চন্দ্র বা চাঁদ আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী মহাজাগতিক বস্তু। পৃথিবীর ক্রিয়াকলাপ এর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই চন্দ্র। পৃথিবীর সৃষ্টি লগ্ন থেকে চাঁদ তার সহযোগী বা বডিগার্ড হিসেবে চারপাশে ঘুরছে। ধারণা করা হয়, পৃথিবীর মতোই চাঁদের উৎপত্তি, সূর্যেরই একটা অংশ ছিটকে ঠান্ডা হয়ে চাঁদের আকৃতি নিয়েছে। কারো কারো মতে চাঁদের বয়স পৃথিবীর চেয়েও বেশি এবং এর উৎপত্তি সূর্য্য নয় বরং অন্য কোন নক্ষত্রের ছিটকে পড়া অংশ, যা দলছুট হয়ে সৌর জগতে প্রবেশ করেছিল।যাই হোক না কেন এই চাঁদ আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। কি মহাকর্ষীয় তত্ত্ব, কি ভূগোল, কি জ্যোতির্বিজ্ঞান, কি সাহিত্য, কি কুসংস্কার বা সংস্কার সর্বক্ষেত্রেই এই চাঁদ রয়েছে। চাঁদ হলো জগতের 'মামা'। চাঁদ না থাকলে বুঝি শিশুদের কপালে টিপ দেয়ার কেউ থাকতো না, চাঁদ না থাকলে প্রেম ভালোবাসা জাগরিত হতো না, সাহিত্য তৈরি হতো না। চাঁদ ছিল বলেই গায়কেরা শ্লোক খুঁজে পেয়েছিল, গীত গাইতে পেরেছিল ....ও চাঁদ সুন্দর রুপ তোমার ... চাঁদ তারা সূর্য নও তুমি.... আবার চাঁদকে ঝলসানোও হয়েছে, মনের দুরবস্থায় চাঁদের উপর ক্ষোভ ঝেড়েছেন কবি 'পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি..' !চাঁদকে দিয়েই মানবসভ্যতার মহাকাশ চর্চার শুরু। এই চাঁদই আমাদেরকে প্রথম দিনক্ষণ গণনা শিখিয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসের দিনপঞ্জিকা গুলো অধিকাংশই চন্দ্র নির্ভর। মানবজাতির যুদ্ধ বা সমরকৌশল এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এই চাঁদ ও চাঁদ এর অস্তিত্ব। রাতে চাঁদের আবির্ভাবের উপর ভিত্তি করে যুদ্ধ কৌশল প্রণয়ন করা হতো। এখনো সমরকৌশল বিদ্যার গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ এই চাঁদ।যতই সাধারণ মনে হোক না কেন চাঁদের বিষয়টি খুবই জটিল। প্রথমত চাঁদ সরাসরি নিজ অক্ষের উপর ঘোরে না, দ্বিতীয়তঃ পৃথিবী তার নিজ অক্ষের উপর ২৩° হেলিয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ও চাঁদ অনিয়মিত কক্ষ পথ ধরে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে, যে কারণে আকাশের চতুষ্কোণে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন উজ্জলতায় চাঁদকে দেখা যায়। চাঁদের 'কলা' জটিল একটি বিষয়। 'কলা' হল চাঁদের উজ্জ্বলতার হ্রাস-বৃদ্ধির অধ্যায়, যাকে দশা বা phase বলি। একটু আগে বললাম, চাঁদ নিজ অক্ষের উপর ঘোরে না, এ কারণে আমরা পৃথিবীর কোন একটি অংশ হতে চাঁদের এক পাশ দেখতে পাই [চাঁদের এই অংশ কোন কারনে বিপরীত অংশের চেয়ে কিছুটা ভারী অথবা হালকা বিধায় পৃথিবীর টানে (tidal locking) নিজ অক্ষের উপর ঘুরতে পারে না, হয়তোবা]। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বুঝবো চাঁদ পৃথিবীর দিকে মুখ রেখে পৃথিবীর চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করার সাথে নিজ অক্ষকে (পরোক্ষভাবে) ঘিরে একবার আবর্তিত হয়, যা আহ্নিক গতি বিবেচনায় একদিন এবং পৃথিবীর চারপাশ ঘুরে আসছে বলে এ সময়কে এক বৎসরও বলা যায়। তাই বলা হয়ে থাকে চাঁদের একদিন ও এক বছর সমান। হিন্দু ধর্ম মতে চাঁদের ১৬ টি 'কলা' বা দশা ( phase) এবং ভারতের প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা অনুসারে ৩০ টি 'তিথি' (রজনী/রাত) আছে। অমাবস্যা হতে পূর্ণিমা পর্যন্ত ৮টি ও পূর্ণিমা হতে অমাবস্যা পর্যন্ত বাকি ৮টি 'কলা' রয়েছে। হিন্দু ধর্ম মতে দেবতা কর্তৃক 'কলা'সমূহ প্রভাবিত, তাই দেবতাদের নামেই 'কলা'র নামকরণ করা হয়। 'অমাবস্যা' হতে 'পূর্ণিমা' হয়ে আবার 'অমাবস্যা'য় আসতে ১৬ কলা পূর্ণ করতে হয় যা আমরা 'বাগধারা' (phrase) হিসেবে ষোলোকলা পূর্ণ হওয়াকে বুঝি। 'তিথি' র (রজনী/রাত) বেলায় 'অমাবস্যা' হতে 'পূর্ণিমা' পর্যন্ত ১৫ টি 'তিথি' রয়েছে এগুলোকে 'শুক্লপক্ষ' (ক্রমান্বয়ে উজ্জল হওয়া) এবং 'পূর্ণিমা' হতে 'অমাবস্যা' পর্যন্ত বাকি ১৫ টি তিথিকে 'কৃষ্ণপক্ষ' (ক্রমান্বয়ে ক্ষয়ে যাওয়া বা উজ্জলতা হারানো) বলা হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, পূর্ণিমায় চাঁদের দৃশ্যমান অংশ ১০০% আলোকিত ও অমাবস্যায় চাঁদের ওই দৃশ্যমান অংশ ১০০% অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকে। চাঁদের একমাস অর্থাৎ চন্দ্র মাস আনুমানিক ২৯.৫০ দিনে হয়। প্রতি ৭ দিন অন্তর অন্তর এটি পৃথিবীর চারপাশে সমকোণে অবস্থান করে। প্রতিবারে ৪৮/৫০ মিনিট অন্তর চাঁদ আকাশে আবির্ভূত হয়। দিনের বেলায়ও আকাশে চাঁদ থাকে, তবে সূর্যের আলোর কারণে চাঁদকে দেখা যায় না। চাঁদের পরিক্রমণ কাল অন্যান্য জ্যোতিষ্কের তুলনায় বেশি নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। তাই চন্দ্র মাসের হিসাবে কম গরমিল পাওয়া যায়।পৃথিবী ও মানব জাতির উপর চাঁদ এর প্রভাব অপরিসীম। পারস্পরিক মধ্যাকর্ষণ বলের মিথস্ক্রিয়ায় পৃথিবী ও চাঁদ পরস্পর নিজ অক্ষরেখার উপর স্থিতিশীল থাকছে। চাঁদ আকারে পৃথিবীর চেয়ে অনেক ছোট এবং এর অভিকর্ষ বল পৃথিবীর ১/৬ ভাগ হলেও চাঁদের মধ্যাকর্ষণ বল নিজ আকারের তুলনায় পৃথিবীর উপর ভালোই প্রভাব ফেলে। চাঁদের কারণে পৃথিবীর জলভাগ ফুলে উঠে, যা জোয়ার-ভাটার কারণ ঘটায়। পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যাকর্ষন বলের সমন্বয়ের ফলে পৃথিবী তার উপরিভাগে জলবায়ুর স্তর আটকে রাখতে সমর্থ হয়েছে, যা পৃথিবীতে 'প্রাণ' ধারণের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। চাঁদের অবস্থানের কারণে পৃথিবী নিজ অক্ষের উপর সুষমভাবে ঘুরছে ও আমাদের জন্য সুন্দর দিন-রাত্রির সৃষ্টি করছে। আনুমানিক ২৯.৫০ দিনে চাঁদের একটি মাস পূর্ণ হয়। প্রচলিত ইংরেজি বা গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের ১ বৎসরের চেয়ে চাঁদের ১ বৎসর আনুমানিক ১০ দিন কম হয়ে থাকে [উল্লেখ্য, যিশুখ্রিস্টের জন্ম কালকে ১ ধরে প্রচলিত ইংরেজি ক্যালেন্ডার প্রবর্তিত হয় ; যিশুখ্রিস্টের পূর্ববর্তী বৎসরসমূহ BC (Before Christ) ও যিশুখ্রিস্টের জন্মের পরবর্তী বৎসরসমূহ AD (Anno Domini) হিসেবে ইংরেজি পঞ্জিকায় অন্তর্ভুক্ত]। আবহমান কাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের সভ্যতাসমূহ (আরবীয়, মিশরীয়, এসিরীয়, সুমেরীয়, ভারতীয় ও