ধাবমান জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার একটা উত্তম উপায় হল এর টুকরো টুকরো ভালো লাগা সুখের মুহূর্তগুলো একটা একটা করে সঞ্চয় করতে থাকা। এটা আমার জীবনের ভালো লাগা একটা দর্শন, যা আমি মেনে চলার চেষ্টা করি। আমার সেই সুখ সঞ্চয়ের মাটির ব্যাংকটিতে এক টুকরো সোনার রঙয়ের আধুলী হয়ে প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে স্কুল জীবনে কাটানো মায়াবী দিনগুলি। মধুর সেই সময়টার কথা মনে পড়লে এক অদ্ভুত ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই। অভাবনীয় এক পুলক অনুভূতির মায়াজালে কোথায় যেন আমি হারিয়ে যাই। যে জীবনের পরতে পরতে এতো মায়াজাল বিছানো, তাকে নিয়ে চিন্তা করতে গেলে মনে হয় কোনটি রেখে কোনটি আগে বলি। ভাবনার জগতের নিউরনগুলো তিরতির করে কাঁপে, তৈরি হয় প্রেক্ষাপট। থোকা থোকা স্মৃতির পুতিগুলো দিয়ে অহর্নিশ মালা গেঁথে চলি। হারানো দিনের তুলির আঁচড় দিয়ে সাজানো আকাশে স্মৃতির ঘুড়ি ওড়াই, নাটাইয়ের সুতো ছিঁড়ে গিয়ে উড়তে থাকে ঘুড়ি দিগ্বিদিক। মনে হয় সেই কাজল দিঘীর জলে সাঁতার কেটে বেড়ানোর মতো অপার্থিব সুখ বুঝি আর কিছু নেই এই পৃথিবীতে।মায়া মাখানো সে দিনগুলো সত্যিই ছুঁয়ে গেছে মনটাকে। বিস্ময়কর কিছু মুহূর্ত অমর করে দিয়েছে কিছু সুর্যোদয়, সূর্যাস্ত কিংবা সাঁঝের বেলা। একটু ফিরে তাকালেই স্পষ্ট যেনো দেখতে পাই সবকিছু। স্মৃতি বড়ই মায়াবী এক অনুভূতির নাম। স্কুল জীবনের সেই সরলতা আর অবারিত মুগ্ধতা মাখা মুহূর্তগুলোর অস্তিত্ব এখনও খুব টের পাই প্রতিটি নিঃশ্বাসে। আপন সত্ত্বায় যেনো মিশে আছে লাল মাটির অত্যুচ্চ টিলার উপরে অবস্থিত স্কুলটির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিটি কণা। ঠিক কোন তারিখটিতে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম মনে নেই। ১৯৯০ সালের কোনো একটি দিন হয়তো হবে সেটা। অনুভূতির রাজ্যে সেদিন মৃদু কম্পন “আমি এখন হাই স্কুলের ছাত্র, হুমম...”।আর পায় কে। দুরন্ত দিনের যেন হল শুরু। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই বন্ধুর ছড়াছড়ি আর পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মায়াভরা শাসন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৫, জীবনের এক মধুর সময় পার করেছি এখানে। সেই লাল পাহাড়ের দেশে, যেখানে গেলে আজও জীবন ফিরে পাই, পাই প্রানসুধা। প্রধান শিক্ষক বাবু জয়দত্ত বড়ুয়া ছিলেন আমাদের স্কুলের অভিবাবক। আগাগোড়া একজন আদর্শ শিক্ষক। যেমন জ্ঞানের সাগর, তেমনই অভিজাত তাঁর চাল চলন। চোখ ধাঁধানো ব্যক্তিত্বের আলোকচ্ছটা যেনো ঠিকরে বেরোয় স্যারের দুচোখ দিয়ে। কি অপূর্ব স্যারের ক্লাসগুলো, এখনও ভুলতে পারিনা। