চুনতীর সৌখিন মানুষদের একজন আমাদের চিরসবুজ, চিরতরুণ দীনু চাচা পুরো নাম নাজমুল হুদা খান ছিদ্দিকী।আল্লাহ তায়ালা উনাকে জান্নাতের মেহমান বানিয়ে দিক।দীনু মামা স্মরণে============0দিন যায় দিন আসে। মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সব স্মৃতিতে থাকে না। বিশেষ করে পেছনের ঘটনা। তবে কিছু মুহূর্ত, কিছু ঘটনা যতই পুরাতন হোক না কেন স্মৃতিতে থেকে যায়। তা কখনো স্মৃতি থেকে মুছে যায় না। সদ্য প্রয়াত দীনু মামাকে নিয়ে কিছু মুহূর্ত, কিছু ঘটনা তেমনি আমার স্মৃতিতে সদা উজ্জ্বল। পরমাত্মীয়ের সুবাদে দীনু মামাকে নিয়ে কিছু মুহূর্ত, কিছু ঘটনা এবং কিছু কথা না লিখে পারছি না।
দীনু মামা সম্পর্কে আমার আম্মার চাচাতো ভাই এবং ছোট ভাই। তিনি আমার মেঝ মামা (হাবিব মামা)'র সমবয়সী। মেঝ মামা ও ছোট মামা (সেলিম মামা)'র সাথে বাল্যকাল থেকে উনার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমার নানা-নানির পরিবারের সাথে উনার হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। যা নানা-নানির নাতি-নাতনি পর্যন্ত প্রসারিত। এই সম্পর্ক উনার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত অটুট ছিল। আমার আম্মা ছিলেন উনার নিজের বড় বোনের মত। ছোটকালে দেখেছি তিনি আমার দাদার বাড়িতে আম্মার কাছে আসতেন। ছোট মামার সাথেও এসেছেন। কখনো বা আম্মাকে পৌঁছিয়ে দেয়ার জন্য আম্মার সাথে এসেছেন। হালকা পাতলা ছোটখাটো গড়নের হাস্যোজ্বল বাকপটু দীনু মামা ছিলেন আমাদের ভাই বোনদের প্রিয় মামা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আব্বা সরকারি চাকরিতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বদলি হয়ে আসলে ১৯৭২ সালের শেষের দিকে আমাদের পরিবার গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। আব্বা আগ্রাবাদ হাজীপাড়ায় (চৌমুহনী টু হালিশহর সিএসডি গোডাউন রোডে) একটা ছোট বাসা ভাড়া করেছিলেন। তখনো আসবাবপত্র সব কেনা হয়নি। আমরা ভাই বোনেরা ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমাতাম। সরকারি বাসা না পাওয়া পর্যন্ত কিছুদিন আমরা এই বাসায় ছিলাম। একদিন দীনু মামা এসেছিলেন। তিনি আমাদের সাথে ফ্লোরে শুয়েছিলেন এবং আমার পাশেই ঘুমিয়েছিলেন। বহু বছর গত হয়েছে। আমরাও অনেক বড় হয়ে গেছি। দীনু মামার বিয়ে হচ্ছে। আমি তখন চুনতিতে। বড় মৌলানা পাড়ায় নিজ বাড়িতে বরের পোশাকে সজ্জিত দীনু মামা। ইউছুপ মৌলানা পাড়ার দিকে বরযাত্রা শুরু হবে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় তিনি দোয়া নিতে পিতাকে কদমবুসি করলেন। তারপর পিতাপুত্র একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দুইজনেই কিছুক্ষণ কাঁদলেন। এখন এসব স্মৃতি আমার চোখের সামনে ভাসছে।দীনু মামা বিয়ের পর বাগান পাড়ার পাহাড়ে পৈতৃক জায়গায় বসবাসের স্হায়ী ঠিকানা করে নিলেন। ঐ সময় সেখানে দুই একটা ঘরবাড়ি ছিল। তখনো বাগান পাড়া নামকরণ হয়নি। উনার বাল্যকাল বড় মৌলানা পাড়ায় কাটলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন মাতুলালয়ে, ডেপুটি পাড়ায়। বাগান পাড়ায় চলে গেলেও তিনি নিয়মিত ডেপুটি পাড়ায় আসা যাওয়া করতেন। পিতার মৃত্যুর পর বড় মৌলানা পাড়ায় তেমন যেতেন না। উনার আম্মা উনার সাথে থাকতেন। বাগান পাড়ায় বসবাসের পর থেকে আমাদের সাথে উনার দূরত্ব বেড়ে যায়। মাঝে মধ্যে ডেপুটি পাড়ায় কিংবা রাস্তা ঘাটে কদাচিত দেখা হতো। দেখা হলে বলতেন তোরা কেমন আছিস, বুবু কেমন আছে?স্কুল জীবনে দীনু মামা গ্রামে ও শহরে লেখাপড়া করেছেন। কাজেম আলী হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। চুনতি হাইস্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে ম্যাট্রিক পাশ করার পর উনার মামা ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান উনাকে সাথে করে পাকিস্তানের করাচীতে নিয়ে যান। দীনু মামাকে উনার কর্মস্থলে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দেন। পরবর্তীতে দেশে ফিরে এসে স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে তিনি চুনতি হাই স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে বছর দেড়েক শিক্ষকতা করেন। তিনি ভাল ইংরেজি জানতেন। