটির প্রতিচ্ছবি খোঁজে পাওয়া যায়। সেই ধারাবাহিকতায় স্বনামধন্য পুত্র ড. নিয়াজ আহমদ খান (রানা) এর মধ্যে ড. শফিক আহমদ খানকে দেখতে পাই।
Make sure you enter the(*)required information