আমেরিকাতে দাস প্রথা কবে শুরু হয়েছে সে আলোচনা এত গভীরে যে, সেদিকে না গিয়ে বরং আলোচনা শুরু করা যেতে পারে যখন থেকে দাস প্রথা আইন করে বিলোপ করা হলো। সালটা ১৮৬৫। এর মধ্য দিয়ে সে সময় ৩ মিলিয়ন মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিল। একটু গভীরভাবে ভাবলে, রাষ্ট্র চাইলে কাউকে দাস বানিয়ে রাখতে পারে, আবার চাইলেই সেই শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে পারে। আজকের দিন পর্যন্তও আসলে রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, সংবিধান যারা লিখেন, সংশোধন করেন, পরিবর্তন করেন, সংযোজন করেন, তাদের হাতে অনেক ক্ষমতা। সে সময় আমেরিকাতে যারা এই ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করত তারা দীর্ঘকাল ধরে কালোদের দাস বানিয়ে রেখেছিল। সেই দাসত্ব ভাঙার জন্য শত শত বছর ধরে আন্দোলন চলতে থাকলে একসময় তারা উপলব্ধি করল, এই অধ্যায়ের ইতি টানা দরকার। তখন সংবিধানের ১৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে দাস প্রথা আইনত বন্ধ হলো। কিন্তু এখন প্রশ্ন আসতে পারে, সম্প্রতি আমরা আফ্রিকান-আমেরকিান কমিউনিটির যে আন্দোলন দেখছি সেটা তাহলে কী? কেন এই আন্দোলন?
এই প্রশ্নের উত্তর অনেক গভীরে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ স্লোগানের ভেতরেই অনেক কথা বলা আছে। প্রথমত, ১৮৬৫ সাল থেকে ২০২০, আসলে কালোদের জীবনের যথেষ্ট গুরুত্ব ও মানবিক মর্যাদা আমেরিকান সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যে কারণে এই স্লোগানটাকে আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারছি না । এত বছরেও কি তাহলে কোনো পরিবর্তন আসেনি? মোটা দাগে বলতে গেলে কিছু পরিবর্তন তো এসেছেই। ১৯৫০ এবং ১৯৬০, এই দুই দশক জুড়ে আমেরিকাতে অনেক পরিবর্তন এসেছে ক্রমাগত আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে। তবে গুণগত পরিবর্তন যে আসেনি, তা দুয়েকটা ঘটনা ধরে ধরে ইতিহাসের সুতাকে সামনে আর পেছনে টানলেই খুব স্পষ্ট বোঝা যায়।
প্রথমত, ১৯৬৪ সালের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট অ্যাক্টের কথাই ধরুন। এই আইনের মাধ্যমে স্কুল-কলেজ, বাস-ট্রেন যেকোনো পাবলিক প্লেসে সাদা-কালো ভিত্তিতে বৈষম্য আইনত বন্ধ করা হয়। এখন তাহলে আরও একটু পেছনে যেতে হবে। আফ্রিকান-আমেরিকান সাহসী নারী রোজা পার্ক পাবলিক বাসে শ্বেতাঙ্গ পুরুষের কাছে সিট ছেড়ে দিতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল ১৯৫৫ সালে। গ্রেফতারের প্রতিবাদে তখন আমেরিকার শহর থেকে শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫৬ সালে এসে ফেডারেল কোর্ট রায় দিতে বাধ্য হলেন যে, পাবলিক প্লেসে বর্ণভেদে বৈষম্য করা চলবে না।
সুপ্রিম কোর্টও সেই রায়ে সম্মতি দেন। আপনি কি ভাবতে পারেন, আজ থেকে মাত্র ৫০-৬০ বছর আগেও এমন ঘটনা আমেরিকার সমাজে খুব সহজাত ছিল? কিন্তু এখন আপনি দেখুন, আমেরকিার ছোট-বড় শহরগুলোতে পাবলিক বাসে অধিকাংশ যাত্রী কারা? কালোরাই। সাদারা নিজেদের গাড়িতে চড়ে। গবেষণা বলছে ১৯ শতাংশ আফ্রিকান-আমেরিকানদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। এর বিপরীতে গাড়ি ছাড়া সাদাদের লোকদের সংখ্যা মাত্র ৪.৬% (মেকলে, ২০০৬)। অর্থাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই জনগোষ্ঠী যতখানি এগিয়ে যাচ্ছে, সেটা আসলে সামগ্রিকতার বিচারে খুব সন্তোষজনক নয়।
তারপর ধরুন, ১৯৬৫ সালে শিকাগো ফ্রিডম মুভমেন্ট হলো। এই আন্দোলনের মূল ছিল বাসস্থান, শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বর্ণভেদে বৈষম্য নিরসন করা। সে সময় সাদারা কালোদেরকে বাসাবাড়ি মর্গেজ দিচ্ছিল না। আলাদা পল্লীতে তারা মানবেতর জীবনযাপন করত। এই আন্দোলন ১৯৬৭ সাল অবধি চলল এবং পরবর্তীতে ১৯৬৯-এ এসে ‘ফেয়ার হাউজিং অ্যাক্ট’ পাস হলো। তার মানে, বাসের সিট বলুন, বা বাসাবাড়ির মর্গেজ বলুন, সবকিছুর জন্যই আসলে তাদেরকে রাস্তায় নামতে হয়েছে। গুলি খেতে হয়েছে। রক্ত দিতে হয়েছে। আবার বর্তমান সময়ে আসেন। ২০১৮ সালের গবেষণা বলছে, শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, লাতিনো, এশিয়ান এরকম যত রেসিয়াল জনগোষ্ঠী আমেরিকাতে আছে, তার মধ্যে বাসস্থানহীন (হোমলেস) হিসেবে শীর্ষ আছে আফ্রিকান-আমেরিকান/কালোরা। খোদ নিউইয়র্ক রাজ্যে প্রতি ১০ হাজার কালো মানুষের মধ্যে ২০৮ জন বাসস্থানহীন (মোজেস, ২০১৮)। ফলে এটা বলা যায়, যদিও সমাজে অনেক পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু কালোরা কার্যত এখনও পিছিয়েই রয়ে গেছে।