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্যার যখন বক্তব্য রাখতেন, পিনপতন নিরবতার মাঝখানে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতেন সমস্ত শ্রোতারা। তিনিই এই স্কুলের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়কাল ধরে (২৭ বছরেরও বেশি) অত্যন্ত সুনামের সাথে প্রধান শিক্ষকের গুরুদায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিত্ব। স্যারের ব্যপারে যাই বলিনা কেনো কম বলা হবে। বস্তুত উনাকে সঠিকভাবে তূলে ধরা আমার মতো নগণ্য একজনের পক্ষে অসম্ভব। উনার সাথে তখন সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে ছিলেন শ্রদ্ধেয় মমশাদর রহমান (আলো) স্যার, আমার পরম শ্রদ্ধেয় নানা ভাই, যিনি আমাদেরকে অংকের তালিম দিতেন। শ্রদ্ধেয় আখতার হোসাইন সিদ্দিকী স্যার (প্রয়াত), নূর আহমদ স্যার (প্রয়াত), সিরাজুল ইসলাম স্যার, অসীম স্যার (বর্তমান সহকারী প্রধান শিক্ষক), হামিদ স্যার, মোহাম্মদ হোসাইন (মধু) স্যার (প্রয়াত), প্রিয়দর্শী স্যার, মাটির মানুষ প্রিয় জমির স্যার (প্রয়াত), কনক স্যার। নামগুলো উচ্চারণের সাথে সাথে কেমন যেনো এক অদ্ভুত ভালো লাগায় প্রিয় স্যারদের মুখগুলো ভেসে উঠছিল স্মৃতির মানসপটে।একদিন আমাদের দুরন্তপনায় মুখর হয়ে থাকতো যে আঙ্গিনা, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে আজ চোখ ভিজে আসে আবেগের নোনা জলে। বারংবার শুধু মনে পড়ে পিতৃপ্রতিম স্যারদের কথা, আমাদের জীবনের প্রদীপ যারা নিজ হাতে জ্বেলে দিয়ে গেছেন। যাদের আদরের চাঁদরে সর্বক্ষণ আমরা ঢাকা থাকতাম। যে পরশপাথর সম গুরুজনেরা হাতে ধরে ধরে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কিভাবে চলতে হবে জীবন চলার পথে। ভালো আর মন্দের দোলাচলে কিভাবে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে।সেই মহান ব্যক্তিত্বদের কেউ কেউ আমাদের মাথার মুকুট হয়ে এখনও জ্ঞানের মশাল হাতে নিয়োজিত রয়েছেন শিক্ষকতার মহান পেশায়। আবার কেউ কেউ জীবনের ইতি টেনে পাড়ি দিয়েছেন ওপারে। যাদেরকে আমরা হারিয়েছি, কে জানে হয়তো স্বর্গের ওপার হতে তাঁদের দোয়া আর আশীর্বাদের অবারিত দৃষ্টি এখনো নিপতিত রয়েছে এই মাঠে, এই স্কুলের প্রতিটি দেয়ালে, এবং আমাদের সকল বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের উপরে। উনাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। স্কুল ক্যাম্পাসে গেলে স্মৃতি কাতরতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই। কতো কথা, কতো গান, দুঃখ সুখের কতো মধুরিমা যেনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এখানে সেখানে। মনে পড়ে প্রিয় বন্ধু জসীমকে হারিয়েছিলাম ক্লাস টেন এ পড়াকালীন সময়ে। সেদিন স্কুল খোলা ছিলো। অন্যান্য দিনের মতো সবুজ জামা গায়ে চাপিয়ে জসীম বাকি সবার মতোই স্কুলে আসার জন্যে রেডি হচ্ছিল। কিন্তু নিয়তির এক নির্মম পরিহাসে বাড়ী থেকে বের হওয়ার অব্যবহিত পূর্ব মুহূর্তে কারেন্টের শকে বিদ্যুতায়িত হয়ে জসীম মারা যায়। শ্রেণী শিক্ষক শ্রদ্ধেয় নূর আহমদ স্যার ক্লাসে ঢুকে রোল কল করছিলেন। জসীমের রোল কল হয়, কিন্তু কেউ সাড়া দেয়না। স্বজন হারানোর বেদনায় স্যার সহ ক্লাস ভর্তি সবাই বুক ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি আমরা। জসীমের অকাল প্রয়াণের হৃদয় তোলপাড় করা সেই স্মৃতি আজও আমাদেরকে তুমুলভাবে নাড়া দেয়। বন্ধু, তুই আছিস, থাকবি চিরদিন, তোকে আমরা ভুলবনা কখনও। কারণ সে এক চিরন্তন নাড়ীর বন্ধনে আমরা একাত্মা ছিলাম। কিছু অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করে মন ভরেনা কখনও। মনে হয় যেন বোঝাতে পারছিনা যা বোঝাতে চাচ্ছি। অতৃপ্তি কাজ করে মনের ভিতরে।