সাদাকাতুল ফিতরের হুকুম (ruling) বা নির্দেশ:সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা প্রত্যেক মুক্ত ও স্বাধীন মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক (compulsory) বা অবশ্য পালনীয়।এই নির্দেশের শরয়ী ভিত্তীঃসকল ওলামায়ে কেরাম নিম্নলিখিত হাদীস সমূহকে সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের উপরিউক্ত হুকুমের ভিত্তি বলে মত প্রকাশ করেনঃ ১. আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক মুসলিমের জন্য, যিনি দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকুন বা মুক্ত ও স্বাধীন হোন, পুরুষ কিংবা মহিলা, (বয়সে) যুবক বা বৃদ্ধ হোন সকলের উপর যাকাতুল ফিতর হিসাবে এক সা' পরিমাণ খেজুর, বা এক সা' পরিমাণ বার্লি প্রদান করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি এঁদেরকে ঈদুল ফিতরের নামায আদায়ের আগেই সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার আদেশ দিয়েছেন। (সহীহ আল্ বুখারী, ১: ৪০৯)২. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, “মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদাকাতুল ফিতরের অর্থ প্রদানকে ওয়াজিব (অবশ্য পালনীয় বিধান) বলে ঘোষণা করেছেন। কেননা, এটি রোযাদার ব্যক্তিকে যে কোনও অশ্লীল আচরণ বা বাক্য ব্যয় থেকে পবিত্র করে। শুধু তাই নয়, এটি দরিদ্রের মুখে অন্ন পৌঁছে দেবার উৎস। যখন এক ব্যক্তি (ঈদুল ফিতরের) নামাযের আগে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করেন তখন এটিকে একটি গ্রহণযোগ্য দান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আর যদি তিনি তা ঈদের নামাযের পর আদায় করেন তখন এটি একটি সাধারণ দান হিসাবে গণ্য হবে।" (সুনান আবু দাউদ, পৃঃ ২৬৩)সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার উপরিউক্ত বিধানের (হুকুম) সমর্থনে প্রায় একই ধরনের আরো অনেকগুলো বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায়। ৩. সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হবার শর্তাবলীঃক) ইসলাম: প্রধান চারটি সুন্নী মাযহাব অনুসারে সাদাকাতুল ফিতর আদায়কারী ব্যক্তির মুসলিম হওয়া একটি অন্যতম পূর্ব শর্ত। (শারহ্ ফাতহুল কাদীর, ২ঃ২৮৬) খ) মুক্ত (অর্থাৎ দাসত্ব বা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ না) থাকা। সমস্ত ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে একমত যে, দাস বা পরাধীন ব্যক্তির উপর সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। (সূত্র: প্রাগুক্ত)। গ) সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট নিছাবের মালিক হওয়া। এ শর্তটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়। তিনি বলেছেনঃ "সাদাকাহ (আদায়) স্বচ্ছল ও সামর্থ্যবান ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারোর উপর বাধ্যতামূলক নয়।" (মুসনাদ আহমদ, ১০:৭)। এখানে নিছাব threshold) বলতে যা বুঝানো হয়েছে তা হলো, কারো উপর সাদাকাতুল ফিতর বাধ্যতামূলক হওয়ার জন্য ন্যুনতম নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া আবশ্যক। অর্থাৎ কারো কাছে এ নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে কম সম্পদ থাকলে তিনি সাদাকাতুল ফিতর আদায়ে বাধ্য থাকবেননা।নিছাব নির্ধারণে হানাফী মাযহাবের মতামত অন্যান্য মযহাব থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। মালেকী, শাফিঈ এবং হান্বলী মাযহাব অনুসারে, যাঁর নিকট নিজের এবং তাঁর উপর নির্ভরশীলদের (dependents) জন্য ঈদুল ফিতরের রাত ও দিনের জন্য ব্যয় নির্বাহের পর উদ্বৃত্ত থেকে যায়, তিনি সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে বাধ্য থাকবেন। (মাওয়াহিব আল-জলীল, ৩ঃ ২৫৭; মুগনী আল-মুহতাজ, ১ঃ ৫৯৪; আল-মুগনী, ৪ঃ ৩০১) সাদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ নির্ধারণে যাকাতের সম্পৃক্ততা অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে যে, কোন কোন বর্ণনায় সাদাকাতুল ফিতর 'যাকাতুল ফিতর' হিসেবে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ, সহীহ আল-বুখারীতে আবদুল্লাহ ইবনে উমরের (রঃ) বর্ণনায় যাকাতুল ফিতর শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও, সহীহ মুসলিমে আবু সা’দ আল খুদরীর বর্ণনায়ও একই পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং, উপমা ও পরোক্ষ অর্থে বা ইংগিতের সাহায্যে আমরা উপসংহারে পৌঁছাতে পারি যে, সাদাকাতুল ফিতর ও যাকাতের নিছাবের পরিমাণ দুটোই সমান।