তারপর ধরুন শিক্ষাব্যবস্থার কথা। ১৯৫৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছেন বর্ণভেদে পৃথক (সেগরিগেটেট) স্কুল বেআইনি। অথচ ১৯৫৭ সালে আরকানসাসের লিটল রক সেন্ট্রাল হাই স্কুলে কালো ছাত্রদেরকে প্রবেশ করতে দিল না। যথারীতি আবার প্রতিবাদ, আবার সংগ্রাম। তারপর একসময় আমেরিকান স্কুলগুলোতে কালোদের প্রবেশাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু প্রবেশাধিকার পেলেও ‘স্কুল টু প্রিজন পাইপলাইন’ বন্ধ হলো না। ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনের নামে বছরের পর বছর যে বৈষম্য ঘটেছে, গবেষণায় তার ফলাফল এলো, ‘স্কুল টু প্রিজন পাইপলাইন’-এর কারণে আফ্রিকান-আমেরিকান ছাত্রদের ঝরে পড়ার হার সাদাদের তুলনায় ৩ গুণ (আমেরিকান ইনস্টিটিউট ফর রিসার্চ, ২০১২)। তারপর ধরুন, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি বা হায়ার স্টাডিজ একাডেমিয়া। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, শিক্ষক, কর্মচারী, গবেষকসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সামগ্রিকভাবে সব পদের ৭৩.২% দখল করে আছে শ্বেতাঙ্গ কর্মচারীরা (এএসিইউ, ২০১৯)। কল্পনা করা যায়? তারপরও আপনি বলবেন, এ সমাজে হোয়াইট প্রিভিলেজ বা রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশন নেই? এত সংগ্রাম, রক্ত, সময়ের বিবর্তনে তাহলে পরিবর্তনটা কোথায়?
তারপর ধরুন, আফ্রিকান-আমেরিকানরা দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রাম করেছে, ‘জিম ক্র ল’ নিয়ে। একটা সময় তো সাদা আর কালো ইন্টাররেসিয়াল বিবাহ অসম্ভব ছিল। আলাবামাতে হাসপাতালে আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষ রোগীকে শে^তাঙ্গ নার্সরা (সেবক-সেবিকা) সেবা দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারত। এরকম শত শত ঘটনা আছে। এই বিভাজন, বৈষম্যগুলো ভাঙতে অনেক সময় লেগেছে। অথচ দেখুন, আজকে এত বছর পর এসেও ২০১৯ সালে সারা বিশ্ব দেখল মিসিসিপি রাজ্যের একটি বিবাহ হলে শ্বেতাঙ্গ কনে আর কৃষ্ণাঙ্গ বরের বিবাহ আয়োজনে অস্বীকৃতি জানাল কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে তারা ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে, কিন্তু ২০১৯ সালে এসেও যদি এসব ঘটনা আমাদেরকে প্রত্যক্ষ করতে হয়, তবে দুঃখজনক। তার মানে, পরিবর্তন আসলে কতটা এসেছে?
এরকম বলতে গেল ফিরিস্তির শেষ নেই। সর্বশেষ পুলিশ নির্যাতনের ঘটনায় মানুষ ফুঁসে উঠেছে। শুধু ২০১৯ সালেই ১০৯৮ জন পুলিশের গুলিতে মারা যায়। পরিসংখ্যান বলছে, পুলিশের গুলিতে কালোদের মৃত্যুর হার সাদাদের তুলনায় ৩ গুণ। অথচ, আগ্নেয়াস্ত্র বহন করার দিক থেকে কালোরা সাদাদের তুলনায় ১.৩% পিছিয়ে আছে। তারপরও কেন তাদের মৃত্যুহার বেশি? কারণ, ১০১৩-১৯ সালের হিসাব মতে, এসব হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত অফিসারদের ৯৯%-কে কার্যত কোনো সাজা ভোগ করতে হয়নি। এরপরও কি আপনি বলবেন যে, ‘ব্ল্যাক লাইভস মেটার’ অমূলক?
এই যে, আমি ইতিহাসের সুতার অগ্র আর পশ্চাৎ ধরে ধরে পরিসংখ্যান আর গবেষণা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এখানে শুধু সাদা আর কালোদের প্রসঙ্গ এনেছি, কেবল আলোচনার সুবিধার্থে। আমেরিকা আসলে নানা বর্ণ, নানা জাতির দেশ। সবাইকে একসঙ্গে ব্যাখ্যা করতে গেলে আলোচনা জটিল হবে। তারপরও সেটা আমাদের করতে হবে এবং আমরা করব। অন্য একদিন। আপাতত এটুকু থাক। সবশেষে জর্জ ফ্লয়েডের আত্মার শান্তি কামনা করি। তার মৃত্যু আর এ চলমান আন্দোলন থেকে যেন আমেরিকা আরও বেশি মানবিক, মহান ও উদার হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করে, সে আশা রাখতেই পারি। পরবর্তীতে আরও কথা বলা যাবে।
লেখক পরিচিতি :ফরচুন শামীমশিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়পিএইচডি গবেষক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
Make sure you enter the(*)required information