গত ১ জানুয়ারী দৈনিক পূর্বকোণে প্রথম পৃষ্টায় একটি খবর আমার দৃষ্টিতে পড়ে। আর তা হল-৮১ বছর পর বন্ধ হয়ে গেল বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার।দৈনিক পূর্বকোণ থেকে আরও জানা যায়, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ব্যাপক পরিবর্তনের পটভূমিতে বিবিসি বাংলার রেডিও বন্ধের এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস কর্তৃপক্ষ বাংলায় রেডিও সম্প্রচার বন্ধ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। অর্থাৎ বিবিসি বাংলার নিজস্ব ওয়েব সাইট, ইউটিউব চ্যানেল, ফেইজবুক পেইজ এবং টুইটার ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়েছে।উল্লেখ্য ২য় বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিকালে মিত্রপক্ষের বক্তব্য ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর একটি সাপ্তাহিক নিউজ লেটার দিয়ে শুরু হয়েছিল বিবিসি বাংলার রেডিও যাত্রা। এদিকে বাংলাদেশের মাঝে বিবিসি নামটি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময়। বিবিসির খবরে শ্রোতাদের আস্থা আর বিবিসি বাংলা রেডিওর জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় ওই সময়। মানুষ তখন যুদ্ধের খবরের জন্য পুরোপুরি নির্ভর করত বিবিসি বাংলার ওপর। বিগত আট দশকে বিবিসি বাংলার রেডিও অনুষ্ঠানমালা এবং ব্যবস্থাপনা বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। রেডিওর চূড়ান্ত সম্প্রসারণ ঘটে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে যখন চতুর্থ একটি দৈনিক অধিবেশন শুরু করা হয়। তার চার বছরের মাথায় সকালের দুটি রেডিও অধিবেশন লন্ডন থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয় এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিবিসি বাংলার সাংবাদিক সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটে। তবে রেডিওর শ্রোতা কমে যাওয়ায় বিবিসি বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। চ্যানেল আই-এর সহযোগিতায় বিবিসি প্রবাহ নামক সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান নিয়ে ২০১৫ সালে বিবিসি বাংলা বাংলাদেশের টেলিভিশন জগতে প্রবেশ করে। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে রেডিও শ্রোতা সংখ্যা ক্রমশ কমে এসেছে, বিশেষ করে সংবাদ এবং সামাজিক প্রসঙ্গের ক্ষেত্রে। বিবিসির গবেষণায় দেখা গেছে বিভিন্ন দেশে মানুষ সংবাদের চাহিদা মেটানোর জন্য টেলিভিশন এবং ডিজিটাল মাধ্যমকে বেছে নিচ্ছেন।বিবিসি বাংলা রেডিও ঘিরে অনেক স্মৃতি, অনেক আবেগ রয়েছে। কিন্তু যারা সংবাদের প্রতি আগ্রহী, তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য বিবিসি রেডিও বন্ধ করার মত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাস্তবতার আলোকে বিবিসি বাংলা রেডিও বন্ধ করে লোকবল ডিজিটাল মাধ্যমে নিয়োজিত করতেই এই সিদ্ধান্ত।আমাদের দেশে এককালে বিবিসি বাংলা রেডিওর খবরাখবর অত্যধিক জনপ্রিয় ছিল। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে মুত্তিযদ্ধের সময় বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান এত বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠে, জনগণ সন্ধ্যায় বিবিসির খবর শুনতে যার নিকট রেডিও আছে তার নিকট জড়ো হতে থাকে। চাই কারও ঘরে হউক, বা দোকানে হউক।যতটুকু মনে পড়ে সন্ধ্যা ৭ টা ৩০ মিনিটে বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠান ছিল। তৎমধ্যে অনুষ্ঠানের শুরুতে খবর বাকী ৫/৭ মিনিট পর্যালোচনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় মাত্র ১৫ মিনিটের বাংলা অনুষ্ঠান হওয়ায় শ্রোতাদের মাঝে অতৃপ্তি থেকে যায়। এখানে বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠান বলতে রেডিওকে বুঝানো হয়েছে।