"প্রযুক্তি বানিজ্য" আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীক সিন্ডিকেট কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এ সিন্ডিকেট স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের স্বার্থ আগে দেখবে। এদের কেউ কেউ জনস্বার্থকে সমান প্রাধান্য দিতে পারে, ব্যবসায়ীক ক্ষতিকে মূখ্য বিবেচনা নাও করতে পারে (এগুলো অবশ্য হাইপোথিটিক্যাল বা উচ্চ মার্গীয় চিন্তাভাবনা আর কি) । তবে 'সিন্ডিকেট' এর স্বার্থ আগে...স্বাভাবিক.... যেহেতু সে ব্যবসা করতে নেমেছে। অবশ্য কেউ কেউ "চ্যারিটি"র নামে প্রচলিত ব্যবসার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে... ভন্ড আর কি। আজকাল পরিবেশ রক্ষা, জ্বালানি সাশ্রয় ইত্যাদি বিবেচনায় বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রবর্তনের কথা বলা হচ্ছে, অথচ সেই ১৯০০ সালেই এটি আবিষ্কৃত হয়। ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত রহস্যময় বিজ্ঞানী "নিকোলাস টেসলা" এ প্রযুক্তির প্রধান চিন্তক (বর্তমানে বিশিষ্ট মহাকাশ গবেষক ও ব্যবসায়ী এলন মাস্ক এই বিখ্যাত "টেসলা" গাড়ি কোম্পানির মালিক)। অথচ ঐ সময়ে এ প্রযুক্তি গ্ৰহন করেনি গাড়ি উৎপাদক ব্যাবসায়িক সিন্ডিকেট। এর প্রধান নেপথ্য কারণ ছিলো 'জ্বালানী তেল/গ্যাস' অর্থাৎ হাইড্রোকার্বন অর্থাৎ ফসিল ফুয়েল (অবশ্য বিদ্যুতের সহজলভ্যতা ছিল না এটিও সত্য) । ইতোমধ্যে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে জ্বালানী তেল ভিত্তিক গাড়ি তৈরির বড় বড় কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, কোম্পানি, বিপণন চেইন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । অবশ্য এর সাথে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিকল্পনার সহযোগ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক উৎস জ্বালানী তেল/গ্যাসের সদব্যবহার করানো না গেলে, ব্যাবসায়িক ফায়দা হবেনা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হবেনা, যেহেতু এই 'তেল' এর সূত্রে সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা করছিল তৎকালীন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহল। মেক্সিকো হয় প্রথম শিকার....পরে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও ভেনেজুয়েলা লাইনে আসে। সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সাথে চীনের "বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ" (BRI) এর সংযোগ আছে বলে অনেকে মনে করে অর্থাৎ ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের সাথে গ্যাস/তেল এর কানেক্টিভিটি স্থাপন বিআরআই এর অন্যতম একটি লক্ষ্য বলে ধারণা করা হয়। ইউক্রেন বিএআরআই-এর জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল, যা যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে। এখন ফসিল ফুয়েল/তেলের রিজার্ভ কমে আসছে। অবশ্য কমে আসছে বলাটা ঠিক হবে না, কারণ এখনো তেল/গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ মজুদ অনাবিষ্কৃত রয়েছে, যার গুরুত্বপূর্ণ উৎস স্থলগুলো হলো আর্কটিক, এন্টার্কটিক ও মহাসাগরের তলদেশ। তবে এগুলো হতে গ্যাস/তেল উত্তোলন চরম ব্যয়বহুল বিধায় এখনো ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগের চিন্তা করছে না। তবে গ্যাস/তেলের সহজলভ্য উৎস স্থলগুলোর মোটামুটি ৫০% ফুরিয়ে গিয়েছে। প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো তাই জ্বালানির ব্যবহারে সতর্ক রয়েছে। এছাড়াও 'পৃথিবী' নামক ছোট এই গ্রহকে বাঁচানোর জন্য কার্বন নিঃসরণ কমানো জরুরি। এ কারণে পূণ:নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা বলা হচ্ছে, যা খুবই ব্যয়বহুল। তেমনি ভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও যথেষ্ট ব্যয়বহুল। মাঝে মাঝে আমরা শুনে থাকি জ্বালানিবিহীন, স্বল্প ব্যয়ে অবিরাম বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা। আমি নিজেও '৯০ এর দশকে দুটি ছোট্ট ডায়নামো/জেনারেটর পরস্পর শ্যাফট এর মাধ্যমে জোড়া লাগিয়ে অবিরাম বিদ্যুত তৈরির কৌশল বের করেছিলাম (অবশ্য পরবর্তীতে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ব্যস্ততার কারণে এ বিষয়ে মনোযোগী হতে পারিনি)। ইদানিং বিশ্বের কিছু স্থান হতে এধরনের অবিরাম বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিভিন্ন কৌশল সম্পর্কিত তথ্য ইউটিউবে প্রচারিত হতে দেখা যায়....