সংক্ষিপ্ত জীবনী (১৯৪২ - ২০২২)

-------------------------------------------

এরশাদ উল্লাহ খান চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী চুনতি গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবার ডেপুটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রখ্যাত নাসিরুদ্দিন ডেপুটির বংশধর। তিনি নিজ গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনান্তে ১৯৫৫ সালে অত্র এলাকার প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসা চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখান থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯৬৫ সালে ফাজিল পাশ করেন। অতঃপর ১৯৬৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে অর্থনীতিতে বি.এ অনার্স পাশ করেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৭৩ সালে কৃতিত্বের সাথে এম.এ পাশ করেন।

তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে হেড অফিসে কর্মজীবন শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্যার উইলিয়ামস কলেজ থেকে অর্থনীতি বিষয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েশন সম্পন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট এর সর্বোচ্চ পদ থেকে জিএম হিসেবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সাথে কাজ করেছেন। বিশেষ করে আইএমএফ সংক্রান্ত ও ইসলামিক ব্যাংকিং সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বেশি কাজ করেছেন। রিসার্চ ডিপার্টমেন্টে এই দুই বিষয়ের উপর তিনি যথেষ্ট গবেষণা করেছেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, আইএমএফ ও ইসলামিক ব্যাংকিং এর উপর উনার কিছু রিসার্চ পেপার প্রকাশিত হয়েছে। ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষায় ছিল উনার অগাধ পাণ্ডিত্য। গবেষণা ছাড়াও তিনি কাব্যচর্চা করতেন।

চাকরি জীবনের কর্মক্ষেত্রের বাইরে তিনি পেশাজীবি সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য, চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র সমিতির উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য এবং চুনতি সমিতি ঢাকা'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সাবেক সহ-সভাপতি ও আমৃত্যু উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ছিলেন।

তথ্যসূত্রঃ

১. আঞ্জুমন স্মরণিকা-চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার ২০০ বছর পূর্তি সংখ্যা।

২. সাজ্জাদ খান- সাঃ সম্পাদক, চুনতি সমিতি ঢাকা।

৩. 'প্রিয় চুনতী' ভাইবার ফোরাম।

ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ

-----------------------------

('প্রিয় চুনতী' ভাইবার ফোরামে আমার স্মৃতিচারণ)

'চুনতি সমিতি ঢাকা'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট এর সাবেক জি এম সদ্য প্রয়াত জনাব এরশাদ উল্লাহ খানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। উনার বর্ণাঢ্য কর্মজীবন, ঢাকায় বসবাসরত চুনতিবাসীদের নিয়ে চুনতি সমিতি গঠন এবং চুনতি কেন্দ্রিক বিভিন্ন আর্থ সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ও অবদান আমরা কমবেশি প্রায় সবাই জানি। আজকে উনাকে নিয়ে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করবো।