দেশে ১৯৮০ দশক পর্যন্ত বেসরকারী টেলিভিশন ত নয়ই বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ব্যাপক প্রচার লাভ করেনি। অপরদিকে যোগাযোগ প্রতিকূলতায় শহর থেকে দূর দূরান্তের গ্রামাঞ্চলে সংবাদপত্র পৌঁছা সহজ ছিল না। ফলে সংবাদের জন্য রেডিও ছিল একমাত্র ভরশা। ঐ সময় মানুষের ব্যয় ও চাহিদা সীমিত থাকার কারণে রেডিও ব্যাপকতা ছিল বলা যাবে না। গ্রামের বড় বাজারে ৩/৪টি বা ৫/৭টি রেডিও থাকত চায়ের দোকান বা অন্যান্য দোকানে। সৌখিন, আর্থিক সচ্ছল বা সংবাদ পেতে আগহীদের অনেকের মাঝে রেডিও ছিল।যতটুকু মনে পড়ে ১৯৬০ সালে ৩১ অক্টোবর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের কারণে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রেডিও সরবরাহ করে।১৯৬০ এর দশকে এক ব্যান্ডের রেডিও অনেকটা সহজলভ্য ছিল। এই রেডিওতে বাংলাদেশের পাশাপাশি হয়ত কলকাতা গুহাঠি শুনা যেত। কিন্তু দূর দূরান্তের খবর পেতে ২,৩ ও ৪ বেন্ডের রেডিও পাওয়া যেত। এইসব রেডিওর দাম ছিল কিছুটা বেশি।রেডিও ছোট বড় নানান আকৃতির ছিল। ৩ ব্যান্ডের ফিলিপস ও স্ট্যান্ডার্ট রেডিও জনপ্রিয় ছিল। ৩ বেন্ডের দুই ক্যাটাগরির এ রেডিওর দাম কিছুটা বেশি। চামড়ার কভারে অনেকটা ছোট আকৃতির স্ট্যান্ডার্ট রেডিওর দাম ছিল ২৫০/৩০০ টাকার মধ্যে। অপরদিকে, আরেকটু বড় সাইজের ফিলিপস রেডিও দাম ছিল ৪০০/৫০০ টাকা বা কম বেশি। এই সব রেডিও টর্চ লাইটের ১-৩ টা ব্যাটারী দিয়ে চালানো হত।১৯৫০ এর দশকে আমাদের বাঁশখালী গ্রামের বাড়ীতে কম করে হলেও দেড় ফুট/দুই ফুট আকৃতির বড় রেডিও ছিল। অনুষ্ঠান পরিষ্কার শুনতে পারার জন্য কাচারী ঘরের চালের উপর প্রায় ৩০/৪০ ফুট দূরত্বে লম্বা দুইটি বাঁশ দিয়ে এ্যান্টেনা লাগানো থাকত। এই রেডিও চলত মাইক চালানোর বড় ব্যাটারী দিয়ে, যা রেডিওর পাশে থাকত।১৯৫০ এর দশকে রেডিওর গুরুত্ব ছিল দেশ বিদেশের খবরা খবরের লক্ষে। এখনকার মত টকশো ত নয়ই নাটক, গান বাজনাও মনে হয় না তেমন জনপ্রিয় ছিল।পাকিস্তান আমলের শেষের দিকেও রেডিওর মাধ্যমে বিবিসি বাংলার পাশাপাশি আমেরিকা ওয়াশিংটন থেকে ভয়েস অব আমেরিকা, চায়না থেকে রেডিও পিকিং, সাথে সাথে জার্মানী, ফিলিপাইন, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কো থেকেও রেডিও থেকে বাংলা অনুষ্ঠান প্রচার করত। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে বাংলা অনুষ্ঠান সহজে শুনা যেত।আমাদের বাঁশখালী গ্রামের বড় বাড়ীর প্রায় সকলে রেডিওটি কাছে পেতে আগ্রহী ছিল। এতে বিরক্ত হয়ে টাকা জোগাড় করে ১৯৭০ সালের শেষের দিকে বা ১৯৭১ সালের প্রথম দিকে ৩ বেন্ডের একটি স্ট্যান্ডার্ট রেডিও ক্রয় করি। দাম পড়েছিল ২৫০ টাকা বা তার কম বেশি।১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমার কক্ষে বাড়ীর লোকজনের ভিড় হত সন্ধ্যায় বিবিসি বাংলার খবর শুনতে। তখন পোস্ট অফিসের মাধ্যমে রেডিও লাইসেন্স বাৎসরিক নবায়ন করতে হত। আমারও ফাইলে লাইসেন্স নবায়নের কপিগুলো অনেক বছর ছিল। পরবর্তীতে রেডিওর ক্ষেত্রে লাইন্সেস করা, নবায়ন ইত্যাদি উঠিয়ে দেয়া হয়। রেডিও ব্যবহার করতে সরকার থেকে লাইসেন্স নিতে হত।১৯৯৫ সালে কয়েক মাসের জন্য আমেরিকা কানাডা, লন্ডন যাওয়া হয়। সপ্তাহখানেকের জন্য লন্ডন অবস্থানকালে বিবিসির প্রধান কার্যালয়ে যাওয়া হয়। এখানে বাংলা বিভাগে গমন করলে ভারি গলার জনাব নুরুল ইসলামের সাথে দেখা হয়। তার নাম ও কণ্ঠ বিবিসি বাংলা রেডিওর মাধ্যমে দীর্ঘদিন শুনে আসছিলাম। অবশেষে সামনাসামনি দেখা হল।বস্তুতঃ ১৯৯০ এর দশক থেকে টেলিভিশন ব্যাপকতা লাভ করতে থাকে। ১০/২০ বছরের ব্যবধানে মোবাইলের আবিষ্কার পরবর্তীতে স্মাট ফোন চালু হলে ছবির মাধ্যমে ইলেকট্রনিক মিডিয়া মানুষের হাতের নাগালে চলে আসে। ফলে ঘরের বাহিরে থাকলে মোবাইলের মাধ্যমে,ঘরে আসলে টেলিভিশনের মাধ্যমে খবরা খরব দেখাটা অনেকটা সহজতর হয়ে যায়। ফলে সাধারণ নিয়মে রেডিওর গুরুত্ব কমে যায়।তারপরও করে রেডিও শতভাগ উঠে যাবে তা সময়ই বলে দিবে। যেহেতু এখনও গাড়িতে, নৌকা সাম্পানে রেডিওর প্রচলন রয়েছে।ক্যাপশন: ১৯৬০ এর দশকে রেডিওসুত্র ঃ সোমবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ দৈনিক পূর্বকোণ
Make sure you enter the(*)required information