বাবাকে নিয়ে প্রথমবারের মত লিখছি। বাবার সাথে আমার সর্ম্পকটা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়। হয়ত এ কারণেই প্রতিবার লিখতে গিয়ে থমকে গিয়েছি। বলার ক্ষেত্রেও আমার এ থমকে যাওয়া নতুন নয়। অনেকবার বলতে গিয়েও সংশয় আর সংকোচে আমি বাবাকে কখনো বলতে পারিনি-‘তোমায় অনেক ভালবাসি, বাবা’। উপরের লাইনগুলো পড়ামাত্রই, বাবার সাথে আমার সর্ম্পকটাকে ‘নেকামো’ বা ‘আদিক্ষ্যেতা’ হিসাবে নিবেন না। আসলে বাবার সাথে যে কোন সন্তানের সর্ম্পকটাকে লিখে প্রকাশ করার চেয়ে অনুভব করা সহজ বলেই আমি মনে করি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র, ব্যক্তিবোধ, স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক চেতনা, যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক একজন মানুষ হিসাবে বেড়ে ওঠার শিক্ষা আমি বাবার কাছেই পেয়েছি। পরিণত বয়সে এটা আমার গভীর উপলব্ধি, সহজ স্বীকারোক্তি। ছোটবেলায় যখন হাউস টিওটর বাসায় পড়াতে আসতেন, তখনও বাবা টিভিতে চলমান পছন্দের গানটি শোনানোর জন্য পড়ার ফাঁকে আমায় ২ মিনিটের জন্য ডেকে নিতে ভুলতেন না। হিন্দুপাড়ার লোকনাথ আশ্রমে যখন বাবাকে নিমন্ত্রণ করা হত, তখনও বাবা আমাকে পালাগান শোনানোর জন্য নিয়ে যেতেন। বড় হওয়ার পর পরিবার আমার ধর্মচর্চা নিয়ে যতবারই অযৌক্তিক মন্তব্য করেছে, বাবা থামিয়ে দিয়েছেন। অল্পকথায় সরলরৈখিকভাবে বলা যায়, খুব কম বয়স থেকেই আমার ব্যক্তি স্বাধিনতা ও স্বাতন্ত্রকে আমার বাবা সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করে, আমাকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, অল্প বয়স থেকেই ব্যক্তি স্বাধিনতা ও স্বাতন্ত্র ভোগ করাটা একদিকে যেভাবে আমাকে চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী-তার্কিক একজন মানুষ হিসাবে বেড়ে ওঠতে সহায়তা করেছে, অন্যদিকে খানিকটা ‘বেওড়া’ (একগুয়ার) প্রকৃতিও আমার চরিত্রে মিশিয়ে দিয়েছে। অবশ্য এসব নিয়ে আমি মোটেও বিচলিত নই। নিজের বাবাকে ‘অভিজাত ভিক্ষুক’ তাকমা দেওয়ার দুঃসাধ্য দেখে অনেক অবাক হতে পারেন। আমি নিজেও হয়ত এভাবে ভাবতাম না। কিন্তু কিছুদিন আগে একজন চিন্তাশীল ব্যক্তির মুখে পপঞ্চটি শুনামাত্রই আমার মনে ধরে গেল। লোকটা মোটেও মিথ্যে বলে নি। বাড়িয়েও বলে নি। আমি নিজেও এই ‘অভিজাত ভিক্ষুকে’র সন্তান হতে পেরে নিজেকে যথেস্ট ভাগ্যবান মনে করি। ১৯৮৯ সালে চুনতি মহিলা ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। আমার বাবাসহ চুনতির অসংখ্য মহামান্য-সম্মাণিত ব্যক্তিবগের্র অসামান্য অবদান ও সহযোগিতায় আমার বাবা প্রতিষ্ঠানটিকে দাড় করাতে সক্ষম হন। এ কলেজ প্রতিষ্ঠা নিয়ে একটা কাহিনী তিনি অনেকবার বলেছেন। একদিন কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে বাবা দেখলেন, আমিরাবাদ বাস স্টেশনে এলাকার কিছু ছাত্রীকে পথচারীদের কয়েকজন উত্ত্যক্ত করছিল। কথা প্রসঙ্গে তিনি জানতে পারলেন, এরা চুনতি থেকে বার আউলিয়া ডিগ্রী কলেজে ক্লাস করতে আসা যাওয়ার পথে প্রায়ই এরকম যৌন হয়রানীর শিকার হতো। কোন কারণে সেদিন মনের অগোচরে একটা কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন তিনি। তারপরে একদিন কলেজটি যাত্রা করল এবং আজঅবধি ঠিকে আছে। চুনতিতে অস্তিত্বমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় বির্তকের ঝড় ওঠেছে। আমার বাবার সমালোচনাও কম হয়নি, যেহেতু কেউই সমোলোচনার উর্ধ্বে নন। এসব বিষয়ে আজ নয়, অন্য একদিন লিখব। সমালোচনার কথাটি আনলাম একারণে যে, কলেজের প্রতি বাবার একাগ্রতা ও একনিষ্টতা আমি কাছে থেকে অনুভব করেছি। আমার মা রেগে গেলে এই কলেজকে নিজের সতীনের সাথে তুলনা করে মনের ঝাল মেটাতেন। আমরা ভাই-বোনেরাও এই অতি একাগ্রতা নিয়ে অনেকবার বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু বাবার মন-প্রাণ আর অস্তিত্বজুড়েই ছিল কলেজটি। এমনকি আমার জন্মের বছরই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন বলেই আমার নাম রেখেছিলেন ফরচুন (যার বাঙলা অর্থ ‘ভাগ্য’ )। দুই বছর আগেও আমি তাঁকে অভিযোগ করতাম, ‘একটা কলেজ নিয়ে গ্রামে পড়ে থাকার কি কোন দরকার ছিল’? সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলেজের জন্য অর্থ সহযোগিতা ছাড়াও অনান্য উন্নয়নের জন্য তিনি মানুষের দুয়ারে গিয়েছেন। যেসব কাজে বাবা মাথা না ঘামালেও পারতেন, সেসব কাজও স্বপ্রণোদিত হয়ে করেছেন। কলেজের কাজে তাঁর রাত -দিন কোন তফাৎ ছিল না, প্রিন্সিপাল-কেরাণীর কাজের বিভাজন ছিল না, শুক্রবারেও ছুটি ছিল না। এতসব অভিযোগ মনে আসা মাত্রই নিজে বিব্রত হতাম আর একদিন পেয়ে গেলাম চমৎকার সেই প্রত্যয়- ‘অভিজাত ভিক্ষুক’। এতসব অভিযোগের মূল কারণ হল, চাকরির বাজারে মূল্যায়িত হওয়ার মত যথেস্ট যোগ্যতা আমার বাবার ছিল। ১৯৭১ সালে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাচে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি। আজকের দিনেও আমরা দেখি, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির বেলায় ‘ভাল ফলাফলধারীরা’ পছন্দের তালিকায় ইংরেজি সাহিত্যকে শীর্ষে বিবেচনা করে। তাহলে সদ্য স্বাধীন দেশের বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোার অনেক পদেই চাকুরী করার মত যোগ্যতা নিঃসন্দেহে তাঁর ছিল। কিছুকাল আগ পর্যন্তও আমার আক্ষেপ ছিল, সেখানে না গিয়ে কোন দুঃখে তিনি এই ‘অভিজাত ভিক্ষুক’ হতে গেলেন? কেন তিঁিন কলেজ-কলেজ-কলেজ করে করে নিজের জীবনটা শেষ করে