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি আজিজ নগরে আজিজ উদ্দীন সিগারেট ফ্যাক্টরীতে কয়েক বছর চাকরি করেন। পরে এক সময় শহরে আন্দরকিল্লায় পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত বইয়ের দোকানে বইয়ের ব্যবসা করেন। বেশ কয়েক বছর ব্যবসার পর ব্যবসা গুটিয়ে আবার গ্রামে চলে আসেন। ছোটখাটো একটি দোকান চালাতেন। পৈতৃক জমি থেকে ধান পেতেন। তাতেই সংসার চলে যেতো। চুনতিতে একসময় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা 'পথিকৃৎ' এর কার্যক্রম শুরু হয়। তিনি এতে চাকরিতে যোগ দেন। একটানা কয়েক বছর চাকরি করেন। 'পথিকৃৎ' এর কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর থেকে একপ্রকার অবসর জীবনযাপন করেছেন। দীনু মামার জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। সীমিত আয়ের জীবনযাপনে অভ্যস্হ ছিলেন। কখনো বড় লোক হওয়ার চিন্তা করতেন না। দীনু মামা পোশাক পরিচ্ছদে, চলাফেরায় সৌখিন ছিলেন। ইস্তিরি করা শার্ট-প্যান্ট পরিধান করতেন। কভারসমেত দুই পকেটযুক্ত এক কালারের হাফহাতা শার্ট পরতেন। দর্জির দোকানে নিজের মত করে শার্ট সেলাই করে নিতেন। অনুষ্ঠানাদিতে স্যুট পরতে পছন্দ করতেন। বাই সাইকেল ও মোটর সাইকেল চালানো উনার শখ ছিল। দামী বাই সাইকেল ও মোটর সাইকেলের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তখনকার খুব দামী সাইকেল Rally Cycle কিনেছিলেন। পরবর্তীতে শারীরিক গঠনের সাথে মানানসই 50 CC Honda Motor Cycle কিনেছিলেন। তিনি রুচিবোধ সম্পন্ন মার্জিত মানুষ ছিলেন। মনেপ্রাণে একজন ভাল মানুষ ছিলেন। এবং সংস্কৃতিমনা ও আহলাদে মানুষ ছিলেন। ভাল গান গাইতেন। নজরুল গীতি বেশি পছন্দ করতেন। পারিবারিক পরিবেশে, স্কুলের অনুষ্ঠানে, পিকনিকে সর্বত্র গান গাইতেন। এছাড়া চুনতির বিয়ে-শাদিতে প্রচলিত শায়েরখানিতে গাইতেন। খেলাধূলায় উৎসাহী ছিলেন। কেরাম বোর্ড ও ব্যাডমিন্টন ভাল খেলতেন।দীনু মামার বাড়ি পাহাড়ের বেশ উঁচুতে। পাহাড় বেয়ে উঠতে কষ্ট হতো। বয়ষ্ক মানুষের আরও কষ্ট। কয়েক বছর পূর্বে পাহাড় কেটে তা নীচু করে পাকা বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। একসময় ঐ এলাকায় যাওয়ার মত সেখানে রিক্সা বা গাড়ির রাস্তা ছিল না। এখন গাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়। দীনু মামার স্বপ্ন ছিল ছেলেদের জন্য সুন্দর একটা পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দিয়ে যাবেন। বড় ছেলে শাহাদাৎকে নিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী তা বাস্তবায়ন করেছেন। বছর দেড়েক আগে আম্মা চুনতি গিয়ে বাগান পাড়ায় রাশু খালা, রাবু খালা ও দীনু মামার বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। দীনু মামার নতুন বাড়ি দেখার সখ হলো। গাড়ি নিয়ে বাগান পাড়ায় ঢুকছি। রাস্তায় দীনু মামার সাথে দেখা। কোথাও কাজে যাচ্ছেন। বললেন তাড়াতাড়ি চলে আসবেন। আমরা উনার বাড়িতে পৌঁছে গেছি। মামী চা-নাস্তা আপ্যায়ন করলেন। ততক্ষণে দীনু মামা চলে এসেছেন। আমার আম্মা উনাদের বাড়িতে আসায় মামা-মামী এত বেশি খুশি হয়েছিলেন ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। উনারা আম্মাকে ঘুরে ঘুরে বাড়ি ঘর সব দেখালেন। দীনু মামা ভবিষ্যত পরিকল্পনাও জানালেন। ভাত খাওয়ার জন্য খুব জোর করছিলেন। সময় স্বল্পতার কারণে আমাদেরকে ভাত না খেয়ে আসতে হলো। দীনু মামার আবেগ ও আন্তরিকতা দেখে আমার ছোটবেলার প্রিয় দীনু মামাকে যেন সেদিন নতুন করে খোঁজে পেয়েছিলাম। দীনু মামার বাড়িতে গেলে তিনি আর কোনদিন ভাত খাওয়ার জন্য জোর করবেন না। তিনি চলে গেছেন অনেক দূরে যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। দীনু মামার আত্মার শান্তি কামনা করছি। আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন। আমিন।- হেলাল আলমগীর -----------------------------------------------------------------------------* আমার লেখায় কিছু তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আবু মামা, রোকন মামা (রোকন মাস্টার), রেজু মামা ও ছোট ভাই শাহাদাৎ (দীনু মামার ছেলে)। সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।('প্রিয় চুনতী' ভাইবার ফোরামে দেয়া পোস্ট, কপিকৃত।)
Make sure you enter the(*)required information