লাভ নেই..... আন্তর্জাতিক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবসায়ীরা এগুলো হতে দিবে না। যাই হোক- বলছিলাম যে, প্রচলিত ধারার অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে আশাতীত মুনাফা কামিয়ে বোনাস উপার্জন করছে। তাই অটোমোবাইল সেক্টরে এ মুহূর্তে নতুন প্রযুক্তি আসতে পারে....অবশ্য আসছেও, ইলেকট্রিক বা হাইব্রিড নামে। তারপরও পরিবেশ বাঁচলে হয়।একসময় প্রতিষ্ঠিত অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো শক্ত, মজবুত গাড়ি বানাতো। এ কারনে গাড়ি টিকতো বহুদিন। তবে এর ফলে স্পেয়ারস পার্টস এর ব্যবসা হতো না, পুঁজি গড়াতো না। জাপানের "হোন্ডা" মোটর সাইকেল বা অটোমোবাইল এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। এই এক মোটর সাইকেল দীর্ঘদিন টিকে উৎপাদক ও বিপণনকারীদের বারোটা বাজিয়েছে। আমেরিকা-ইউরোপের প্রথম/দ্বিতীয় জেনারেশনের গাড়িগুলো বেশ শক্ত ধাতব দিয়ে মজবুতভাবে নির্মিত হতো। দুর্ঘটনা হলে এগুলোর তেমন ক্ষয়ক্ষতি হতো না। অন্যদিকে আজকালকার অটোমোবাইলগুলোর বড়ি, স্পেয়ার পার্টস এত হালকা-পাতলা পদার্থ দ্বারা তৈরি যে সামান্য দুর্ঘটনায় অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায় (কাস্টমাইজড মডেলের কথা ভিন্ন)। অবশ্য এর অর্থনৈতিক উপকারিতাও আছে, যেমন স্পেয়ার পার্টস এর প্রয়োজন হবে, গাড়ি রিপেয়ারিং শপগুলোর ব্যবসা হবে (তুলনামূলকভাবে গতি বৃদ্ধির লক্ষ্যে অ্যারো ডায়নামিকস শেপ/ডিজাইন তৈরি করতে হালকা উপকরণ ব্যবহারেরও প্রয়োজন রয়েছে)। এছাড়াও স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মডেল চেঞ্জ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানুষের রুচির পরিবর্তন হচ্ছে, যার সাথে মডেল পরিবর্তনের বিষয়টিও সামঞ্জস্যপূর্ণ। হালকা-পাতলা গড়নের গাড়ি হলে এগুলোকে ধ্বংস করা সহজ (অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মালিকেরা অবশ্য স্পেয়ার পার্টস কিনে কিনে এক মডেলের গাড়ি দীর্ঘদিন চালিয়ে থাকে এবং এ "দুর্বল মালিক" গোষ্টিই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ক্লায়েন্ট)। ইদানিং পুরনো গাড়ি নির্ভর প্রচুর সংখ্যক রিসাইকেল কারখানা গড়ে উঠছে।এবার চলুন মেডিকেল সেক্টরে একটু ঢু মেরে আসি। এটি সভ্যতার জন্মলগ্ন থেকে মানব সেবার পাশাপাশি অন্যতম একটি লাভজনক ব্যবসা খাত। বর্তমানে বিশ্বের ওষুধ সেক্টরসমূহ বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এদের অন্যতম অস্ত্র শক্তিশালী "রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার" এবং "তথ্য" গোপনীয়তার দক্ষতা। এই সিন্ডিকেট ওয়ালারাই নির্ধারণ করে দেবে ডায়াবেটিকস লেভেল এর মাত্রা কত হবে, ব্লাড প্রেশারের উপর-নীচ এর মাত্রা কত হবে, জ্বরের মাত্রা কত হলে তা বিভিন্ন রোগের উপসর্গ নির্দেশ করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য তাদের নিয়ন্ত্রিত গবেষণা সংস্থাগুলো বলবে, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে যুগোপযোগী ধারাবাহিকতায় মাত্রার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ যেমন ধরুন ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে খালি পেটে লেভেল ৬ ও ভরা পেটে লেভেল ১২ মাত্রা সহনীয়। হয়তো রোগীর শারীরিক অবস্থা বিশেষে এই মাত্রা ৮ ও ১৫ হলেও স্বাভাবিক হতে পারে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা (সবাই নয়) ভয় লাগিয়ে দিবে। কারণ "ইনসুলিন" ও সহযোগী কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মেডিসিন এর আন্তর্জাতিক ব্যবসা। আন্তর্জাতিক ওষুধ শিল্প