গেলেন? বিনিময়ে কি পেলেন বা না পেলেন সে বিষয়ে আমার আক্ষেপ নেই, সেসব অন্য আলাপ। তবে আমার স্পষ্টই মনে আছে, আমার মধ্যে এই আক্ষেপের বোধটা তৈরি হয়েছিল অষ্টম শ্রেণীতে আর বিরাজমান ছিল আজ থেকে দুই বছর আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ ২০১০ সাল পর্যন্ত। প্রশ্ন আসতে পারে, দীর্ঘদিনের ধারনা রাতারাতি বদলে যাবার কারণ কি হতে পারে। মানুষের চিন্তা প্রতিনিয়তই পরিরবর্তিত হয়। তবে আমার অনুধাবনটা অনেকের কাছে খানিকটা বাড়াবাড়ি মনে হলেও, মোটেও অযৌক্তিক নয়। এ কারণেই আমি চিৎকার করে বলতে পারি, -আমার বাবার শ্রম, সাধনা, কীর্তি সত্যিই মহান। মহাকালের বুকে নিক্ষেপ করা এই অভিজাত ভিক্ষুকটিও তাঁর আপন মহিমায় উজ্জল, অন্তত আমার কাছে। ছোটবেলায় কোন একটা বইতে পড়েছিলাম- /... ... ... ‘এমন জীবন হবে করিতে গঠন মরণে হাসিবে তুমি, কাদিঁবে ভূবন।’/ আমি বিশ্বাস করি, আমার বাবার বিদায়ের পরে আমার বাবার নামটা যাতে মুছে না যায়, অন্তত তার জন্মস্থানে, সেই ব্যবস্থাটি এই ‘অভিজাত ভিক্ষুক’ করতে চেষ্টা করেছেন। এলাকার মানুষকে অর্থ সহযোগিতা করে নয়, অসংখ্য মসজিদ, মন্দির, সমবায় প্রতিষ্ঠা করে নয়, একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে তিনি এ কাজ করেছেন। তাজমহলের মত দৃষ্টিনন্দন সৌরম্য অট্টালিকাও তিনি নির্মাণ করেন নি, তার সেই অর্থ ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু তিনি যে প্রতিষ্ঠান করে গেছেন তার শক্তি তাজমহলের চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি বলে আমি বিশ্বাস করি। বিষযটা সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যুগে যুগে প্রেমের নিদর্শণ হতে পারে মানুষের ‘হৃদয়’, কখনোই তাজমহল নয়। আপনার প্রেম যে শাহজাহানের চেয়ে কম সেকথা আমি কি করে দাবী করি ? শাহজাহান তো মমতাজকে তার ‘হৃদয়’এ জায়গা দিতে না পেরেই যমুনার তীরে জায়গা করে দিয়েছিলেন। আর সে কারণেই তো তাজমহল প্রেমের নিদর্শণ হতে পারে না কখনো। একে শুধুমাত্র দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ বললেই এর যথার্থতা। তাজমহল যখন নির্মাণাধীন, তখন শাহজাহানের প্রজারা দুর্ভিক্ষে অভূক্ত ছিল। এই সময়েই ইউরোপজুড়ে জ্ঞানচর্চার হিড়িক পড়েছিল যা পরবর্তীতে ইউরোপে রেঁনেসা এনে দিয়েছিল। অথচ এই সময়েই আমাদের ভন্ড প্রেমিক শাহজাহান প্রেমের নির্দশন স্থাপন করলেন! আমার আক্ষেপ, সেদিন যদি তাজমহল না বানিয়ে মমতাজের নামে অন্তত ১০ টি সামাজিক প্রতিষ্ঠান তিনি তৈরি করতেন, তাহলে হয়ত ইউরোপের অনেক আগেই ভারতবর্ষ আলোকিত হতে পারত। থাক এসব কথা। এসব নিয়ে নানা মুনির নানা মত, পরে আলাপ হতে পারে। তাহলে, আমার বাবা এমন একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, যেটি