১। চুনতির ভৌগোলিক অবস্থান দক্ষিণ চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্যময়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সুবিশাল পাহাড়শ্রেণী চুনতির মধ্য দিয়ে বাঁশখালীর উপ পাহাড় শ্রেণীর সাথে মিলিত হয়েছে। এ হিসাবে চুনতি একটি করিডোর, যার মধ্য দিয়ে আরাকান সড়ক বয়ে গিয়েছে। ফলে জনপদ হিসেবে চুনতি যেমন শত শত বৎসর যাবত পরিচিত ছিল, তেমনি সংলগ্ন বিস্তৃত জঙ্গল অঞ্চলটিকে মিশ্র পরিবেশ দান করেছে। এ কারণে এ জনপদে যুগে যুগে তৈরি হয়েছে বংশপরম্পরায় শ্রুত বাস্তব-কল্পনা মিশ্রিত কাহিনী, যেগুলোর বেশিরভাগই অতিপ্রাকৃত/অতিন্দ্রীয় ভাব নির্ভর, ধর্মীয় আবেগ সমৃদ্ধ এবং কিছু কিছু ভালোবাসার কাহিনী সমৃদ্ধ। বলা হয়ে থাকে, চুনতি'র মত এত বিস্তৃত পারিবারিক সম্পর্ক অন্য কোথাও নেই। এ অঞ্চলের লোকজন একাধারে শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনষ্ক, কৌতুহলী, উৎসাহী, আবেগী/ভাবূক এবং ভালোবাসা ধারণে কিংবা ভালোবাসার বিনিময়ে অত্যন্ত উদার ও আবেগি।২। চুনতি পাহাড়িয়া অঞ্চল হওয়া সত্বেও প্রাচীনকালের গুরুত্বপূর্ণ 'লাইফ লাইন' আরাকান সড়কের উপর অবস্থিত হওয়ায় সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। গ্রামবাসীর শিক্ষানুরাগের কারণে এখানে ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার চর্চা গড়ে উঠে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম বড় ঐতিহাসিক চুনতি কবরস্থানে শায়িত মুরুব্বিদের 'এপিটাফ' গুলো পড়লে গৌরবোজ্জ্বল গাথা খুঁজে পাওয়া যায়, যা দিয়ে অনায়াসে একটি বই লিখে ফেলা যাবে। চট্টগ্রাম ও দেশের বিভিন্ন স্থান হতে এত সংখ্যক লোক উক্ত মরহুম মুরুব্বিদের কবর জিয়ারত করতে আসেন, যা বোধহয় দেশের অন্যান্য স্থানে বিরল। সর্বোপরি আমাদের গ্রামটি পীর-আউলিয়া ও বুজুর্গ মুরুব্বিদের আস্তানা ছিল, হযরত শাহ সাহেব কেবলা (রা:) যাদের মধ্যে অন্যতম (আরো অনেক বিখ্যাত বুজুর্গ রয়েছেন, যারা নিজেদের কর্ম গুনে স্মরনীয়)। ধারণা করা হয়, এ ধরনের বুজুর্গ ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে থাকার অভিপ্রায়ে এ অঞ্চলে জ্বীন জাতিরও পাশাপাশি অবস্থান ছিল কিংবা এখনো আছে। বলে রাখা ভালো, মানবজাতির উপর জ্বীন জাতির হিতকর/ক্ষতিকর উভয় ধরনের প্রভাব পড়ে। এ নিয়ে মুরুব্বিদের মুখে শোনা কয়েকটি গল্প আজ দিলাম -ক। স্থানীয় বনপুকুর (ব'না ফৈর) এলাকায় ওলিয়ার মসজিদ অবস্থিত যা এলাকার ভাষায় 'গরম' ধর্মীয় স্থাপনা। এখানে যে কেউ কসম কাটলে তা ফলে যায়, এমন গুজব প্রচলিত আছে।