নর্তকী যখন জলপরী ! রং মহলের রঙ ঢং’- ||||||||||||||||||||||||||||| চুনতি শাহ সাহেব গেইটে টানা এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে যখন চট্রগ্রাম অভিমুখী বাসটা পেলাম তখন নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছিল। বিকালের পড়ন্ত রোদ গাড়ির সামনের বিশাল গ্লাসে এসে অন্য এক মায়ার সৃষ্টি করেছে।নাকি দীর্ঘ অপেক্ষার পর পাওয়া বলে এমনটা মনে হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছিনা। কোচের নাম দেখছি- নিশানে খাজা! চট্রগ্রাম - কক্সবাজার -চট্রগ্রাম। বিরতিহীন - ক্লোজ ডোর। চালকের ঠিক দুই সিট পরে জানালার নোংরা পর্দার পাশে ভীষণ চাপা টেডি সিট ই--১, পাশের যাত্রী দেখছি ঘুমিয়ে কাত হয়ে আছেন,তার চেয়ে দুঃখজনক হলো তিনি কঠিনভাবে নাক ডাকছেন। মনে হচ্ছে দুপুরে তিনি প্রচুর টেনেছেন ভুঁড়িভোজ' যাকে বলে। কিন্তু তারচেয়ে ও বড় সমস্যা হচ্ছে- কিছুক্ষন পর পর আমায় গায়ে এসে পরছেন আর যেই আমি উনাকে সোজা করে দিচ্ছি তখনি তিনি পাশ ফিরে আমার দিকে একটু আলগা হয়ে অতি কৌশলে পেটের দূষিত বাতাস ছেড়ে দিচ্ছেন- উফ কি পচা দু:র্গন্ধ। নিশ্চয়ই ব্যাটার পেট পচে গেছে। আচ্ছা তার খাদ্য তালিকায় বাসি মাইট্যা,সুরমা’ জাতীয় মাছ ছিল না তো ? কি করি, আমি কি করি ? :ঃ বদ্দ্যা ভাড়া দন- ঃ আচ্ছা পিছনে একটা সিট দেয়া যাবে ? ঃ সাতকানিয়ায় জি- ২,জি-৩ দু' টা সিট কালি হবে। ঃ আচ্ছা ঠিক আছে। বাসের ময়লা দাঁতের অশিক্ষিত কন্ট্রাক্টটার বলে কথা নয় এমন আরো অনেক শিক্ষিতজন আছেন যাদের ও ক' খ' তে সমস্যা আছে। কিন্তু সাতকানিয়া তো এখনো অনেকদূর। মাত্র আমিরাবাদ পার করছি। ঘুমন্ত খবিস টাকে হালকাভাবে সরিয়ে পিছনে আসার সময় মনে হলো ইবলিসের মুখে চাপা হাসি। আরে বাসের জানালার উপরের অংশে দেখছি যাবতীয় ভুল বানানের আবর্জনার স্তুপ। না, উল্লেখ করে আপনাদের আর অরুচিতে ফেলতে চাইনা এম্নিতেই হারামীটার ত্যাগ করা বিশ্রী সেই বাতাসে এখনো কেমন যেন বমি বমি ভাব ঠেকছে। ওয়াক থু! কিন্তু থু থু ফেলার জায়গা পাই কই ? তখনি, কোচের গতি কমে এলো। কেউ একজন নামছেন। হায়রে, ক্লোজ ডোর। আরে বন্ধ দরজাই যদি হবে তবে তো আমি নিজেও এই গাড়ির যাত্রী হবার কথা নয়। ভদ্রলোক মধ্যবয়সী। গায়ে সাফারি, চেকপেন্ট, বিবর্ণ জুতো আর হাতে পুরানো আমলের ঘড়ি বহু ব্যবহারে ঘোলা গ্লাস, শিকলের ফাঁকে ফাঁকে ময়লার মতো কালের দাগ, তৈলাক্ত চেহারা দেখে সহজেই বুঝা যাচ্ছে তিনি একজন মাঝারি সরকারি কর্মকর্তা। ইতিমধ্যে আস্তে আস্তে বাস দাঁড়িয়ে গেছে। যাত্রী ও নেমে যাচ্ছেন। মহাশয়ের হাতে মধ্যম সাইজের একটা ফ্যামিলী ব্যাগ। হঠাৎ কি যেন একটা মনে আসতেই তিনি পিছনের সিটের এক যাত্রীর দিকে ফিরলেন - ঃভাই তা হলে আসি কেমন ? আমার পেছনের যাত্রী তখন বিদায় শুভেচ্ছা জানালেন ঠিক এভাবে – ঃ ভাই মুরুব্বীদের সালাম, ভাবীকে ম্যারেজ ডে' শুভেচ্ছা আর বাচ্চাদের আদর দিবেন। আর অবশ্যই চিটাগাং পৌঁছে আমাকে মোবাইল করবেন। ( মোবাইল করা মানে কি ?) খোদা হাফেজ। ........................................................... অবশেষে কাঙ্খিত সেই সাতকানিয়া। সিটে বসতেই মনে হলো ভিজে কিছু একটার উপর বসে আছি।