মার্চ মাসের শেষের দিকে সরকার মহামারি মোকাবিলায় যে লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, সদ্য ঘোষিত বাজেট প্রস্তাবেও সেগুলো অন্তর্ভুক্ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাধারণ ভোক্তা ও পরিবারের ওপর এই বাজেটের প্রভাব কী।
কর্মবাজারের দিকে তাকালে দেখা যায়, আমাদের ৪০ শতাংশ কর্মসংস্থান হচ্ছে কৃষিতে, সেবা খাতে আরও ৪০ শতাংশ ও বাকি ২০ শতাংশ শিল্পে। সেবা খাতের মধ্যে আছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা, খুচরা বিক্রয়, হোটেল, রিয়েল এস্টেট, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক কর্ম, প্রযুক্তি, গণমাধ্যম, যোগাযোগ, পরিষেবা, পেশাদার সেবা, পর্যটন ও ব্যক্তিগত সেবা ইত্যাদি। অর্থনীতি গতি হারিয়ে ফেলায় এসব খাত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি সর্বব্যাপক খাত হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। সেখানে ছয় কোটির বেশি মানুষ কাজ করছেন। ভারবাহী শ্রমিক, কারিগর, নির্মাণকর্মী, রিকশাচালক, ঠেলাগাড়িচালক, ট্যাক্সিচালক, ট্রাকচালক, ফুটপাতের বিক্রেতা, রেস্তোরাঁকর্মী, ব্যক্তিগত সেবাকর্মী—তাঁরা সবাই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। একদম মুদিদোকান ছাড়া সুপারশপসহ অন্যান্য সব খাতের বিক্রি ব্যাপক হারে কমে গেছে। বিশেষ করে হোটেল-রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, বিমান পরিবহন মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। রাস্তায় মানুষের চলাচল কমে গেছে বলে রিকশাচালক ও অটোচালকদের আয় ব্যাপক হারে কমে গেছে। অথচ প্রায় ৬০ লাখ মানুষ এই পেশায় যুক্ত।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ কর্মী গ্রাম ও শহরাঞ্চলে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। দৈনিক শ্রমিক, রাস্তার হকার ও ঠেলাচালকদের আয় এখন নেই বললেই চলে। অর্থনীতিতে এর বিপর্যয়কর ফল দেখা যাচ্ছে। অন্যদিকে ঈদুল ফিতর ও পয়লা বৈশাখের কেনাকাটা হলো না। পাশাপাশি গৃহকর্মীরা কাজ হারিয়েছেন। এই দুটি ঘটনা বিভিন্ন খাতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি সামষ্টিক অর্থনীতির সার্কুলার ফ্লো অব ইনকাম বা আয়ের চক্রাকার আবর্তন নিয়ে কথা বলব। পারিবারিক ও ভোক্তা ব্যয় অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরি করে। কিছু মানুষ এই চাহিদা পূরণের জন্য উৎপাদন ও বিপণনকাজে যুক্ত হন। তাঁরা যে আয় করেন, সেটা আবার ভোগে ব্যয় হয়, চাহিদা তৈরি হয়। কিন্তু পারিবারিক আয় কমে গেলে চাহিদায় স্বাভাবিকভাবেই ভাটা পড়বে।
এদিকে পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই পরিস্থিতিতে দারিদ্র্য আরও বেড়ে যেতে পারে। সরকার যে ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে ঈদের আগে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে নগদ সহায়তা করল, তা একেবারেই যথেষ্ট নয়। আবার এতে বড়জোর দুই কোটি মানুষ উপকৃত হয়েছে, যেখানে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা এখন পাঁচ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। সে জন্য এই নগদ সহায়তা অন্তত তিন মাস চালানো এবং টাকার অঙ্ক আরও বড় হওয়া উচিত ছিল। প্রান্তিক চাষিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাঁদের অবশ্য পৃথক ভাতা দেওয়া প্রয়োজন ছিল।
অন্যদিকে সরকারের উচিত ছিল ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসএমই খাতে অর্থায়নে যুক্ত করা। এই ধরনের অর্থায়নে এসব প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা আছে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে যেমন কর্মসংস্থান হতো, তেমনি সমাজে অর্থের প্রবাহ তৈরি হতো। এই খাতের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করা হলেও এরা এতটাই অসংগঠিত যে ব্যাংকঋণ পাওয়া একরকম দুঃসাধ্য। ব্যাংক যেখানে বড় করপোরেটদের কাছ থেকে জামানত নিয়ে ঋণ দেয়, সেখানে এরা ঋণ পাবে কীভাবে।
অন্যদিকে আমার আশঙ্কা, শিল্প খাতের জন্য সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তাতে কাঙ্ক্ষিত ফল মিলবে না। অধিকাংশ ব্যাংক এখন খেলাপি ঋণের সংকটে আছে। ফলে এই মুহূর্তে আরও ঋণ দেওয়ার বেলায় তারা সতর্ক থাকবে।
তাহলে একদিকে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ঠিকঠাক হচ্ছে না, অন্যদিকে আমি আরও প্রণোদনা দেওয়ার কথা বললাম। এই টাকা কোত্থেকে আসবে? ব্যাপারটা ঘাটতি বাজেট বাড়ানোর মতোই। এতে সাময়িকভাবে সরকারের ধারদেনা বেড়ে যাবে, তবে মধ্য মেয়াদে তা কমে আসবে। কারণ, পরিবারের হাতে টাকা যাওয়া মানেই হলো অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগা। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে। আর চাহিদা অত বেশি না হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে না।
মাসুদ খান, প্রধান উপদেষ্টা, ক্রাউন সিমেন্ট
( সূত্র : প্রথম আলো , তারিখ: ১৫ জুন ২০২০).
Make sure you enter the(*)required information