খ। একই জায়গায় আরাকান সড়কের পাশে একটি মাজার অবস্থিত। মাজারের আশেপাশে, আরাকান সড়ক এলাকায় প্রায়ই গাড়ি দুর্ঘটনার খবর শোনা যায়। গুজব আছে ড্রাইভাররা নাকি এখানে কয়েকটি রাস্তা দেখতে পায় এবং বিভ্রান্ত হয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। জ্বিনের কারসাজিতে এরূপ ঘটনা ঘটে থাকে বলে অনেকে মনে করে।গ। চুনতি গ্রামের মূল প্রবেশ পথ দুটি, হাজির রাস্তা ও শাহ্ সাহেব গেট। সেকালে হাজির রাস্তা দিয়ে বেশি যাতায়াত হত। হাজির রাস্তা দিয়ে মুন্সেফ বাজার আসার পথে দুটি ছোট কালভার্ট আছে (একটি 'উট্যাক্যা পুল' ও আরেকটি রেলিং ছাড়া পুল)। বাবার মুখে একটি গল্প শুনতাম, '৬০, '৭০ এর দশকে তিনি মাঝেমধ্যে বদরখালী অথবা চট্টগ্রাম শহর হতে রাতে বাড়ি আসতেন। এমনই এক রাতে তিনি হাজির রাস্তার মাথায় গাড়ি হতে নেমে পায়ে হেঁটে আমাদের বাড়ি (মুন্সেফ বাজারের পাশে সিকদার পাড়া) যাচ্ছিলেন। 'উট্যাক্যা পুল' পার হয়ে রেলিং ছাড়া পুলটির কাছে আসতেই দেখলেন পুলের উপর একটি মৃত মানুষসহ খাটিয়া আড়াআড়ি শোয়ানো। ভয় পেলেও তিনি সাহস হারাননি, কয়েকবার চোখ বন্ধ করে সূরা পড়তে পড়তে তিনি হাঁটতে লাগলেন। এক পর্যায়ে দেখলেন কোথাও কিছুই নেই। আরেকবার তিনি ওই এলাকায় রাতের বেলা একটি ঘোড়া দেখেছিলেন, যা বাবার সামনে থেকে এক এক সময় কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি রূপ নিয়ে হাঁটছিল। এ সময়ও বাবা সাহস রেখে জোরে জোরে সূরা পড়ে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছেন।ঘ। উক্ত 'উট্যাক্যা পুল' পার হয়ে আসলে, নোয়াপাড়া ও মিয়াঁজিপাড়ার মাঝামাঝি স্থানে পশ্চিম পাশে একটি মসজিদ আছে। এখানে রাতে অনেকের এক সাথে কোরআন শরীফ পড়ার আওয়াজ শোনা যায়। জনশ্রুতি আছে, জ্বিনেরা এখানে এবাদত করে থাকে।ঙ। মুন্সেফপাড়া ছোট মসজিদটির পাশে পুকুর পাড়ে কয়েকটি তাল গাছ রয়েছে। এখানে সময়-অসময়ে বিভিন্ন অদ্ভুত জিনিস দেখা যেত বলে মুরুব্বিরা বলে থাকেন।চ। অনেক বৎসর আগে আঞ্জুমান মাঠে যাওয়ার পথে রাতার ছরায় খালের উপর একটি সাকো ছিল। তখন এ পথে লোকজনের যাতায়াত খুবই কম ছিল। এখানে খালটি দক্ষিন অংশে দু'টি স্রোতে বিভাজিত হয়েছে। ত্রিমুখী খালের এ অংশটি রিতিমত ভয়ানক ছিল। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে অথবা অনেক সময় নির্জন দুপুরেও এখানে লোকজন অস্বাভাবিক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে। অনেকেই এখানে বিভিন্ন জীব-জন্তু রূপ পরিবর্তন করে চলাফেরা করতে দেখেছে। রাতে এখানে যেন দৈত্য-দানব যুদ্ধ করছে এমন ঝড় বয়ে যেত।