আমার শৈশবের সাথে যে নামটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, সেটি ‘চুনতি’। চুনতি আক্ষরিক অর্থেই আমার মাতৃভূমি। ভুল বললাম? এ গ্রামেই জন্মেছেন আমার মা, অর্থাৎ আমার মা এর জন্মভূমি। বাবা কে হারিয়েছি খুব অল্প বয়সে। দাদা দাদী কে তারও আগে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই দাদার বাড়ীর বন্ধন কিছু টা হালকা হয়ে নানার বাড়ীর বন্ধন আরও জোরালো হয়েছিল। নানার বাড়ীর প্রতি টি স্নেহময় মানুষ গুলোর সাথে প্রতি টা ইট পাথর, দরজা জানালা, উঠোন, পুকুর ঘাট বড় বেশী কাছের, বড় মায়াময়। বছরের প্রতি টি দিন মুহূর্ত গুনতাম, কবে স্কুল ছুটি হবে, কবে চুনতি যাবো! দুরন্ত শৈশবের স্মৃতি এখনো কত সতেজ, কত মায়াময়। মনে পড়ে বড় মামার নির্মাণাধীন বাড়ীর ছাদ বিহীন এ দেয়াল থেকে সে দেয়াল স্পাইডার ম্যান এর মত অবলীলায় হেঁটে গিয়ে কার্নিশে পা ঝুলিয়ে বসে মহানন্দে মুচি, বরই আর তেতুলের চাটনি খাওয়া। দলনেত্রী (মামাত বোন /বন্ধু) নবীনা কে মিস করি। পুকুর ঘাটে টি ভি’র প্রচারিত বিজ্ঞাপন এর নকল করার সময় দর্শক হিসেবে একদল কুকুরের আগমন। আমাদের অভিনয় মনপুতঃ না হউয়ায় ঘেউ ঘেউ স্বরে তীব্র প্রতিবাদ। আমরা জান হাতে নিয়ে পড়ি মরি করে দৌড়িয়ে কোনমতে রহীমের দোকানে ঢুকে আত্মরক্ষা করি। বান্ধবীর কাছ থেকে গল্পের বই এনে দেয়ার জন্য বিথী খালার পেছনে সারাক্ষন ঘ্যান ঘ্যান করা, শেষে তিনি বাধ্য হয়ে বই এনে দিয়ে রেহাই পেতেন। সন্ধ্যার পর বাবু ভাইয়েরা উঠানে নেট লাগিয়ে, লাইট জ্বালিয়ে ব্যাডমিনটন খেলতেন। ভদ্র দর্শক বেশে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর আর পারতাম না। হাত নিশপিশ করত, পা চুলবুল করত। অবশেষে উনারা বিরতির সময় আমাদের হাতে দয়া করে ব্যাট দিতেন। দখীন পাড়ায় গাছতলায় জমত শহিদু ভাই এর রূপকথার আসর। সেই রূপকথার গল্প কিন্তু একদিনে শেষ হতো না। কমপক্ষে তিন দিন লাগত এক একটা গল্প শেষ হতে। শ্রোতাদের নির্দিষ্ট কোন বয়স ছিলনা। রাতে ঘুমাবার আগে যখন আরেকপ্রস্ত কাহিনী শুরু হত তখন বুঝা যেত। এক নাগাড়ে বলে যখন একটু দম নেয়ার জন্য থামতেন তখনি পাশের বাড়ির ফরিদু মামা ওপাশ থেকে জিগ্যেস করত ‘তারপর কি হল চাচা?’ বরই পাড়ার উৎসব ছিল রীতিমত দেখার মত। আমাদের সুন্দরী বোন সুরাত, পুকুর পাড়ের কাঁটা ভর্তি গাছ বেয়ে তরতরিয়ে গাছের আগায় উঠে যেত। দুহাতে গাছের ডাল ধরে ঝাকাত, আর টুপটাপ করে টসটসে বড় বড় বরই ঝরে পড়তো। কিছুটা ডাঙ্গায় আর কিছুটা পুকুরের পানিতে। লম্বা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে সেগুলো কে টেনে টেনে তীরে আনা হতো। শহরে ফিরে আসার আগে বরই সংগ্রহ করে রাখতাম, আম্মাকে আচার বানাতে দেব বলে। একদিন দেখি থলে খালি। খোঁজ খোঁজ চারিদিকে। তখন দেখি আমার দাদা হাতেম তাঈ নজীব ভাই পাড়া ময় বরই বিলি করে হাসি হাসি মুখ করে ঘরে ঢুকছেন। আমার কাঁদো কাঁদো অবস্থা দেখে তড়িঘড়ি করে আবার বরই সংগ্রহে লেগে যেতেন। মালতির মার কাছ থেকে মোয়া মুড়ি কিনে নিয়ে স্নেহ ময়ী বড় মামী চিঁড়ের মোয়া গুলো আলাদা করে রাখতেন আমার জন্য, আমার যে খুব পছন্দের ছিল। ধান বিহীন বিলের কাদা পানিতে মাছ ধরাও যেন একটা অমোঘ উৎসব। প্রতি বছরের শেষে স্কুলের পরীক্ষা শেষে চুনতি বাসের পুরুটা সময়ই যেন উৎসবের দিন। কোনটাই যেন মিস করার নয়। আদরের কাঙ্গাল আমি। মামীর আদরের পরেও আরও চাই আমার। জমির আলের উপর দিয়ে হেঁটে বিল পাথারে মেঝখালার বাড়ীতে যেতাম। মধুর আকর্ষণ ছিল পিঠা তৈরি ও খাওয়ার পর্ব। রান্না ঘরের একপাশে ছিল ঢেঁকী, যেটা থেকে শুরু হতো পিঠা তৈরির প্রথম পাঠ। কি এক অদ্ভুত ছন্দে ঢেঁকী তে চাল ছাটা হতো। দুজন মহিলা তালে তালে ঢেঁকী তে পা দিয়ে উপর নীচ করতেন। আরেকজন মহিলা প্রতিবার নিপুন হাতে চাল গুলো নেড়ে দিতেন। এভাবেই আস্তে আস্তে চাল গুড়ো হত। সেই চালের গুড়ো দিয়ে পিঠা তৈরি হতো। সেই পিঠা আবার চুলা থেকে তোলা জলন্ত কয়লার আঁচে পোড়া পোড়া করা হত। সেই পিঠা খাওয়া হতো খেজুরের রস দিয়ে। কেউ কেউ খেতেন ঝাল দিয়ে রান্না করা দেশী মুরগির ঝোল দিয়ে। আহা! এখনও যেন স্বাদ লেগে আছে জিভে। দুষ্টামি একটু না করলে যে শান্তি লাগেনা। নানী’র (মেঝ খালার শাশুড়ি) চোখ ফাকি দিয়ে চুপি চুপি ছাদে গিয়ে লাগোয়া কাঁঠাল গাছের মুচি কিংবা পুকুর পাড়ের প্রায় হেলান গাছের কচি পেয়ারা চুরি করে খেতে কি যে মজা লাগে। মেঝ খালার বাড়ী থেকে মিশন এবার বড় খালার বাড়ীতে। একই ভাবে বড় খালা আর খালাতো ভাই বোনদের স্নেহ পাওয়া। বড় খালাদের পাড়ার বড় পুকুরের মাছ ধরার দৃশ্য, সে ও তো দেখার মতই একটা বিরাট ব্যপার। চুনতি বললেই আরেক টি চিত্র মনে ভেসে উঠে, সেটি হচ্ছে বাৎসরিক সিরাতুন্নবী মাহফিল। দেশ বিদেশের নানা বরেন্য ইসলামিক স্কলার যারা তাঁদের মুল্যবান বক্তব্য