আমার মায়ের দিকে তিনি সম্পর্কে নানা হন। আবার পিতার দিকে তিনি আমার এক দাদীর (আব্বার আপন চাচী) আপন ছোট ভাই। উনার ভাইদের মধ্যে তিনি বেশি সামাজিকতা রক্ষা করতেন এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতেন। দুই দিকে আত্মীয়তার সুবাদে আমার বাল্যকাল থেকে উনাকে বেশি করে জানতাম। দাদার বাড়িতেই উনার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। পাকিস্তান পিরিয়ড থেকে তিনি বড় বোনের বাড়িতে আসা-যাওয়া করেছেন। তখন থেকেই তিনি আমাকে ভালভাবে চিনতেন। পরবর্তীতে যেখানে দেখা হোক না কেন কথাবার্তা বলতেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। আম্মার কাছে শুনেছি উনার বড় ভাই চট্টগ্রাম ওয়াসার সাবেক চীফ ইঞ্জিনিয়ার শরীফ উল্লাহ খান (নুরু) আম্মার প্রাইমারি স্কুলের সহপাঠী ছিলেন। তখন হাতেখড়ি স্কুল/ প্রাইমারি স্কুল ছিল চুনতি মুন্সেফ বাজারে। স্কুলে ক্লাস ফাইভ চালু হওয়ার পর হাতেগোনা মেয়ে সহপাঠীদের মধ্যে পারিবারিক বাঁধার কারণে আম্মা ছাড়া আর কেউ ফাইভে পড়ার সুযোগ পাননি। আম্মার সহপাঠী ইঞ্জিনিয়ার শরীফ উল্লাহ খানের সাথে জীবনেও আমার পরিচয় ঘটেনি। চীফ ইঞ্জিনিয়ার থাকা অবস্থায় ওয়াসা ভবনে একবার চেহারা দেখেছিলাম মাত্র। এরশাদ উল্লাহ খান ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি সবার সাথে মিশতেন। সুযোগ পেলেই কর্মস্থল ঢাকা থেকে নিজ গ্রাম চুনতিতে চলে আসতেন। গ্রামে এসে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতেন। চুনতিতে কয়েকদিন থেকে যেতেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরও চুনতিতে আসা-যাওয়া অব্যাহত ছিল। উনার আর এক বড় ভাই আয়কর উপদেষ্টা রশীদ উল্লাহ খানও চুনতিতে আসা-যাওয়া করতেন। শেষ জীবনে নিজ অর্থ ব্যয়ে গ্রামে কিছু জনহিতকর কাজ করে তিনি সর্বসাধারণের কাছে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। এরশাদ উল্লাহ খান ঢাকায় এবং চুনতিতে চুনতিবাসীর সাথে নিবিড় সম্পর্ক রাখতেন। চুনতি ছাড়াও চট্টগ্রাম ও ঢাকা শহরে আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা উনার একটা বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। আমার ছোট মামা সেলিম উল্লাহ ছিদ্দিকীর সাথে উনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ছোট খালার পরিবারের সাথে বেশ সম্পর্ক ছিল। ঢাকায় বসবাসরত আমার ছোট বোনের পরিবারের সাথেও তিনি যোগাযোগ রাখতেন। বাসায় আসা-যাওয়া ছিল। ঢাকায় অবস্থানের কারণে উনার সাথে আমার তেমন দেখা হতো না। বেশির ভাগ দেখা হয়েছে চুনতিতেই আমার সেই কৈশোর থেকে। তিনি বেশ মজার মানুষ ছিলেন। মাঝে মধ্যে রসিকতাও করতেন। একটা ঘটনা না বলে পারছি না। বেশ কয়েক বছর পূর্বে একবার মুন্সেফ বাজারে দেখা হলো। তিনি হেঁটে আসছিলেন। সালাম দেওয়ার পর কুশলাদি বিনিময়ের অপেক্ষা না করে হঠাৎ আমার কাছে সিগারেট চেয়ে বসলেন। আমার পকেটে কিছু একটা আঁচ করতে পেরে বললেন,"নাতি জলদি একটা সিগারেট বের করো। কথা হবে পরে"। আমি বিব্রতবোধ করলাম। কিছুটা লজ্জাও পেলাম। আমার অবস্থা বুঝে তিনি আমাকে সহজ করে দিলেন। তারপর মরহুম রেজা আলী সওদাগরের দোকানের পাকা বেঞ্চে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। তিনি এভাবে বয়সে ছোট বড় সবার সাথে সমানভাবে মিশতেন। উনাকে দেখে তখন ওখানে আরও চার-পাঁচ জড়ো হয়ে গেছেন। তিনি গ্রামবাসীর কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

মরহুম এরশাদ উল্লাহ খান ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত বিনয়ী, সদালাপী, নিরহংকারী, পরোপকারী, সমাজসেবী এবং সৎ ও ধার্মিক ছিলেন। বংশপরম্পরায় চুনতিতে সর্বজন শ্রদ্ধেয় অনেক জ্ঞানীগুণী এবং উচ্চ পদস্হ কর্মকর্তা জন্ম নিয়েছেন যাঁরা চিরস্মরণীয়, তাঁদেরই একজন মরহুম এরশাদ উল্লাহ খান। উনার আদর্শ আমরা যেন ধারণ করতে পারি। আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।

-হেলাল আলমগীর