আলহামদুলিল্লাহ, মাদ্রাসায় কামিল পর্যন্ত অধ্যয়ন করে জীবনে যা লাভ করেছি তা অনন্য, অসাধারণ, অতুলনীয় এবং এক বাক্যে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি (achievement)। সংগত কারণেই বিশ্বাস করি, আরবী ভাষায় সরাসরি কুরআন, হাদীস, তাফসীর ও ফিকহ্সহ ইসলামী শরী'আহর অন্যান্য বিষয়ে জানতে পারাটা আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। যতদূর মনে পড়ে, মাদ্রাসায় পড়ার কারণে কোনদিন এক মুহুর্তের জন্যও হীনমন্যতায় ভুগিনি, বরং বারবার নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছি। যাঁদেরকে মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালীন সময়ে বা পরবর্তীতে যে কোনো কারণে নিজেদের পরিচয় লুকাতে দেখেছি কেন জানিনা তাঁরা সাফল্যের পথ পেরিয়ে বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেননি ঐসব সতীর্থের তুলনায় যাঁরা মাদ্রাসায় অধ্যয়নকে শুধু যে খাটো করে দেখেননি তা নয়, আজীবন এর সাথে নিজের সংশ্লিষ্টতাকে জীবনের পুঁজিও মনে করেছেন। শুধু কি তাই? প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ও নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে কর্মজীবনে তাঁরা তা প্রমাণও করেছেন। বলা বাহুল্য, যাঁরা হীনমন্যতার দরূন পরিচয় সংকটে (identity crisis) ভূগেন তাঁরা এক ধরনের কাপুরুষ। আমি নিজের কথাই বলি, যদিও এটি আত্মপ্রচারের পর্যায়ে পড়ে যায়। জীবনে সফল হওয়ার বিষয়টি আপেক্ষিকই বটে, তাই আমার সফলতা অন্যান্য অনেকের জন্য গৌণ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সে যাই হোক, আমি জীবনের মোক্ষম সময়টি (মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের বছরগুলো বাদ দিলে সর্বসাকুল্যে সতের বছর) মাদ্রাসায় অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করার কারণে আল্লাহর তায়ালার বিশেষ রহমতে আমার পারিবারিক শিক্ষক পরম শ্রদ্ধেয় মা-বাবা, বড় ভাই এবং উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথাক্রমে চুনতী হাকীমিয়া ও দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম-এর স্বনামধন্য শিক্ষক মহোদয়ের নিকট থেকে (যাঁদের মধ্যে উস্তাদুল আসাতিযাহ হযরত মওলানা মুযাফ্ফার আহমদ, মওলানা আব্দুর রশীদ, মওলানা ফযলুল্লাহ, মওলানা মুহাম্মদ আমীন, মওলানা শফীক আহমদ, মওলানা আহমদুল্লাহ, মওলানা কামালুদ্দিন, মওলানা কাছেম, মওলানা আহমদ কবীর, মুফতি ও মুহাদ্দিস্ মওলানা মুহাম্মদ আমীন, মুহাদ্দিস্ ওলানা মুতীউর রহমান নিজামী এবং মুহাদ্দিস্ মওলানা ইসমাইল আরকানী রাহিমাহুমুল্লাহ এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য) ইসলামের মৌলিক জ্ঞানের যে মূল্যবাণ মণি-মুক্তা আহরণ করতে পেরেছি তার অনেক কিছুই পাথরে খোদাই করা নকশার মতো আমার স্মৃতিতে এখনো অমর হয়ে আছে العلم في الصغر كالنقش في الحجر । বলতে দ্বিধা নেই যে, বাল্যকালের সেই আহরিত জ্ঞানই আজ অবধি আমার একমাত্র পুঁজি (asset), দিকনির্দেশনা, এবং এটি আজীবন আমার জীবন চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ। এটি 'পেলেও পেতে পারেন' জাতীয় প্রাপ্তি নয়, বরং 'নিঃসন্দেহে এটি একটি অমূল্য রতন'। আল্লাহর ইচ্ছায়, মাদ্রাসার সেই বরকতপূর্ণ ইসলামী জ্ঞানের হাতেখড়ি ও মূলভিত্তি (fundamentals) আমাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে বলে যৌক্তিক কারণেই বিশ্বাস করি। কেউ কেউ মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করার কারণে নিজেদেরকে কর্মজীবনে অসফল মনে করেন। মাদ্রাসার ডিগ্রী থাকার কারণে অনেকে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোন চাকরি পাচ্ছেননা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রতি অনেক ক্ষেত্রে বিমাতাসূলভ আচরণের ফলে এটি অনেকাংশে সত্যও। এ ব্যাপারে আমি বলবো, সকলেই চাকুরীজীবি হতে চাইলে আমাদের মতো কয়েক কোটি বেকারের দেশে চাকরির সংকট হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে আপনি একজন উদ্যোক্তা হবার চেষ্টা করুন, অথবা ঘরে বসে অনলাইনে যে কোন ছোট খাট ব্যবসা শুরু করতে পারেন। মোটকথা, দৃঢ় মনোবল, যোগ্যতা ও মাথায় উদ্ভাবনী চিন্তা থাকলে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এ চরম উৎকর্ষের যুগে অনেক কিছুই অর্জন করা যায়। এবার আসল কথায় ফিরে আসা যাক। যাঁরা মনে করেন, মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে তাঁদের জীবনটাই 'ষোল আনা মিছে', তাঁদের ব্যাপারে বলবো, এ সব মাদ্রাসা-পড়ুয়া ভাইদের এটি মনে করার পেছনে সাধারণত দু'টি ব্যাধি সক্রিয়ভাবে কাজ করে। প্রথমত, হীনমন্যতার জটিলতায় (inferiority complex) ভোগা;আর দ্বিতীয়টি, যেটি সম্ভবত তাঁদের ভিতর প্রথম রোগের উপসর্গ বিরাজমান থাকার কারণে, মাদ্রাসার পড়াশোনায় আন্তরিক ও মনোযোগী না হওয়ায় ভালো ফলাফল বা ইসলামের মৌলিক বিষয় সমূহের উপর নিজেদের জ্ঞানের ভিতকে সুদৃঢ় করতে না পারা। ফলে অপূর্ব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এ অমূল্য ভান্ডার থেকে নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য অনেক কিছুই সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু আশ্চর্য জনক হলেও সত্য যে, এদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের এ ব্যর্থতার দায়ভার গোটা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর চাপাতে চান। এটি স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের দেশের কোন শিক্ষা ব্যবস্থাই ত্রুটিমুক্ত নয়। এর মধ্যে নানা কারণে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অধিকতর ত্রুটিপূর্ণ। তবে এ নিরেট সত্যটি সম্পর্কে আমরা কমবেশি সকলেই অবগত আছি যে, ব্যক্তিগত সাফল্য ও অর্জনের সিংহভাগ নির্ভর করে নিজের প্রাণান্তকর সাধনা ও নিরলস অধ্যবসায়ের ওপর, যদিও অনেকাংশে এর ভিত রচিত হয় পরিবেশ, মা-বাবা, গৃহ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের সাহায্যে । এ পরিণত বয়সে উপনীত হয়েও আমাকে দৈনিক কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা লেখা পড়া করতে হয় নিজেকে নিত্য পরিবর্তনশীল পেশাগত জ্ঞানের সাথে নিয়মিত আপডেট রাখার জন্য। তাই নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের কোন বিকল্প নেই। দয়াময় প্রভু আমার! দয়া করে আমার জ্ঞানের পরিধিকে সমৃদ্ধ করে দিন।
Make sure you enter the(*)required information