আজ ২৮ মার্চ ২০২২ বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও ইসলামিক গবেষক ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান এর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। বার্ধক্যজনিত কারণে ৯৫ (পঁচানব্বই) বছর বয়সে আজকের এই দিন সকালে তিনি নিজ বাসস্থানে ইন্তেকাল করেন। মরহুমের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে উনার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। পারিবারিক পরিচিতি----------------------------ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান ১৯২৬ সালে ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী চুনতি গ্রামের প্রখ্যাত ডেপুটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নাছির উদ্দীন ডেপুটির প্রপৌত্র। পিতা তাহের আহমদ খান এবং পিতামহ তৈয়ব উল্লাহ খান। ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান রচিত গ্রন্থ ''ছিদ্দিকী বংশের একটি পারিবারিক ইতিহাস'' অনুযায়ী তিনি এই বংশের ৪২তম পুরুষ। অর্থাৎ বংশ ধারাবাহিকতায় তিনি ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবুবকর ছিদ্দিক (রঃ) এর ৪২তম অধস্তন পুরুষ।শিক্ষা ও কর্মজীবন -------------------------ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামি স্টাডিজে বি.এ (সম্মান) পরীক্ষায় ১ম শ্রেণিতে ১ম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৫১ সালে একই বিষয়ে ১ম বিভাগে এম.এ পাস করেন। এরপর স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৫ সালে ইসলামের ইতিহাসে ২য় এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৯ - ১৯৬১ সালে আনুমানিক দুই বছর তিনি ঢাকায় সচিবালয়ে রিসার্চ অফিসার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক ইতিহাসে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বছর তিনি করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে সিনিয়র লেকচারার নিযুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে সেখান থেকে ইসলামাবাদ গমন করে ইসলামিক রিসার্চ ইন্সটিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক এর পদে যোগদান করেন। ১৯৬৬ সাল থেকে রাওয়ালপিন্ডি-ইসলামাবাদে ইসলামিক রিসার্চ ইন্সটিটিউটে রিডার হিসেবে গবেষণারত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে স্বদেশে ফিরে এসে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সহযোগী অধ্যাপকের পদে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সনে তিনি অধ্যাপকের পদে উন্নীত হন এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বিভাগীয় সভাপতি হন। ১৯৭৫ সালে ঢাকায় 'ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠার পর সরকার উনাকে প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল পদে নিয়োগ দেয়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি গ্রহণ করে ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এখানে তিনি ১ (এক) বছর ১(এক) মাস কাজ করেন। ফাউন্ডেশনের প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৯০ সালে তিনি চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অনারারি ডাইরেক্টর জেনারেল এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে এক্সটেনশনে বেশ কয়েক বছর অধ্যাপকের পদে বহাল থাকেন। তিনি 'আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম' প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৯৫ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার ও একাডেমিক কাউন্সিল মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০২ সালে চট্টগ্রামে 'সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এর প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
গবেষণা ও প্রকাশিত গ্রন্থ ---------------------------------তিনি আজীবন গবেষণার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি মূলত একজন ইসলামিক গবেষক। ইসলামি শিক্ষা, ইসলামের ইতিহাস, রাজনীতি বিজ্ঞান, ইসলাম ও পাশ্চাত্যের দর্শন-সভ্যতা, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সম্প্রদায়, পাক ভারত বাংলাদেশ ও আরবে উনবিংশ শতাব্দীর ইসলামি পুনরুজ্জীবন আন্দোলন, বাংলাদেশের ফরায়েজি আন্দোলন, তিতুমীরের সংগ্রাম, ভারতে ১৮৫৭ সালের আযাদী সংগ্রাম, পলাশী থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুসলিম রাজনীতি দর্শন, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান ইত্যাদি বিষয়ে উনার প্রচুর গবেষণাপত্র, নিবন্ধ ও গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থের সংখ্যা ২০ (বিশ)টির অধিক এবং গবেষণাপত্র ও নিবন্ধের সংখ্যা প্রায় ১০০ (একশো)। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ -- HISTORY OF THE FARAYZI MOVEMENT IN BENGAL, TITUMIR AND HIS FOLLOWERS IN BRITISH INDIAN RECORDS,A CHALLENGING ENCOUNTER WITH THE WEST: ORIGIN AND DEVELOPMENT OF EXPERIMENTAL SCIENCE, MUSLIM STRUGGLE FOR FREEDOM IN BENGAL, THE GREAT REVOLT OF EIGHTEEN FIFTY SEVEN AND THE MUSLIMS OF BENGAL, BRITISH INDIAN RECORDS RELATING TO THE WAHHABI TRIAL OF EIGHTEEN SIXTY ONE,MUSLIMS COMMUNITIES OF SOUTH EAST ASIA, POLITICAL CRISIS OF THE PRESENT AGE CAPITALISM, COMMUNISM AND WHAT NEXT
ইত্যাদি। উনার কিছু বই বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। আন্তর্জাতিক মহলে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। জন্মসূত্রে নিজ বংশের পরিচিতি মূলক বই 'ছিদ্দিকী বংশের একটি পারিবারিক ইতিহাস' রচনা করে স্হানীয় পর্যায়ে নিজ এলাকায় যথেষ্ট সমাদৃত হন। বইটির প্রকাশকাল ১৯৯৮ সাল। উনার সর্বশেষ প্রকাশিত বই 'ব্যবহারিক বিজ্ঞান, উৎপত্তি ও বিভাগ'। বইটি উনার ইন্তেকালের পরপর প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকাল এপ্রিল ২০২১।তিনি বিভিন্ন লেখকের কিছু বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তন্মধ্যে ইবনে খালদুন এর 'আল মুকাদ্দিমা' এবং ড. মুহাম্মদ হামীদুল্লাহ কর্তৃক সংগৃহিত ও ইংরেজিতে অনুবাদকৃত হাদিস এর সংকলন 'আল-ছহীফাহ', 'আল-ছহীহাহ' উল্লেখযোগ্য। মূল সংকলন প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা ছাহাবী হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক আরবিতে সংকলিত। বাংলায় অনুবাদকৃত বইটি ২০১৮ সালে প্রকাশিত।
চরিত্র বিশ্লেষণ -------------------
প্রফেসর ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান বহু মাত্রিক পরিচয় বহন করা একজন উঁচু মাপের মানুষ। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ, গবেষক, চিন্তাবিদ ও তাত্বিক। ইসলামের ইতিহাস, ইসলামি সংস্কৃতি, রাজনীতি বিজ্ঞান, ব্যবহারিক বিজ্ঞান, দর্শন সহ জ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় উনার ছিলো অবাধ পদচারণা। দেশে ও বিদেশে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সমাদৃত হয়েছেন, খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ একজন জ্ঞানতাপস। অত্যন্ত মেধাবী ও অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। মতাদর্শে, জীবনযাপনে উনার উপর সুফিতত্বের প্রভাব লক্ষণীয়। অত্যন্ত মার্জিত ও পরিশীলিত আচার-ব্যবহারে তিনি সকলকে আপন করে নিতে পারতেন। আতিথেয়তা ছিলো উনার একটি বিশেষ গুণ। ছাত্রদের প্রতি ছিলো গভীর মমত্ববোধ। অস্বচ্ছল ছাত্রদের আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা প্রদান করতেন। তিনি নির্ভীক, নিরহংকার ও ধর্মভীরু উন্নত চরিত্রের ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। শারীরিক কোন সমস্যা না থাকলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে জামাতে আদায় করতেন।
- হেলাল আলমগীর
Make sure you enter the(*)required information