রাখতেন দীর্ঘ উনিশদিন ধরে। তবে সেই কৈশোরে আমার কাছে সিরাতুন্নবীর অন্যতম আকর্ষণ ছিল মেলা। শহরের মানুষ আমি, শহরেই বড় হয়েছি তবু, সারা বছর ধরে পয়সা জমাতাম ওই গ্রাম্য মেলার জন্য। সিরাতুন্নবীর মাঠ থেকে শুরু করে রহিমের দোকান পর্যন্ত রাস্তার দুধারে বসতো অস্থায়ী সব দোকান। চুড়ি, চুলের ফিতে, ক্লিপ, নেইল পলিশ, খেলনা। থাকতো মজাদার সব খাবারের দোকান। কি ছিল না ওই মেলাতে? ওয়াজের দিকে অত মনোযোগ থাকতো না, ছোট মানুষ ওই সব ভারিক্কি কথা বার্তা মাথায় ঢুকত না। তবু মা খালা মামী দের দেখাদেখি শেষ মুনাজাতের দিন রাত জাগতাম ফজর পর্যন্ত। সেই ঢুলো ঢুলো চোখে বড় ভক্তি ভরে হাত তুলতাম মহান আল্লাহ্ পাকের করুনা লাভের জন্য, আর আত্মপ্রসাদে ভুগতাম অনেক সউয়াব কামিয়েছি ভেবে। চুনতিতে আমার শৈশবের সব বন্ধুরা.................. যূথী, নবীনা, শমশাদ, কাকী, নীলা, নয়ন, শিপন, গিন্নি, নাছু, সুরাত, পাপ্পু আরও কত্ত বন্ধুরা, সবার সাথে হয়তো যোগাযোগ নেই, কিন্তু ভুলিনি কাউকেই। আজ এই পরিনত বয়সে দীর্ঘ প্রবাস জীবনে বাস করেও চুনতি আমার আগের মতই প্রিয়। এ যেন শুধু ভাবনা নয়, এখনও চোখ বন্ধ করলেই সিনেমার মত সব দৃশ্য দেখতে পাই। একেবারে জীবন্ত, প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর। চুনতির দক্ষিন দিকে খাল পার হয়ে আরেক টু গেলেই আমাদের বাড়ী। আমার আব্বার বড় সাধ ছিল আম – কাঁঠালের বিরাট বাগান সহ বাড়ী করবেন। শুরু করেছিলেন ও কাজ। কিন্তু শেষ টা দেখে যেতে পারেন নি। ভয়ঙ্কর কর্কট রোগ আব্বা কে কেড়ে নিয়ে গেলো। আব্বা পৃথিবী ছাড়লেন, কিন্তু চুনতি ছাড়তে পারলেন না। মায়ার বাঁধন বড় শক্ত বাঁধন। আব্বা শুয়ে আছেন চুনতির মাটি তেই। মহান আল্লাহ্ তা’লা আমার আব্বাকে বেহেস্ত নসীব করুন। আমীন। (আমার নানার বাড়ী, বড় মৌলানা সাহেব পাড়া। আমার নানা মরহুম রুহুল্লাহ সিদ্দিকী। আমার তিন মামা মরহুম আমানুল্লাহ সিদ্দিকী, মরহুম হাবিবুল্লাহ সিদ্দিকী, সলিমুল্লাহ সিদ্দিকী। আমার আম্মা’রা চার বোন। বড় খালা মরহুমা সালেকা বেগম, মেঝ খালা নাসেহা বেগম, আমার মা ফরহাত আফজা, ছোট খালা হুসনে জামাল। আমার আব্বা মরহুম আশরাফ আলী চৌধুরী। প্রিয় পাঠক আমার পরিবারের সবার জন্য দোয়া করবেন। )
তোমার লেখায় শেকড় নিয়ে অনেকগুলো স্মৃতির বর্ননা দারুণ লাগলো। আরো লেখা চাই।
Make sure you enter the(*)required information