রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছি ... ... ... এ কারণে যে, শুধুমাত্র পড়া, শুনা (রবীন্দ্রসঙ্গীত), বা জানা, রবীন্দ্রনাথ-কে আবিষ্কার করার জন্য যথার্থ নয়। এক্ষেত্রে কেবলমাত্র “হৃদয়ঙ্গম”-শব্দটিই যথার্থ বলে বোধ করি।বাংলা গানে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের প্রতিতুলনা বিষয়ক লেখাটি ছিল আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিব্যক্তি, যেখানে আমি একটিবারের জন্যও রবীন্দ্রনাথকে ছোট করতে চাইনি বরং দু’জন মহান জ্ঞানতাপসের দু’টি স্বতন্ত্রধারার স্বাতন্ত্রতা বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। এ বিষযে যাতে ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ না থাকে, তাই বিষয়টি আবার পরিষ্কার করার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করেছি।রবীন্দ্রনাথ এমনই একমাত্র জ্ঞানতাপস যিনি সাহিত্যের প্রতিটি ধারায় বীরদর্পে বিচরণ করেছেন। আমি মনে করি, “কবি গুরু” বললে তাঁর অনেকগুলো চরিত্র অন্তরালে থেকে যায়। একাধারে দার্শনিক, কবি, সঙ্গীতবোদ্ধা, চিত্রশিল্পী... ... ... আরো অসংখ্য পরিচয়ে কেবলমাত্র একজন রবীন্দ্রনাথকেই খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আজ আমি রবীন্দ্রনাথের সমাজ চিন্তা সম্পর্কে খানিকটা আলোকপাত করব, আশা করি এই দৃষ্টতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।সদ্যজাত মানবশিশু থেকে শুরু করে সমাজে মানুষের অবস্থান, চিন্তাধারা, ধর্ম, শিক্ষা প্রতিটি বিষয়েই রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক কথামালা থেকে আমি কিছুমাত্র অংশ বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি।... ... ...“শৈশবে যদি মানুষের উপসংহার হইত, তহা হইলে মানুষের মত অপরিস্ফুটতা সমস্ত প্রাণীসংসারে কোথাও পাওয়া যাইত না... আমাদের বিলম্ববিকাশ, আমাদের ত্রুটি, আমাদের পাপ আমাদের সম্মুখবর্তী সদূর ভবিষ্যতের সূচনা করিতেছে।”-আচারের অত্যাচার, বরীন্দ্র প্রবন্ধ।প্রকৃতির এই নিয়মটিকে রবীন্দ্রনাথ একজন সমাজবিজ্ঞানীর মতই যর্থাথ অনুভব করেছেন। সেইসাথে তাঁর দ্বিতীয় লাউনটিতে আরেকজন কালজয়ী দার্শনিক ও সমাজচিন্তাবিদ র্কাল মার্কসের সেই বিখ্যাত [দ্বন্ধের তৃতীয় সূত্র (দ্বন্ধ ছাড়া বিকাশ সম্ভব নয়)] সামাজিক বিকাশের চিন্তাধারার ও মিল পাওয়া যায়।ডানপন্থি, বামপন্থি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এমন সব তন্ত্র, মন্ত্র ও যন্ত্রের যাতাকলে আর পিষ্ট হতে চাই না, আমি বুঝি শুধু মানবমুক্তি। সম্ভবত: কবিগুরু ও আমার মত করে চিন্তা করেছিলেন। আর একারণে তৎকালিন সমাজের নানা অসংগতিকে আঙ্গুলি প্রদর্শন করেছেন, মুক্তির পথ দেখিয়েছেন।...“ আমাদের দেশে সমাজনীতি ক্রমে সুদৃঢ় হয়য়াছে কিন্তু ধর্মনীতি শিথিল হইয়া আসিয়াছে। একজন লোক গরু মারিলে সমাজের নিকট নির্যাতন সহ্য করিবে এবং তাহার প্রায়শ্চিত্ত স্বীকার করিবে, কিন্তু মানুষ খুন করিয়া সমাজের নিকট বিনা প্রায়শ্চিত্তে স্থান পাইয়াছে এমন দৃষ্টান্তের অভাব নাই...”-( অযোগ্য ভক্তি )আমরা এখন এমন একটা সময় অতিক্রম করছি যেখানে স্বাধীনভাবে/মুক্তমনে সাহিত্য সমালোচনার স্থানটুকুও ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। আমার এ লেখা পড়ে অনেক বন্ধু আমার গায়ে বামপন্থির সীল মেরে দেবেন। এতে আমি খুব বেশি বিচলিত নই। আমার পরিবার যতবারই আমাকে পাতিবাম বলে তিরস্কার করেছে, আমি প্রতিবারই তার উত্তর দিয়েছি এভাবে... “ যদি হয় বামে হৃদয় ... ... ... তবে বামে কেন এত সংশয়???”