ছ। আমাদের বাড়িটি মুন্সেফ বাজারের কাছে সিকদার পাড়ায় (তেস্যারগা পুকুর পাড়ে) অবস্থিত। তখন গ্ৰামে বিদ্যুৎ ছিলো না। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই সবাই খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতো। আনুমানিক ১৯৬৭/৬৮ সালে আম্মা (বাবা চাকুরীর সূত্রে চট্টগ্রাম শহরে থাকতেন), সন্ধ্যার পর বড় ভাই-বোনদের খাইয়ে নিজে খাচ্ছেন, এমন সময় বাড়ির উঠানে একটি মুরগির বাচ্চার চিৎকার কানে আসলো। আম্মা মনে করেছেন, কোন বাচ্চা মনে হয়, ভূলে খোঁয়াড়ে ঢুকেনি, তাই চেঁচাচ্ছে। আম্মা দরজা খোলার জন্য এগিয়েছেন , এমন সময় পাশের রুম হতে দাদী (মওদুদ ভাই/হেলালদের দাদী) চিৎকার করে আম্মাকে বাড়ির বাইরে আসতে নিষেধ করলেন। একই সঙ্গে পাশের বাড়ি হতে গফুর ভাইয়ের দাদীও আম্মাকে বের হতে নিষেধ করলেন। মাঝে মাঝে রাতে কেউ যেন ঘরের উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে, কেউ যেন ঘরের চালে ঢিল ছুড়ছে, এমন শব্দ আসতো। মাঝে মধ্যে রাতে বাড়ি আসার পথে মওদুদ ভাই এর বাবা, হেলাল/জুনাইদ এর বাবা, এমনকি আম্মাও বাড়ির প্রবেশমুখে পুকুর পাড়ে একটি বয়স্ক মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতেন। বিশেষত: সিরত মাহফিলে যারা গভীর রাতে বাড়ি ফিরতো, তাদের মূখেও এরূপ গল্প শোনা যেত।জ। মোহাম্মদ ভাইদের 'মুরা'তে অবস্থিত ভিটা এলাকায় এখনো অনেক অব্যাখ্যানিয় ঘটনা ঘটে থাকে।ঝ। কোন এক রাত অবধি সমু কাজে ব্যস্ত ছিল। খুব ভোরে সে একা চুনতি কবরস্থানের পাশে ঈদগা মাঠে যাচ্ছিল। তখন আধো আলোয় সে দেখতে পায় সাদা কাপড় পরিহিত অনেকগুলো মানুষ জামাতে নামাজ পড়ছে। ভয় পেয়ে সে আর ওদিকে যায়নি।ট। সেকালে চুনতির কয়েকটি পুরনো পুকুরে মাঝরাতে কোন কিছু ঝাপাঝাপি করতো বলে শোনা যায়। মুরুব্বীরা বলতো এগুলো 'জঁইক্ষা'দের কাজ। 'জঁইক্ষা' হলো পুকুরে থাকা জ্বীন-পরি।২। এখন সময় পরিবর্তিত হয়েছে, বিদ্যুৎ এসেছে, অন্ধকার দূর হয়েছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। গভীর রাত অবধি মানুষ রাস্তায় চলাফেরা করছে। ধীরে ধীরে জ্বিনদের উৎপাত কমছে (সম্ভবত তাদের আশ্রয়স্থান সংকুচিত হয়ে পড়ছে), গ্ৰামগুলো শহরে পরিণত হচ্ছে। হয়তোবা ভবিষ্যতে গ্ৰামীন অলৌকিক কাহিনীর পরিবর্তে শহুরে 'ghost story' এর episode আলোচিত হবে ।।ওয়াহিদ আজাদ ; ১২/০৯/২১
Make sure you enter the(*)required information