সংস্থাগুলো "ইনসুলিন" এর বিকল্প হিসেবে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হবে এমন ওষুধ তৈরি না করা পর্যন্ত (ধারণা করা হয় বিকল্প ওষুধ ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে আছে, প্রচুর বিনিয়োগে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃক উৎপাদিত "ইনসুলিন" ও সহযোগী ঔষধসমুহের বিপণন মারফত কাঙ্খিত বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জন না করা পর্যন্ত বিকল্প ওষুধের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হবে না ; অবশ্য রোগীর গুরুত্ব বিশেষে বিশেষ অর্ডারে চড়া দামে এ ধরনের যুগোপযোগী ও কার্যকর ঔষধ তৈরি/প্রয়োগ করা হচ্ছে, যা অত্যন্ত গোপন রাখা হয়) প্রচলিত "ইনসুলিন" ও অপরাপর ওষুধগুলো বাজারজাত করিয়ে ছাড়বে। এই বিষয় ব্লাড প্রেশারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ক্যান্সার চিকিৎসা ঔষধ শিল্প ব্যবসায়ীদের মুনাফা অর্জনের বড় একটি সেক্টর। "ক্যান্সার" চিকিৎসায় প্রচলিত ওষুধ ব্যবস্থার বিকল্প হয়তো তৈরি হয়ে আছে, তবে ব্যাপক বিনিয়োগে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানগুলো চলমান উৎপাদিত ঔষধ (কেমো থেরাপি) হতে বোনাস মুনাফা অর্জন শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রচলিত "কেমোথেরাপি" প্রয়োগ করিয়ে ছাড়বে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মেডিসিন শিল্পের অকল্পনীয় অগ্রগতি হয়েছে। এর নেপথ্য কারণ একটু আগে যে বললাম "রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট" ও অতিমাত্রায় দক্ষতার সাথে "তথ্য" গোপন রাখার ব্যবস্থা। আমেরিকা-ইউরোপ ভিত্তিক বড় বড় ওষুধ শিল্পসমূহের উপর ঐসব বড় বড় দেশের আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা সমূহের কঠোর নজরদারি রয়েছে। কারণ এই শিল্পের মাধ্যমে প্রভাবশালী দেশগুলো আধুনিককালের উপনিবেশিক শাসন চালিয়ে যাচ্ছে। এরা গরিব দেশগুলোর জনসাধারণের উপর নতুন নতুন আবিষ্কৃত ওষুধসমূহ প্রয়োগ করায়। পরবর্তীতে তাদের নিজস্ব কিছু এনজিও প্রয়োগকৃত ওষুধসমূহের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে ও এ সম্পর্কিত নিয়মিত প্রতিবেদন প্রেরণ করে। এ প্রতিবেদনগুলোই গবেষণার চূড়ান্ত সফলতা প্রতিফলিত করে এবং এর ভিত্তিতে নির্ধারিত হয় আবিষ্কৃত ঔষধের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হবে কি না।এবার আসি ইলেকট্রনিক্স পণ্য সামগ্রীর বিষয়ে। স্লিম আকৃতির টিভি বাজারে এসেছে এই ১৫/২০ বছর হবে। অথচ '৭০/৮০ র দশকেই ফ্ল্যাট টিভির প্রযুক্তি তৈরি হয়েছিল বলে জানা যায়। ঐ যে বললাম, আন্তর্জাতিক টিভি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর পুঁজি দিয়ে প্রচলিত CRT tv ভিত্তিক কারখানা স্থাপন করেছে। এমতাবস্থায় LCD/LED ভিত্তিক ফ্ল্যাট টিভি উৎপাদনে যেতে হলে আগের বিনিয়োগ বাতিল করে নতুন বিনিয়োগে যেতে হবে, যা ব্যাবসায়িকভাবে লাভজনক হতো না। মোটামুটি সারকথা একটিই..... বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হওয়াটি মুখ্য বিষয়, কোটি কোটি ভোক্তা ক্লায়েন্টের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচ্য নয়। এই সিন্ডিকেট প্রথা অতীতেও ছিল, বর্তমানেও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে (অবশ্য সিন্ডিকেট ছাড়া বিশ্বের এত বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক বাণিজ্য পরিচালনা সম্ভব নয়)। এদের মর্জি অনুযায়ী বিশ্ববাসীকে চলতে হবে। আমি-আপনি যতই জনবান্ধব, পরিবেশবান্ধব, অধিকতর কার্যকরী ও সাশ্রয়ী মূল্যের পণ্য উৎপাদনের ফর্মুলা আবিষ্কার করি না কেন সিন্ডিকেটের অনুমতি ছাড়া বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়া যাবে না। বস্তুতপক্ষে পৃথিবীটা মহাবিশ্বের অন্যতম একটি ক্ষুদ্র গ্রহ হলেও "স্বার্থ" সংশ্লিষ্ট কৌশল বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি "স্মার্ট" একটি গ্রহ। ওয়াহিদ আজাদ ; ০৯ এপ্রিল ২০২২
Make sure you enter the(*)required information