রবীন্দ্রনাথ বাম ছিলেন কি ডান ছিলেন তা আমি জানি না তবে তিনি ও আমার মত বাম-ডানের উর্ধ্বে মানবমুক্তি বুঝেছিলেন। (প্রসঙ্গত বলছি, রবীন্দ্রনাথকে হৃদয়ঙ্গম করতে চাইছি বলেই বারবার লিখছি... তিনি ও আমার মত... এ দৃষ্টতা আমার অধিকার।)আমরা অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে ব্রিটিশ সরকারের অনুগত বলে কটোর সমালোচনা করি। কিন্তু একথা বলা বাহুল্য যে, বঙ্কিমচন্দ্রের অসাধারণ প্রতিভা স্বত্ত্বেও বিশ্বসাহিত্যে বাংলাসাহিত্যের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। আর বাংলাভাষাকে ঘিরে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা চেতনা, ব্রিটিশ অনুগত ছিল- একথা আমি মানতে নারাজ।... “ শিক্ষাসমিতি-সভায় যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাতৃভাষা শিক্ষার প্রস্তাব উঠিতেছে, তখন স্বদেশের লোকই তো তাহাতে প্রধান আপত্তি করিতেছে...দীপশিখা কেবল আলো দেয় তাহা নহে, পলিতাটুকুও পোড়ায়, তেলটুকুও শেষ করে। ইংরেজি শিক্ষা কেবল যে মোটা মোটা চাকরি দেয় তাহা নহে, আমাদের লোকাচারের আবহমান সূত্রগুলোকেও পলে পলে দগ্ধ করিয়া ফেলে... ... ... ” -(সমুদ্রযাত্রা)যেকোন বিষয়কে দু’ভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের বহু গানে ইউরোপিয় সুর ( যেমন:ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কিবা মৃদুবায়...) এসে মিশেছে। একপক্ষ বিষয়টিকে নেতিবাচক ব্যাখ্যা করেন আবার অন্যপক্ষ ঘোষনা করেন, বিশ্বকবি দেশ-কাল-ভুখন্ডের উর্ধ্বে উঠে বিশ্বব্যাপি যাকিছু সন্দর নিতে পেরেছিলেন তারই কিঞ্চিৎ মিশেছে তাঁর সৃষ্টিকর্মে। আমি ও ব্যক্তিগতভাবে দ্বিতিয় মতামতটি বিশ্বাস করি।১২ বছরের শিশু ক্ষুদিরাম সামাজ্রবাদ বুঝত কিনা আমি সন্দিহান কিন্তু তার বিট্রিশবিরোধি মনোভাব ও আতœত্যাগকে আমি অস্বীকার করতে পারিনা, বরং সম্মান করি। তেমনিভাবে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইংরেজি ভাষার মানসিক অসন্তুষ্টির প্রতি কবি গুরুর উপরোক্ত উচ্চারণ আমাকে আরো একবার তাঁর সম্মানে শ্রদ্ধাবনত হতে শেখায়।মাতৃভুমিকে ভালবেসে, বাংলার মানুষ, প্রকৃতিকে ভালবেসে যিনি তাঁর অসংখ্য সৃষ্টিকর্মে বাংলার বন্দনা করেছেন, তাঁর প্রতি সাম্রাজ্যবাদপ্রীতির অভিযোগ অতিঅবিবেচকমাত্র সম্ভব বলে বোধ করি।শুধু তাই নয়, তিনি তৎকালিন ইংরেজ প্রভাবিত বাবু সমাজের প্রতি ব্যঙ্গাতœক মন্তব্য ও ছুড়ে দিয়েছেন নিঃসংকোচে।... “একে বিলাতি সাজ স্বভাবতই বাঙালিদেহে অসংগত, তাহার উপরে যদি তাহাতে ভদ্রোচিত পরিপাট্য না থাকে, তবে তাহাতে হাসিও আসে অবজ্ঞাও আনে...”-(কোট বা চাপকান)রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে সবচেয়ে বড় সমালোচনার বিষয় সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি। শ্রদ্ধেয় আহমদ ছফা’র এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে আকুতি ছিল। বেচে থাকলে অহমদ ছফা রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করতেন, কেন তিনি তাঁর অসংখ্য সৃষ্টিকর্মের কোথাও মুসলমান চরিত্র ( দরিদ্র ) বা অন্য ধর্মালম্বীদের জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু রেখে যাননি?প্রশ্নটি আমাকেও অনেক ভাবিয়েছে। আমার ক্ষুদ্র সাহিত্য-বিচরণ পরিসরে আমি যাকে অনন্যরূপে পেয়েছি, যার চিন্তার বিস্তৃত পরিসরে আমি প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু সন্ধান করে ফিরি তিনি হলেন ড. আহাদুজ্জামান মোহাম্মদ আলী। স্যারের কাছেও আমি আহমদ ছফার প্রশ্নটি তুলি, উত্তর সন্ধান করি কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারি না।