।। একটি সার্বজনীন পারিবারিক বেদনা ।।আমরা ৭০/৮০/৯০ দশকের প্রজন্ম একান্নবর্তী (extended family) ও অনু পরিবারের (nuclear family) সন্ধিক্ষণ যুগের প্রতিনিধিত্বকারী। বলা যায়, ৯০'র দশকের প্রজন্ম বিশেষত শহুরে পরিবারগুলো একান্নবর্তী সংসারের বিদায়ী প্রতিনিধি। এরপর হতে মোটামুটি অধিকাংশ পরিবারের সন্তান-সন্ততিরা দাদা-দাদী, চাচা, ফুফু ও এক গাদা ভাই-বোনের সাথে একই ছাদের নিচে বসবাস করার অভিজ্ঞতা পায়নি। উভয় ধরনের পরিবারের সুবিধা-অসুবিধা দুটোই রয়েছে। তবে একান্নবর্তী পরিবারের ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই বেশ প্রসারিত, উদার ও খোলা মনের অধিকারী হয়ে থাকে। কারণ তারা দাদা-দাদী, চাচা, ফুফুদের সাথে নিজেদের মনোভাব-অনুভূতি খোলামেলাভাবে প্রকাশ করতে পারে, যা তাদের মনের বিকাশকে প্রভাবিত করে। অপরদিকে অনু বা ছোট পরিবারের সন্তান-সন্ততিরা মানসিকভাবে কম বিকশিত হয়। তাদের মধ্যে এক ধরনের জড়তা থাকে। পরিবারে বেশি সংখ্যক ভাই-বোনের উপস্থিতি না থাকায় কিংবা দাদা-দাদী বা চাচা, ফুফু এদের উপস্থিতি কম থাকায় ছেলেমেয়েদের অনুভূতি ও মনোভাবের শেয়ারিং কম হয়, যা তাদের মধ্যে চাপা, আবদ্ধ স্বভাব গড়ে তোলে। অবশ্য ইদানিং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এসে ছোট-বড় সকলকেই ঘরকুনো প্রাণীতে পরিণত করেছে। এখনকার কিছু ছোট পরিবারের অতি সতর্ক বাবা-মায়েরা ছেলেদের সংসারে থাকতে চায় না। তাই বাবা-মায়েরা, বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ছেলেদের সংসার আলাদা করে দেয়ার চেষ্টা করে। এর ফলে ছোট পরিবার ভেঙ্গে আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে 🙁উপরে পরিবারের প্রসঙ্গ এনেছি নিজের ব্যক্তিগত কিছু অনুভূতি প্রকাশের জন্য। বাবা-মা, ভাই-বোন একসাথে থাকার ফলে পারস্পরিক সম্প্রীতি জোরালো থাকে। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো বিষয়ে মান-অভিমান, গোস্বা, রাগ তৈরি হলেও একসময় তা পারস্পরিক হৃদ্যতা, ভালোবাসাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া বড় পরিবারে "হোম পলিটিক্স" এর মত ভিন্ন একটি পরিবেশ বা বলয় তৈরি হয়, যা একজনকে ভবিষ্যতের বাস্তব, কঠিন জীবনের মুখোমুখি হতে সহযোগিতা করে। বিপরীতভাবে একটি ছোট পরিবারের সদস্য অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের ভালবাসা, মায়া-মমতা পেয়ে থাকে। এছাড়া এখানে "হোম পলিটিক্স" থাকে না বিধায়, সে জীবনের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে না কিংবা বাস্তব জগতের কঠিন পরিস্থিতি মুখোমুখি হওয়ার সাহস করতে পারে না। আমার আজকের অনুভূতি মা, বাবা ও বড় ভাইয়ের বিষয়ে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হলো বাবা ও মায়ের আইসিইউ "কাট অফ" করার সিদ্ধান্ত গ্ৰহন, যা আমাকে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করছে। বাবার বিষয়টি হয়তোবা কিছুটা সাধারন ছিল। বাবার একিউট নিউমোনীয়া হয়ে শ্বাস নিতে না পারায় ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল এবং একপর্যায়ে কমা পরিস্থিতিতে চলে গিয়েছিলেন। ডাক্তারদের দীর্ঘ অবজারভেশনের পর আমাদেরকে আইসিইউ মেডিসিন "কাট অফ" করার সিদ্ধান্ত নিতে বলা হয়। পরিবারের বাকি সদস্যরা অর্থাৎ আমার ভাইয়েরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। কাউকে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। আমি সেই সিদ্ধান্ত নিলাম (৬ অক্টোবর, ২০১২)। মহাখালীস্থ আয়েশা হসপিটালের আইসিইউ রুমের সামনে এ সিদ্ধান্ত দেয়ার পর অনেকক্ষণ কান্না করূছিলাম। ঐ মুহূর্তে কয়েকজন ডাক্তার ও নার্স এসে আমার পিঠ চাপড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। দ্বিতীয়টি হল আমার মায়ের বিষয়ে (১৪ মার্চ, ২০২১)। এখন হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক। "করোনা" নামক হতচ্ছাড়া সংক্রামক ব্যাধি কি ভয়াবহ রূপ নিয়ে গোটা দুনিয়াকে ক্ষতবিক্ষত করেছিলো, তা এখন বুঝার কোন উপায় নেই 🙁 শুধুমাত্র আমাদের মতো যারা পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য হারিয়েছি তারাই বুঝতে পারি এর বেদনা 🙁 আম্মা করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রথম দিকে বেশ সুস্থ ছিলেন, বোঝাই যাচ্ছিলোনা যে তিনি করোনা আক্রান্ত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে করোনার জীবাণু আম্মার ফুসফুসের ৯০% এরও বেশি অংশ খুবই দ্রুত সূক্ষ্ম জালের মত ছিদ্র ছিদ্র করে ফেলেছিলো। কোনক্রমেই অক্সিজেন লেভেল ঠিক রাখা যাচ্ছিলো না। প্রথমে চট্টগ্রামের 'মা ও শিশু হাসপাতালে' কিছুদিন ও পরবর্তীতে ঢাকাস্থ শ্যামলীর বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের আইসিইউতে মোট ১৪/১৫ দিন অবস্থানের পর মায়ের করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। মাকে জেনারেল ইউনিটের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু করোনা নেগেটিভ হলে কি হবে, আম্মার ফুসফুসের প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছে, যা আম্মার দীর্ঘমেয়াদি পারকিনসন্সের কারণে স্থায়ীভাবে অকার্যকর হয়ে গিয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের অভিমত। আম্মার অক্সিজেন রিকোয়ারমেন্ট ক্রমেই বেড়ে চলছিল। হাইফ্লো অক্সিজেন দ্রুত ৫০ এর উপরে উঠে যাচ্ছে। আমার এক ফুফাতো ভাই ডাক্তার আসিফ ঐ আইসিইউ ইউনিটে দায়িত্বরত ছিলো। সে আম্মার পরিস্থিতি দেখভাল করতো। ডাক্তারদের সার্বিক পরামর্শে যা বুঝলাম আম্মার পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আম্মার সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখে ডাক্তারগন আমাদেরকে "ইনভেসিভ ভেন্টিলেশন" ও "নন ইনভিসিভ ভেন্টিলেশন"এর (NIV) মধ্যে একটি বেছে নিতে বলে। তবে তাদের ভাষ্যমতে ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনে নেয়ার মতো শারীরিক উপযুক্ততা আম্মার নেই। যাই হোক, ডাক্তাররা আমাদের নিকট হতে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে চায়। আমি ও আমার ভাইয়েরা আম্মাকে ইনভিসিভ ভেন্টিলেশনে নেয়ার সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে আসলেও হাসপাতাল ও আমাদের পরিচিত অপরাপর ডাক্তারদের পরামর্শে ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনে নেয়ার সিদ্ধান্ত হতে ফিরে আসি। ডাক্তারদের অভিমত ছিলো এতে আম্মার কষ্ট বেড়ে যাবে। নিয়তির কি খেলা, এমন কঠিন সিদ্ধান্তের বিষয়ে আবার আমাকেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো অর্থাৎ আম্মাকে ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনে না নিয়ে "নন ইনভেসিভ ভেন্টিলেশনে" নিয়ে যাবো। এর পরপরই আম্মা আমার সাথে সর্বশেষ চোখের ভাষা বিনিময় করে মেসিভ হার্ট এ্যাটাক আক্রান্ত হয়ে দুনিয়া ছাড়েন। এ ঘটনার পর হতে প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয়, "ভেন্টিলেশনে নিতে পারলে আম্মাকে হয়তোবা আবার ফিরে পেতাম"।আমাদের পরিবারের পরবর্তী মুরুব্বী বড় ভাই এর কথা আর কি বলবো। বড় ভাইতো কাউকে কষ্টই দিতে চায়নি, তাই বোধ হয় আমাদের গ্রাম চুনতি'র নিজ বাড়িতে নিজের শেষ নিঃশ্বাস নিলেন (২০ নভেম্বর'২১)। এরপর হতে আমাদের পরিবারের সবকিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল 🙁 বাবা মায়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো, বড় ভাইয়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো সবকিছুই সার্বক্ষণিক মনের অলিতে-গলিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এখন হতে আমাদের ছেলেমেয়েরা সেই একান্নবর্তী পরিবারের দাদা-দাদী আর বড় আব্বুর মত চিরায়ত সুমধুর সম্বোধন করবে না। দাদা-দাদী, বড় আব্বুর জীবিত প্রতিচ্ছবি তাদের শিশু মনের স্মৃতি হতে হয়তোবা এক সময় বিলীন হয়ে যাবে। আমরাও জীবনের বাস্তবতার দৌড়ে ও জীবনের প্রাত্যাহিক চ্যালেঞ্জের ভিড়ে হয়তোবা বাবা-মা, বড় ভাইয়ের তাজা স্মৃতি মলিন করে ফেলবো 🙁 তবে এই স্মৃতিগুলোতো হাল্কা কোন দাগ নয় যে, সার্ফ এক্সেল এর মতো কেমিক্যাল দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলা যাবে। এগুলো যে হৃদয়ের ক্ষরণ হতে সৃষ্ট র*ক্তের দাগ, আত্মার দাগ, যা কখনো মুছে যাওয়ার নয়।আমার এই অনুভূতিগুলো কেবল আমার নয়, আমি মনে করি আমাদের প্রচলিত বড় পরিবারের সমাজ ব্যবস্থায় অনেকেই এ ধরনের অনুভূতিতে বিদগ্ধ হয়ে আছে 🙁 কেউ প্রকাশ করে বা প্রকাশ করতে পারে, আর কেউ প্রকাশ করে না বা প্রকাশ করতে পারে না। তবে মনের চোরাগলিতে হারিয়ে গিয়ে সবাই যেন এ বিষয়ে অনুভূতিহীন না হয়ে পড়ে, কারণ এটিই জীবনের তাৎপর্যতা। এই অনুভূতিই হলো একটি সত্যিকার জীবনের মূল উপাদান ❤ "রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা"।ওয়াহিদ আজাদ; ১০/১১/২২
Make sure you enter the(*)required information