চৈনিক সভ্যতা ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য) চাঁদের আবির্ভাব ও প্রকৃতির উপর তদ্বিয় প্রভাব বিবেচনায় মৌসুম নির্ধারণ করে, অর্থাৎ চাঁদের প্রভাবে প্রকৃতি যে প্রতিক্রিয়া দেখায় তার উপর ভিত্তি করে ফসল বোনা, ফসল কাটা, শুভ কার্য সম্পাদন করা, শুভ কার্য সম্পাদন হতে বিরত থাকা, ব্যবসায় মনোনিবেশ করা, যাত্রা/ভ্রমণ করা অথবা ভ্রমণ হতে বিরত থাকা, যৌন কার্যক্রমে জড়িত থাকা বা বিরত থাকা ইত্যাদি অনুশাসনের মতো মেনে চলা হতো। পরবর্তীতে চলমান প্রথানুযায়ী পঞ্জিকার প্রণয়ন শুরু হয়। উল্লেখ্য, চাঁদের সাথে পৃথিবী/সূর্যের অবস্থান ও দূরত্বের কারণে পৃথিবীর বিদ্যুৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্র প্রভাবিত হয়। অতীতের লোকজন এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না বুঝলেও, ঐ সময়ের অভিজ্ঞ মানুষেরা তা টের পেতো। অনেক সময় আমরা শুনে থাকি, অমাবস্যায় মানুষের পুরনো রোগ জেগে উঠে, হাতে-পায়ের ব্যথা জেগে উঠে, অপ্রকৃতস্থ মানুষের পাগলামি (moonstruck/চন্দ্রাহত) বেড়ে যায়। এ ধরনের মানসিক ও শারীরিক প্রকাশসমূহ সমাজের বুদ্ধিমান মানুষেরা পর্যবেক্ষণ করতো, যা পরবর্তীতে বংশের ধারাবাহিকতায় মতান্তরিত হত। এরূপ ধারাবাহিকতার আধুনিক পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা ঐ প্রকাশগুলোকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন।চাঁদের পরিবর্তনশীল আকৃতি ও বহুমাত্রিক বর্ণ যুগে যুগে সমাজকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। সমাজের একটি বড় অংশ এ নিয়ে কুসংস্কারবদ্ধ হয়েছে। এক ধরনের কুসংস্কার মতে অমাবস্যার তিথি ও কৃষ্ণপক্ষের তিথিসমূহ অশুভ। ক্ষয়যুক্ত চাঁদের বিভিন্ন বর্ণিল রূপ নির্জন রাত্রিতে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন আশঙ্কা জাগিয়ে তুলতে প্রভাবিত করেছে, যা যুগে যুগে অদ্ভুত সব myth তৈরি করিয়েছে। বস্তুতপক্ষে পৃথিবীর আবহাওয়া মন্ডলে বেশ কয়েক প্রকারের গ্যাসের অস্তিত্ব আছে, যা অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় অবস্থান করে। স্বাভাবিক অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও কার্বন ডাই অক্সাইড ব্যতীত কোন কোন অঞ্চলে মিথেন, নিয়ন.... কোন কোন অঞ্চলে সালফার ডাই অক্সাইড... কোন কোন অঞ্চলে কার্বন মনোক্সাইড, ক্লোরোএছাড়াও আছে বিভিন্ন ধরনের ধূলিকণা। এসকল গ্যাসীয় মাধ্যমে ও ছোট ছোট বহু কোনিও প্রিজম আকৃতির ধূলিকণাসমূহে চাঁদের আলো প্রতিফলিত/প্রতিসরিত পূর্বক বিভিন্ন রংএ আলোকিত হয়ে আমাদের চোখে ধরা পড়ে। আর এগুলো নিয়ে শুরু হয়ে যায় কুসংস্কারের কাব্য তৈরীর ধারাবাহিকতা।যাহোক এত সুন্দর একটি মহাকাশীয় 'গোলক' যা আমাদের সামগ্রিক দর্শনকে যুগ যুগ ধরে প্রভাবিত করে আসছে, তাকে বোঝা নেহায়েত সোজ নয়। তার সৌন্দর্য বা তার রকমারি আকৃতি ও বৈচিত্র্যময় বর্ণ আমরা বিভিন্নভাবে বিচার করে থাকি, উপলব্ধি বা উপভোগ করে থাকি। এভাবেই চাঁদ আমাদের অস্তিত্বের এক মূল্যবান উৎস হয়ে আছে।Wahid Azad : 23/04/22
Make sure you enter the(*)required information