আজ আমি অনেকটাই সন্তুষ্ট। আমার উত্তর আমি রবীন্দ্রনাথের মধ্যেই খুজেঁ পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথ একটিমাত্র লাইনে তাঁর সমালোচকদের মোকাবিলা করেছেন বহুবছর আগে।...“ যেমন বাক্ষ্মণের পইতা তেমনই বিলাতফেরতের বিলাতি কাপড়, দু’টোই সাম্প্রদায়িকতার লক্ষণরূপে স্বতন্ত্র করা কর্তব্য...” Ñ( কোট বা চাপকান)সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের এই অনন্য চিন্তার সাথে আমার পরিচয় দীর্ঘদিন নয়। এইদিক বিবেচনায় আশা করি সাম্প্রদায়িকতা বলামাত্রই আমার যেসকল বন্ধুরা ধর্মকে টেনে আনেন তাঁরা ও নতুনভাবে বিষয়টি নিয়ে ভাবার প্রয়াস পাবেন।ভারতীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে হিন্দু ও মুসলমানের সমান অবদানকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন উদারচিত্তে।... “ভারতবর্ষের যে একটি বাহ্যাবরণ ( সংস্কৃতি ও সাহিত্য) নির্মিত হইয়াছে, তাহাতে হিন্দু ও মুসলমান ভারতবর্ষের ডানহাত ও বাম হাত হইয়া টানা ও পোড়েন বুনিয়াছে...”... “ হিন্দু ও মুসলমান ধর্মে না-ও মিলিতে পারে , কিন্তু জনবন্ধনে মিলিবে...”শুধু বাঙালির সাংস্কৃতিক দারিদ্র্-ই তাঁর চোখে ধরা পড়েনি বরং পাশ্চাত্যের মনস্তাত্তিক দারিদ্রও তাঁেক খানিকটা বিচলিত করেছিল।বাঙালির উদ্দেশ্যে তৎকালিন সোমপ্রকাশ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ... “ বাঙালি ঘরে পরিয়া মরিবে তথাপি আহার অšে¦ষণ করিবে না... ”আর পাশ্চাত্যকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন,... ... ... “ মানুষের ক্ষমতার চূড়ান্ত সীমা পাবার জন্য সকলে মিলে অশান্তভাবে ধাবিত হচ্ছে... এরা রাজার জাত বটে। আমাদের পক্ষে যা যথেষ্টের চেয়ে ঢের বেশি এদের কাছে তা অকিঞ্চিৎ দারিদ্র... ”। -( প্রাচ্য ও প্রাতিচ্য)নারীর উদ্ভাবনী ক্ষমতার স্বকৃতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও ভলতেয়ার উভয়ের সমালোচনা ইতোমধ্যেই আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা।প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ ইউরোপিয় নারীদের সমঅধিকার আন্দোলনকে হয়ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করেছেন।... ... “স্ত্রীলোক সমাজের কেন্দ্রানুগ শক্তি; সভ্যতার কেন্দ্রাতিগ শক্তি সমাজকে বহির্মুখে যে পরিমাণ বিক্ষিপ্ত করে দিচ্ছে, কেন্দ্রানুগ শক্তি অন্তরের দিকে সে পরিমাণে আকর্ষণ করে আনতে পারছে না...... য়ুরোপে স্ত্রীলোক পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকারপ্রাপ্তির যে চেষ্টা করছে সমাজের এই সামঞ্জস্যনাশই তার কারণ বলে বোধ হয়...”-(প্রাচ্য ও প্রাতিচ্য)বঙ্গললনার পরিবার কেন্দ্রিক মানসিকতাকে প্রাতিচ্যের সাহেবরা অবজ্ঞা করলেও রবীন্দ্রনাথ এসব ললনাদের মধ্যে মানসিক প্রশান্তি ও ঐশ্বর্যের সন্ধান পেয়েছিলেন।সে যাই হোক। ক্ষুদ্র পরিসরে কয়েকটি বিষয়কে জানার এবং জানানোর জন্য আমার এতসব রসকষহীন কথামলা অনেকের কাছে বিরক্তিকর টেকতে পারে। বন্ধুমহলে আমার বিরোদ্ধে বড় অভিযোগ আমি রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে শুধু সমালোচনায় ব্রত। এমন মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করছি এবং এ অভিযোগ থেকে নিঃস্কৃতি চাই।যাকে এতখানি ভালবাসি তাঁর সামান্যতম ত্রুটিও আমাকে বিচলিত করে। উপরন্তু তাঁদের (রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল)-কে ঘিরে অন্যের সামান্যতম বিষোদগারও আমি সহ্য করতে পারি না। এ আমার স্বৈরাচারিক সাহিত্য প্রেম। এমন দৃষ্টতা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানিয়ে আমার কথামালার ইতি টানছি।
Make sure you enter the(*)required information