মানুষকে আলোকিত করছে, করবে। এই প্রতিষ্ঠান যদি কোনদিন ব্যর্থ ও হয়, তবুও একটি শক্তিশালী সামাজিক প্রতষ্ঠাণের স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি। এ প্রতিষ্ঠাণের অস্তিত্ব ও সফলতাকে ধরে রাখতে তিনি যদি অভিজাত ভিক্ষুকও হয়ে থাকেন, তবুও তার প্রতি আমার সম্মাণ, শ্রদ্ধা ও ভাললাগার বিন্দুমাত্র কমতি নেই। এই ভিক্ষুক তার জন্মস্থান, নিজ গ্রাম, জাতি ও দেশকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান অন্তত দিতে পেরেছে। ‘উচ্চ শিক্ষিত’, ‘অভিজাত’ ও সমাজের ‘উচু তলার’ মানুষ হতে দোষ নেই। এটা আনন্দের, গর্বের এবং প্রসংশনীয় একটা বিষয়। তবে ব্যক্তি স্বক্ষমতা ও অর্জন যেন শুধু ব্যক্তি পর্যায়েই সীমিত না থাকে, দেশ ও দশের জন্য সেই স্ব-ক্ষমতার ব্যবহারের দিকটা নিয়েও ভাববারও যথেস্ট অবকাশ আছে। কারণ-অর্থ ক্ষমতা, ভালো বেতনে লোভনীয় চাকুরী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার চেয়ার- সবকিছুই কালের পরিক্রমায় একদিন শূণ্য হয় এবং একইভাবে পূর্ণ হয়। আমার ‘অভিজাত ভিক্ষুক’ বাবা অন্তত এই চিন্তার সাথে পরিচিত ছিলেন। চুনতির এমন অনেকেই হয়ত আছেন, যারা ‘উচ্চ শিক্ষিত’, ‘অভিজাত’ ও সমাজের ‘উচু তলার’ মানুষ হয়েও ব্যক্তি উন্নয়নের বাইরে তেমন কিছুই করতে পারেন নি। এনারা যদি নিজ গ্রামের প্রতি যদি কোন দায়িত্ববোধ অনুধাবন করতে না পারেন, নিজ গ্রামকে দেওয়ার মত যদি কিছুই না থাকে এনাদের, তবে সেটা হবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। যদি এমনটি হয়ে থাকে তবে আপনার জন্মস্থান চুনতিও আপনাকে মনে রাখার প্রয়োজনিয়তা অনুভব করে না বলে বোধ করি, অন্তত আমি, তা আপনি যত বড় সামাজিক মর্যাদার অধিকারী হোন না কেন। তাই, চুনতি গ্রামের ক্ষমতাবানদের প্রতি আমার আহবান, আপনারাও এ গ্রামের জন্য এমন কিছু একটা অন্তত রেখে যান, যাতে করে আপনাদের বিদায়ের পরেও আপনারই পরবর্তী প্রজন্মের কেউ একজন চিৎকার করে আপনার মহিমা ঘোষণা করার সুযোগ পায়। আমার চেতনায় একজন মহান স্বপ্নদষ্ট্রা যিনি সমাজের কাছে ‘অভিজাত ভিক্ষুক’ হয়েও অনেক দিন বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মের কারণে, আপন মহিমায়, তাঁর দূরদর্শী দর্শনের কারণে, তিনি আমার জন্মদাতা । সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৮৯ সালে চুনতি গ্রামে যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠেছিল, সেই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, অন্তত ততদিন একজন ‘অভিজাত ভিক্ষুক’ ও বেঁচে থাকবেন। আমি সেই ‘অভিজাত ভিক্ষুকে’র সন্তান হতে পেরে নিজের কাছে সম্মানিত। অসামান্য আনন্দিত। ২৪ জুন, ২০১২/ সোমবার।
Make sure you enter the(*)required information