তারপরও সেই অনুভুতিগুলো চিরন্তন। মলিনতা তাতে রেখাপাত আঁকতে পারেনা কখনও।ছেলেবেলার ঘাসফড়িং এর পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে এক অপার্থিব সুখের নগরে যেনো গিয়ে পৌঁছাই। দুরন্ত দিনের সেই স্কুল পালানো, করম আলীর দোকানের পিঁয়াজু, স্কুল পাহাড়ের কাঁঠাল চুরি করে খাওয়া, মায়ের ধমকের ভয় মাথায় নিয়ে দুপুরের তপ্ত রোদে ঘুরে বেড়ানো। এ সবই যত্নে মাখা কোমল স্পর্স্বে ফোঁটা ভালোবাসার একেকটি পুস্পকলি, একেক টুকরো প্রেম হয়ে যারা তিরতির করে কেঁপেছে হাওয়ার দোলায়। স্বর্গের দুয়েকটা টুকরো বুঝি মর্তেও পড়েছে এসে। এই টুকরোগুলোর নাম ভালোবাসা। এই টুকরোগুলোর নাম প্রেম।স্কুল জীবনের মায়াভরা সেই আনন্দলোক এখনও স্মৃতির এক সুবিশাল বেলাভূমি হয়ে আমাকে আহবান করে। আমি তাতে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াই ইচ্ছেমত এপার হতে ওপার। যখন খুশি তখন পা ভেজাই। রাশি রাশি স্মৃতিগুলো একেকটি ফেনীল ঢেউ হয়ে আছড়ে আছড়ে পড়ে।জীবনের চেয়ে সুন্দর কোন গল্পের নাম আমি শুনতে পাইনি আজও, জানতেও চাইনি। কতো শত ভুল তাতে নিয়ত। তারপরও দিনশেষে কি তুমুল মোহনীয় মায়াবী অলংকার পরা অপরূপা এক ষোড়ষী উর্বশী সে। কতো হাজারো উৎসব দেখেছি, সাদা মনের মানুষদের সান্নিধ্য পেয়েছি। জীবন পাড়ার অলিতে গলিতে এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো থোকা থোকা সব মায়ার দুনিয়াটা বরাবরই সুখের অবারিত এক সরোবর হয়ে এসেছে আমার কাছে।আমি তাতে ঝাঁপ দিয়েছি,সাতার কেটে গেছি এপার হতে ওপার,কলসি ভরে ঘরে তুলে নিয়েছি জীবনের যত রসদ বেঁচে থাকার'বেঁচে থাকা', কি অপূর্ব সুন্দর এক গল্পের নাম..!!!সেই দিনগুলোর দিনপঞ্জি ছিলো রূপকথার গল্পের মতো সুন্দর মনোরম। সুখের যত প্রফুল্লতা সাদা শিউলী হয়ে ঝরে ঝরে পড়েছে এখানে সেখানে। কুড়িয়ে নেওয়া, কুড়িয়ে পাওয়া এমন হাজারো সুন্দরের অলংকার আমার ছেলেবেলার সারাটা গা জুড়ে।আহারে সুখ.!!কেন যে তুই শুধুই শৈশব হয়ে থাকিস ?একদিন বৃষ্টির দিন ছিলো। তুমুল বর্ষণে ধোয়া পূবের সবুজ বিলটাকে দেখে সেদিন সদ্য স্নান সেরে আসা প্রিয়তার ভেজা চুল বেয়ে টুপ করে গড়িয়ে পড়া এক ফোঁটা স্নিগ্ধ জলের মতো শুভ্র মনে হয়েছিল। মন মাতানো এক মুগ্ধতায় কোথায় যেনো হারিয়ে গিয়েছিলাম। সেই অনুভূতিটাকে আমি শব্দে শব্দে ধরে রাখতে চেয়েছি প্রাণান্ত। পারিনি। বুঝেছি জীবনের কিছু কিছু অনুভুতিকে শব্দে বাঁধা যায়না, কেবল উপলব্ধি করা যায়। আরেকদিন এক ক্লান্ত বিকেলে সোনাইছড়ি খাল পেরিয়ে দক্ষিন বিলের মাঝধার দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে কোথায় যেনো চলে গিয়েছিলাম। সেখানে পথের ধারের মাচান বেয়ে ঝুলে থাকা গুল্মলতার মাঝে ছোট্ট একটা ঝিঙেফুল মৃদু বাতাসে কেঁপে উঠেছিলো তিরতির করে। অনন্যসুন্দর সেই ফুলটাকে দেখে মনে হয়েছিলো বুঝি এক টুকরো জীবন। সেই মনোহর অনুভূতি এখনো আমার ভাবনার আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ায় পরিযায়ী পাখির মতোন। যাপিত জীবনের যে মধুর সময়টি আজ আমার এই লেখার মূল উপজীব্য, সেই ভালো লাগার দিনগুলো দু হাতের আঙ্গুল গলিয়ে কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে। যা কিছু আজ অবশিষ্ট আছে, তা কেবল কিছু মায়ায় ভরা স্মৃতিচিহ্ন। তবু যেটুকুই আজ মনে আছে, সেটুকুই আমার সুখ। এদেরকে যদি লিখে না রাখি, তবে কিছুইতো আর থাকবেনা বাকি। আমার বিশ্বাস প্রত্যাক প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীই আমার মতো এই একই অনুভূতি পোষণ করেন, হৃদয়ে ধারণ করেন প্রিয় স্কুলকে। আর তাই স্কুলের “হীরক জয়ন্তী উৎসব ২০১৯” উদযাপন নিয়ে চারপাশে অ্যাজ এতো আনন্দ, এতো উচ্ছ্বাস, এতো মাতামাতি। আমরা সবাই যেনো শিশু হয়ে গেছি, ফিরে গেছি সেই নানান রঙয়ের দিনগুলোতে, যেখানে লুকিয়ে আছে ফেলে আসা মধুর জীবনের স্মৃতি।প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী সমিতি আজ আমাদের সবাইকে সুযোগ করে দিয়েছে আবার একাত্ম হওয়ার। সত্যি হতে চলেছে সুদীর্ঘ কালের স্বপ্ন। আবার দেখা হবে, কথা হবে। কতো কথা না বলা রয়ে গেছে, কতদিন দেখিনা প্রিয় মুখগুলো। স্মৃতির জানালা দিয়ে কেবল দুরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি এতোদিন। আমরা আবার মিলিত হবো, হাতে হাত ধরে ঘুরে বেড়াবো প্রাণের ক্যাম্পাসে। আগামীর দিনগুলোতে আরও বেগবান হবে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী সমিতির কার্যক্রম, আমরা প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীদের সুখে দুঃখে পাশে এসে দাঁড়াবো, স্কুলের জন্য কল্যাণকর কাজে ভূমিকা রাখবো, এই হোক আমাদের আগামীদিনের শপথ।জীবনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে কতো শত মুগ্ধতা, কতো শত ভালোলাগা!! আহা !! ‘শৈশব’ আসলেই এক মায়াবি রূপকথার নাম ...........যেমন একটি কবিতার নাম.."সোনাই ছড়ির পাড়" সোনাই ছড়ির পাড়সবুজ বাঁশের ঝাড়কি অপরূপ চলেগল্প বলে বলেছবির পরে ছবিকোথায় গিয়ে রবি?সোনার রং এর ধানজুড়ায়ে যেতো প্রাণখেলাঘরের খেলাফুরিয়ে গেছে বেলানাটাই ঘুড়ির আকাশশুভ্র শ্যামল বাতাসছেলেবেলার স্মৃতিমায়ায় ভরা গীতিআজও কথা বলেময়ূর পেখম মেলেসবার জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, আমাদের গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট খালটির নাম‘সোনাই ছড়ি’।পুনশ্চ : কোন একদিন আচমকা সোনাই ছড়ির পাড় বেয়ে ফিরে আসে যদি আমার ছেলেবেলা, হাত দুটি জাপটে ধরে বলে যদি "যাবে তুমি আমার সাথে?"আমি নির্দ্বিধায় চলে যাবো...।
Make sure you enter the(*)required information