কি হতে পারে, পানি নাকি বাচ্চার প্রস্রাব? হায়রে,আল্লাহ এবার সর্বনাশের চুড়ান্ত হলো। এখন কি করি? 'নোংরা দাঁত'কে ডেকে ধমক দেবো নাকি চুপচাপ হজম করে যাবো '? কিন্তু বাস থেকে নেমে যাওয়া দম্পতির সাথে তো কোনো বাচ্চা’দেখলাম বলে মনে হচ্ছে না। তবে কি? আল্লাহ তুমি রক্ষা করো। আরে পাছার নিচে ও নরম নরম কিছু লাগছে বলে মনে হচ্ছে। খোলস সহ আস্ত তিন চার আলুর সাথে লম্বা লম্বা গোটা কয়েক ভাত। মসল্লার কারনে হলুদ দেখাচ্ছে। তার মানে বমি ? ইচ্ছে হচ্ছে ডান হাতের আঙ্গুল চারটেই কেটে ফেলি। ছি। ছি। হায়রে,কেন যে বসার আগে ভাল করে দেখে বসলাম না। আফসোস। বড়ই আফসোস। তার চেয়ে বেশি ঘেন্না আর অশুচি লাগছে। কি করি , আমি করি ? আচ্ছা, পথে কোথায় নেমে গেলেই তো এই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সাথে তো লুবনার গুছিয়ে দেয়া ব্যাগে' কাপড় টাওয়েল জাস্ট কল মি ম্যাক্সি, কাউবয় পাউডার সবি আছে। আচ্ছা, রাস্তার পাশে কোথায় যেন বিশাল একটা দীঘির মতো পুকুর দেখেছিলাম ? না থাক, বাস থেকে নেমে ই বা আর কি হবে , আবার তো আরেকটা বাসেই চড়তে হবে তার উপর আবার আগামীকাল কাকডাকা ভোরে অফিস- ইপিজেডের চাকুরী বলে কথা। ঠিক তখনি খেয়াল করে দেখলাম আমার সামনের সিটের ভদ্রলোককে কেমন যেন অস্থির লাগছে,ভীষণ অস্থির। একবার বসা থেকে উঠছেন তারপর অল্প দাঁড়িয়ে থেকে আবার বসে যাচ্ছেন। কি হতে পারে ? ঃ আচ্ছা, উনাকে নিম্নচাপে ধরেনিতো ? আমার অনুমান দেখছি একদমই সঠিক। ভদ্রলোকের মাথার পিছনের চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছে ,ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো তিনি মোচড় খাচ্ছেন। ভদ্রলোকের এবার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ঃ এই কন্ট্রাক্টর এদিকে এসো। ঃ বলেন ? ঃ এক্ষুনি গাড়ি থামাতে বলো,টয়লেট সারতে হবে। ঃ কিন্তু পেট্রোল পাম্প তো পিছনে ফেলে এসেছি। ঃ কিছু করার নেই, আগে গাড়ি থামিয়ে আমার নামার ব্যবস্থা নাও। ঃ উঠে আসেন , এক্ষুনি বাস থামাচ্ছি। বাস থেমেছে। সম্ভবত দোহাজারী। আচ্ছা, এই সুযোগে বাস থেকে নেমে পরিষ্কার হয়ে নিলে কেমন হয় ? নামবো কি নামবো না সিদ্ধান্তে যাবার আগেই আনকোরা একজোড়া দম্পতি যাত্রী উঠে এলেন। ব্যস,অন্ততঃ দশ মিনিটের জন্য বাস থেকে নামার রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলো। পুরা আইলটাই দখল করে দম্পতি অতি ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন সাথে বিশাল সব ব্যাগ পুটুলি' আরো কতো কি। কি আর করি, প্রচন্ড ঘেন্না নিয়ে আবারো সেই বিষাক্ত সিটটাতে ফিরে এসে নিজের এই নাজুক অবস্থার জন্য অনুতাপ করা ছাড়া আর কিইবা করার আছেন বলেন? . এই দুঃখের মাঝেও লুবনার একটা কথা মনে আসতেই আবারো হাসি পাচ্ছে। ও' বলে টেরাফিক জাম আর যেই আমি ওকে টেরাফিক লুব' বলে ডাকি সাথে সাথে সে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে কিল ঘুষি শুরু করে অতঃপর চলে অবিরাম। হায়রে প্রাণের লুব,তুমি যদি জানতে আমি এখন কি অবস্থায় আছি। তখনি মনে হলো কেউ একজন আমাকে লক্ষ্য করছেন।