বেশি সুসময়ে আমাদের মা তাঁর সংসারে আসেননি। আমাদের দাদা সুলতান আহমদ ১৯৫৭ সালে মারা গেলেন আর একি সালে বাবা আফতাব উদ্দিন কৃতিত্বের সাথে ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষা পাস করলেন (মেধা তালিকায় ৩য়)। কিন্তু সাংসারিক চাপে পড়াশোনায় অনিয়মিত হয়ে গেলেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেলেও সাংসারিক দায়দায়িত্বের কারনে ভর্তি হতে পারেননি)। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৬০ সালে লোহাগাড়া আমিরাবাদের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, কক্সবাজার- চট্টগ্রাম রুটের অন্যতম প্রথম পরিবহন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা, লোহাগাড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শরিয়ত উল্লাহ মুন্সি'র কন্যা নুরুন্নাহার বেগমের সাথে বাবার বিয়ে হয়।আমাদের বাবারা যেমন ১ ভাই ও ৭ বোন (অবশ্য আমাদের দাদার ভাই বিশিষ্ট ভূস্বামি ওয়াদুদ সিকদার দাদার ছেলে/মেয়েরা অর্থাৎ মওদুদ ভাই/হেলাল, জোনায়েদ এর বাবারা ও মোহাম্মদ ভাই/সুলতান ভাইদের মায়েরাও আপন চাঁচা/ফুফুই), আমার মায়েরাও ৬ বোন ও ৮ ভাই। ভাই-বোনদের মধ্যে মা ৪র্থ জন ছিলেন। বোন হিসেবে বিয়ের আগে মা তাঁর ছোট ভাই-বোনদের একটু বেশিই আগলে রাখতেন শুনেছি। আমাদের ছোট দুই মামার বাচ্চাকালে ভয়ংকর জ্বর হয়েছিল। শরীরে 'গোটা' উঠে ক্ষত হয়ে যেত। মা'র বয়স তখন কতইবা, ১২/১৩, তিনি তাদের কোলে নিয়ে আগলে রাখতেন। বড় সংসার, বাড়িতে প্রতিদিন হরেকরকমের মেহমান-অতিথীদের যাতায়াত, তাই নানী'র ব্যস্ততায় মা ছোট ভাইবোনদের তদারকি করতেন। এর মধ্যেও মায়ের বন্ধু জগত ছিল। নুরুন্নিছা (খসরু ভাই এর মা), শামিলা খালা (জসিম উদ্দিন ভাই এর মা) ও সেলিম ভাই এর মায়ের সাথে মায়ের বন্ধুত্ব বেশি ছিল। তারা এক সাথে স্কূলে যেতেন (শামিলা খালা অনেক সিনিয়র ছিলেন), খেলা করতেন। বাল্য জগতে এত বড় পারিবারিক চাপে তাদের বন্ধুত্ব মায়ের জন্য 'রিলিফ'ই ছিল। ১৩/১৪ বৎসর বয়সে মা'র বিয়ে হয়ে যায়। এক বড় সংসার থেকে, আরেকটি বড় সংসার, তাও আবার আর্থিক অবস্থা পড়তির দিকে। মা এসেই শ্বশুর বাড়ির হাল ধরলেন। আমাদের নানাবাড়ি ও দাদা বাড়ির দুরত্ব ৭/৮ কিলোমিটার। মামা-খালারা প্রায়ই আসতেন, বিশেষত ছোট কয়েকজন মামা চুনতিতে ফুটবল খেলতে আসতেন। নানা প্রায়ই মায়ের জন্য ঐ সময়ের ভালো, উন্নত খাবার ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী পাঠাতেন। বড় ভাই (পারভেজ ভাই), আপা (শেলী আপা) হওয়ার পর নানা মাঝে মাঝে সন্দেশ, ক্যান্ডি, সমুচা এগুলো পাঠাতেন। মা গ্ৰামের প্রতিবেশীদের সাথে এগুলো শেয়ার করতেন। চুনতিতে মায়ের একটি জগত তৈরি হয়, তিনি কয়েকজন বান্ধবী পান (আমেনা ফুফু, Sajjad Khan ভাই এর মা মুসলিম খান চাচী, Helal Uddin Mohammed Alamgir এর মা, মওদুদ ভাই এর খালা নকিব খানের মা সহ আরো অনেকেই)। আব্বা এসময় চকরিয়ার বদরখালী ও আগ্ৰাবাদ সরকারি কলোনী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আব্বা পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বন্দর স্কুলে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পর আব্বা পরিবারকে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের আবাসিক এলাকায় আসেন। এখানে আমাদের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু। মাকে আরেক সংগ্ৰামে নামতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতার পর পর চট্টগ্রাম শহরে আত্মীয় স্বজনদের তেমন কেউ থাকতো না । তাই দেশের বাড়ি হতে নানা-দাদাদের গোষ্ঠীর সবাই যে কোন উপলক্ষে আমাদের বন্দরের বাসায় উঠতো। এখানে থেকে স্কুল/কলেজে পড়াশোনা করা, এখানে থেকে চিকিৎসা করানো, বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠান হওয়া , কোনটি বাদ ছিলো ?? এগুলোর জন্য আম্মাকে রাতদিন খাটতে হতো। এখন বাসায় একজন অতিরিক্ত মেহমান আসলে আমরা হাঁপিয়ে উঠি। আর ঐ সময়ে আমাদের বাসায় সারা বছর কেউ না কেউ থাকতো, কিছু না কিছু অনুষ্ঠান হতো (আমরা উপভোগ করতাম আর আব্বা-আম্মাকেও দেখতাম কষ্টের মধ্যেও আতিথেয়তা উপভোগ করতে)। অবশ্য ঐ সময়ের প্রতিবেশীদের সহযোগিতা ছিল অকল্পনীয়, যা দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিতে ভালো নিয়ামক হিসেবে কাজ করতো। প্রতিবেশী গৃহবধূদের (এরফান স্যার, ভাই সাহেব ফরিদ স্যার, ভাই এশফাক স্যার, মওলা স্যার, জেঠা মশাই ওসমান স্যার ,ফজলুল হক স্যার এর স্ত্রীগন, সেতু ভাই এর আম্মা প্রমূখ) মধ্যে গড়ে উঠা বন্ধুত্ব অতুলনীয় ছিল।আব্বার সীমিত উপার্জন (পরে বড় ভাই এর উপার্জন যোগ হয়) কিংবা মাঝে মধ্যে মামাদের/খালা (লাকির আম্মা)র নানা সহযোগিতার মধ্যে দিন চলে যেত। তবে আম্মার পরিশ্রম ঐ সময়ের কোন কিছুর মাধ্যমে বিনিময়যোগ্য ছিলোনা। সকালে উঠে নাস্তার জন্য চুলা তৈরি করা (তখন ভূষির চুলা বিশেষ প্রক্রিয়ায় আগের রাত থেকে তৈরি করতে হতো), রুটি, ভিন্ন পদের খাবার বানানো (তখন কাঁকন চাল বা, অন্য চালের গুঁড়া গুড়/চিনি দিয়ে জাউভাত তৈরি, বিন্নি চালের মধুভাত, তেল পিঠা, ভাপা/আতিক্কা/জ্বালা পিঠা, গুরা পিঠা, আগের রাতের ভাতের সাথে হলুদ/মরিচ মিশ্রিত এক ধরনের ফ্রাইড রাইস ইত্যাদি), শবে বরাত/কোরবানিতে আত্মীয় স্বজনদের জন্য শত কষ্টের মধ্যেও বিশেষভাবে তৈরি খাবার পাঠানো, আহহহ্্ , আরো কতো কি ....! এতো সীমিত উপার্জন/উপকরণ দিয়ে 'মা' এতো কিছু কিভাবে সামলাতেন, করতেন--আমরা কিছুই বুঝতে পারতাম না । এখন বুঝি। এখনকার আমলে আমাদের সে যুগের মায়েদের মূল্য কল্পনারও বাইরে। প্রতিদিনের এই মধ্যবিত্ত পরিবারের হাল চালাতে গিয়ে, আম্মা ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন 🙁 দৈনন্দিন এই বেহিসেবি চাপ আম্মার মধ্যে মারাত্মক রোগ 'পারকিন্সন' এর অনুপ্রবেশ ঘটায়। ৩০/৩৫ বছর এর এই রোগ নিয়েই আম্মা ২০২১ সালের ১৪ মার্চ ঢাকার শ্যামলি ষ্পেশালাইজড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের অর্থাৎ নানা শরিয়ত উল্লাহ ও দাদা সুলতান আহমদ/ওয়াদুদ শিকদার পরিবারের বড় এই পারিবারিক স্তম্ভ বিদায় নিলেন। মায়ের আতিথেয়তাপূর্ন, দরদ/আন্তরিক মাখা, বিরক্তিহীন মানসিকতা দিয়ে এক গ্লাস সিরকা বা লেবুর শরবত, একটি ডিম পোচ, কয়েক পিছ বিস্কুট, এক কাপ চা দিয়ে সময়ে-অসময়ে আগত অতিথি আপ্যায়ন অথবা রাতে আচমকা আগত অতিথির জন্য যত্নে রান্না করা সাধারণ ভাত-তরকারির আয়োজন আমাদের এই বড় পরিবারের সদস্যরা ভবিষ্যতে কদাচিৎ দেখবে বা দেখবে কিনা সন্দেহ ।।এমন একজন বিদূষী মহিলাকে মা, খালা, ফুফু, চাচী কিংবা বোন--এক অর্থে একজন আদর্শ গৃহবধূ হিসেবে আধুনিক সমাজে পাওয়া খুবই কঠিন। আজ মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। মায়ের জন্য সকলের দোয়া কামনায়।ওয়াহিদ আজাদ ; ১৪ মার্চ '২২
Make sure you enter the(*)required information