উনিশ শ সাতাশি সালে যখন আমি চুনতী হাকীমিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসাবে অফার লাভ করি তখন আমার বয়স পঁচিশ বছর আর ওজন ছিল বাহান্ন কেজি। হালকা পাতলা গড়ন। কৃষ্ণকায় ও খর্বাকৃতির হওয়ার কারণে আমাকে মাদ্রাসার আলিম ফাযিল শ্রেণীর ছাত্র বলে চালিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল। প্রফেসর ড. আবু বকর রফিক আহমদ স্যার এবং জনাব মাওলানা মাহফুজুর রহমান সিদ্দিকী সাহেবের সাথে আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো পহেলা ফেব্রুয়ারী আমি আমার কর্মস্থলে যোগদান করবো। চুনতী মাদ্রাসার সুনাম সুখ্যাতি আমি অনেক শুনেছি, কিন্তু কখনো কালুরঘাট ব্রীজ পার হওয়ার সুযোগ আমার হয় নি। প্রফেসর ড. হাফেজ মুহাম্মদ বদরুদ্দোজা তখন চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রভাষক। তাঁর সাথে আমার ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল বলে আমরা একসাথে থাকতাম। তিনি চুনতী মাদ্রাসার প্রাক্তন ছাত্র এবং পারিবারিক ভাবে আবু বকর রফিক স্যারের আত্মীয়। পহেলা ফেব্রুয়ারী রবিবার সকালে তিনি আমাকে নিয়ে চলে গেলেন কালুরঘাট ব্রীজের পশ্চিম প্রান্তে। ব্রীজের মেরামতির কাজ চলছে বিধায় শহর এলাকার গাড়ী থেকে নেমে পাঁচ টাকা নৌকা ভাড়া দিয়ে ব্রীজের পূর্ব প্রান্তে এসে বার টাকা বাস ভাড়া দিয়ে চুনতী শাহ সাহেবের গেটে এসে নামলাম। তারপর ছয় টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে চলে আসলাম সরাসরি চুনতী মাদ্রাসায়। খোঁজ নিয়ে প্রিন্সিপালের অফিস কক্ষে গিয়ে প্রিন্সিপালের সামনের চেয়ারে বসলাম। এই চেয়ারে সাধারণত সিনিয়র শিক্ষকগণ বসতেন। অফিসে কেবল একজন দপ্তরী উপস্থিত। বেলা তখন সাড়ে দশটা। সব শিক্ষক ক্লাসে। কিছুক্ষণ পর একজন শিক্ষক হাজিরা খাতা রাখার জন্য অফিসে এসে আমাকে প্রিন্সিপালের সামনের চেয়ারে বসা দেখে বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আমি ভর্তি হওয়ার জন্য এসেছি কি না? আমি বুঝতে পারলাম, তিনি হয়ত হাকীমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর "আদাবুল মু'আশারাত" গ্রন্থখানি পড়েন নি। নতুবা তিনি জানতে চাইতেন আমি কী কাজে গিয়েছি। কিছুক্ষণ পর একজন বয়স্ক মুহাদ্দিস হুজুর এসে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি পরিচয় দিলাম। তিনি হন্তদন্ত হয়ে আমি কি ভাবে আসলাম, কোন কষ্ট হয়েছে কী না এবং সকালে কী খেয়েছি ইত্যাদি জানতে চাইলেন। নাস্তা নিয়ে আসার জন্য দপ্তরীকে হুকুম দিলেন। আমি আসবো এই বিষয়টি তাঁর আগে থেকেই জানা ছিল। কারণ, ভাইস প্রিন্সিপাল তথা ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল, প্রধান মুহাদ্দিস ও হেড মাওলানা সাহেব তখন ইন্ডিয়া সফরে আর তিনি প্রিন্সিপালের দায়িত্বে। ভাইস প্রিন্সিপাল সাহেব তাঁর ছাত্র। ইন্ডিয়া যাওয়ার সময় ভাইস প্রিন্সিপাল সাহেব ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল হিসাবে তাঁকে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব প্রদান করেন এবং দায়িত্ব প্রদান পত্রের শেষে অসাধারণ সুন্দর হস্তাক্ষরে সাক্ষরের আগে আরবীতে লিখেন- حامل نعليك محمد عزيز الحق অর্থাৎ আপনার জুতা জোড়া বহনকারী মুহাম্মদ আজিজুল হক। একজন শিক্ষকের প্রতি একজন ছাত্রের- তা ও আবার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল পদে নিয়োজিত- আমাকে ভীষণভাবে আপ্লুত করেছে, যা আমি আজীবন স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করে চলছি।নাস্তা পর্ব শেষ করে আমি ক্লাসে যেতে চাইলাম। ভাইস প্রিন্সিপাল, প্রধান মুহাদ্দিস ও হেড মাওলানা সাহেব ছুটিতে থাকার কারণে ফাযিল ও কামিল শ্রেণীর কিছু ক্লাস খালি ছিল। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে প্রথমে ফাযিল শ্রেণীতে তাফসীর জালালাইন অতঃপর কামিল শ্রেণীতে তিরমিযী শরীফের পাঠদান করলাম। উভয় ক্লাসেই উপস্থিত ছিল আমার পূর্ব পরিচিত এবং এই মাদ্রাসার কামিল পরীক্ষার্থী আহমদ আলী, যে কিনা বর্তমানে বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত ইসলামিক স্কলার ও গবেষক, আমার একান্ত স্নেহভাজন ছাত্র ও শিষ্য প্রফেসর ড. আহমদ আলী। অল্প সময়ের মধ্যেই সর্বত্র প্রচার হয়ে যায় যে, চুনতী মাদ্রাসায় একজ বাচ্চা ছেলে প্রিন্সিপাল হিসাবে যোগদান করেছেন যিনি কোন প্রকার পূর্ব প্রস্তুতি ব্যতীত সকল শ্রেণীতে সকল বিষয়ে পাঠদান করতে সক্ষম। ক্লাস শেষে সালাতুয যুহরের পর মসজিদেই ক্ষুদ্র পরিসরে নবাগত প্রিন্সিপালকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। আমি এতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পেশ করি এবং এই মাদ্রাসা নিয়ে আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা উপস্থাপন করি। এই ভাবে চুনতী হাকীমিয়া কামিল মাদ্রাসায় প্রিন্সিপাল হিসাবে আমার প্রথম কর্মদিবস অতিবাহিত হয়।
লেখক পরিচিতিঃ প্রফেসর ডঃ আ ক ম আব্দুল কাদের, সাবেক খ্যাতিমান প্রিন্সিপাল, চুনতি হাকিমিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
Make sure you enter the(*)required information