চট করে পাশ ফিরতেই দেখি ডায়রিয়া রোগীর মতো খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির বর্ণহীন এক বুড়ো গভীর আগ্রহ নিয়ে আমায় দেখছেন। আরে হারামি আমি কি চিড়িয়াখানার মাল নাকি, এমন করে কি দেখছিস ? সিটের ডানপাশের আইলে ছোট বড় কয়েকটা ব্যাগ আর খুচরা পুটুলি। বড় পেটুক একটা পলিথিন প্যাকেট একদিকে হেলে ঝুকে আছে। হাবড়ার পায়ে নিচে দেখছি দুই দুইটা জ্যান্ত মোরগ- মুরগী প্রাণভয়ে কেমন যেন নীরব হয়ে গেছে। এতক্ষন যা আশংকা করেছিলাম এবার মনে হয় ঠিক তাই হতে চলেছে। চোখাচোখি হতেই বুড়া মিঞা আলাপ জুড়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে- ঐ বয়সীরা প্রায় সবাই মনে প্রাণে পাকিস্তান লালন করেন, সুযোগ পেলেই তুলনামূলক আলোচনা করতে ছাড়েন না। ঐ আমলে হেন হতো, তেন হতো, যতো সব আজগুবি মসল্লা দিয়ে সালুন রান্না। ঃ ভাই বুঝছেন এই সব গাড়িগুলো হচ্ছে এক একটা বদের হাড্ডি। চেয়ারকোচ না ছাই স্রেফ কিছু বল্লি।জোহরের নামাজের পর পর চকরিয়া থেকে উঠেছি, টাউনে পৌঁছতে পৌঁছতে মনে হয় এশারের সময় ও পেরিয়ে যাবে। আমি কেবল নীরব শ্রোতার মতো শুনে যাচ্ছি আর মনে মনে আল্লাহর কাছে বিপদ মুক্তির জন্য আপদকালীন দোয়া জপছি। ঃ ভাই বুঝছেন' মেয়ের বাড়িতে যাচ্ছি- মদুনাঘাট ছিদ্দিক বাড়ি। আপনার ভাবি কন্যার জন্য ভাতের মোচা, কিছু বিন্নী চাল, এক বোতল চুনতির মধু,পুকুরের রুই, ঘড়ায় তোলা মহিষের দই আর গলদা চিংড়ি ফ্রাই দিয়েছেন। বুঝেন তো মায়ের মন। হঠাৎ বিশ্রী শব্দ করে ক্যাসেট প্লেয়ারে ফকিরনি মমতাজের গান চালু হলো- 'এবার না আসিলে বাড়িতে আগুন লাগাইয়া দিমু আমার শাড়িতে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এবার বুড়া ভামটা চিল্লাতে শুরু করেছে। ঃ এই কন্ট্রাক্টর গান বন্ধ করো, এখন মাগরিবের টাইম। এরপর জানিনা কেন, হঠাৎ করে আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। হতে পারে খোলা জানালায় সদ্য সন্ধ্যার ঠান্ডা বাতাস, সারাদিনের ক্লান্তি চমক অথবা অবশেষে রণেভঙ্গ -পরাজিত সৈনিকের মতো অবসাদ ঘিরেছে আমায়। আর যখন জেগে উঠেছি তখন প্রচুর লোকের চেঁচামেচি আর গাড়ির সেই নোংরা ময়লা দাঁতের কন্ট্রাক্টারের সদর্প ঘোষণা - যাত্ৰী সকল আমরা বহর্দ্দার হাট এসে গেছি আপনারা এবার নামেন। শরীরের সাথে কঠিন ভাবে লেগে থাকা জঘন্য বমি আর রাজ্যের ধূলো সব নিয়ে আস্তে আস্তে গাড়ির দরজার দিকে হাঁটা দিচ্ছি ঠিক তখনি সেই কর্কশ কণ্ঠটা কানে এলো- জনাব কিছু ফেলে গেলেন কি ? ধন্যবাদ আবার আসবেন। বলতে ইচ্ছে হলো- এ নিশানে খাজা' নয় , নিশানে বদ। এই জন্মে আর কখনো এই বাসে চড়বো না। অনেক শিক্ষা হয়েছে আজ,যদি পারি একটা জনসভা করে সবাইকে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করবো। খোদা হাফেজ।
Make sure you enter the(*)required information