নীতিগতভাবে, হানাফী মাযহাবের ভিত্তিতে তিন প্রকারের নিছাব বিদ্যমান রয়েছে, এবং প্রতিটি নিছাবের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হুকুম বা বিধান প্রযোজ্য। ১। কি পরিমান সম্পদের মালিক হলে যাকাত প্রদান আবশ্যক? ৬১২.৩৬ গ্রাম রৌপ্য বা তার সমপরিমান অর্থের কোনো উৎপাদনশীল সম্পদের অধিকারী হলে। এই নিছাবের জন্য এমন সম্পদের মালিক হওয়া প্রয়োজন যা বৃদ্ধি ও এবং বিকাশ লাভ করতে সক্ষম। মূলতঃ যাকাতের বিধান এমন উৎপাদনশীল প্রকৃতির সম্পদের উপর প্রযোজ্য যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, যে সব পশুর মালিকানা যাকাতযোগ্য সেগুলো হলো, বংশ বিস্তার লাভ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সক্ষম উট, গরু এবং ভেড়া। যেহেতু এই পশু সম্পদগুলো উৎপাদনশীল প্রকৃতির এবং এর বৃদ্ধি চক্ষু দ্বারা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব, সুতরাং তাদের উপর যাকাত আদায় ফরয। অন্যান্য উৎপাদনশীল প্রকৃতির সম্পদ যার উপর যাকাত ফরয তার কারণ অন্তর্নিহিত বা স্বভাবসিদ্ধ (হুকমান)। এধরনের সম্পদে প্রকৃত সম্পদটি বহুগুণে বৃদ্ধি পায় না ঠিকই, তবে এটিতে স্বভাবসিদ্ধভাবে উৎপাদনশীল হওয়ার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে। এ জাতীয় সম্পদে লাভজনক আয় বা রিটার্ন যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সুতরাং নগদ অর্থের ন্যায় স্বর্ণ ও রৌপ্য এই ক্যাটাগরির সম্পদের অন্তর্ভুক্ত।২। দ্বিতীয় ধরণের নিছাব হলো, কোন ব্যক্তি তার নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অতিরিক্ত এ পরিমাণ সম্পদ অর্জন করা যার মূল্য ৬১২.৩৬ গ্রাম রৌপ্যের সমতুল্য। যিনি এই পরিমাণ সম্পদের মালিক তাঁর জন্য নিম্নলিখিত বিধান সমূহ প্রযোজ্য।ক) তার জন্য সাদাকাতুল ফিতর আদায় বাধ্যতামূলক। খ) তিনি যাকাত গ্রহণ করতে পারবেননা। অর্থাৎ তাঁর জন্য যাকাত নেয়া অবৈধ। গ) তাঁর জন্য কুরবানী করা (উদহিয়া) ওয়াজিব। ঘ) তাঁর পরিবারের ভরন পোষন বা আর্থিক রক্ষণাবেক্ষণ তাঁর জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।এই প্রকার নিছাবের জন্য উৎপাদনশীল প্রকৃতির সম্পদের অধিকারী হওয়া জরুরী নয়। আর কোন পণ্যের ব্যবসা করারও প্রয়োজন হয় না। একইভাবে প্রথম প্রকার নিছাবের বিপরীতে এক পূর্ণ চন্দ্র বর্ষ ব্যাপী এই পণ্যগুলোর মালিক হওয়া ও শর্ত নয়। যিনি এ পরিমাণ নিছাবের মালিক হবেন তাঁকে অর্জিত সম্পদের যাকাত আদায় করতে হবেনা, তবে হাঁ, তাঁকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে।৩। সর্বশেষ নিছাবের পরিমাণ হচ্ছে এক দিনের সম্পদের মালিকানা প্রাপ্তি। কারো কারো মতে, এটি ৫০ দিরহাম (১৫৪.০৯ গ্রাম রৌপ্য) এর মালিক হওয়া।এই পরিমাণ সম্পদের মালিকানা প্রাপ্তির ফলে তিনি, ক) ভিক্ষাবৃত্তি করতে পারবেন না।খ) কিন্তু যাকাত গ্রহণ করার অনুমতি প্রাপ্ত হবেন।তদুপরি, এই নিছাবের মালিক সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করতে বাধ্য হবেন না। শুধু তাই নয়, তাঁকে কুরবানিও করতে হবে না। (আশরাফুল হিদায়া, ৩ঃ ১৬১) মোদ্দা কথা হচ্ছে, হানাফী মাযহাব মতে, কারো উপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য তাঁর নিজের মৌলিক চাহিদার উদ্বৃত্ত স্বরুপ এমন সম্পদের মালিক হওয়া প্রয়োজন থাকতে হবে যা ৬১২.৩৬ গ্রাম রৌপ্যের মূল্যের সমমান।★ কোন কোন ব্যক্তিকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে?চারটি সুন্নী ফিকহী মাযহাব অনুসারে, উপরে বর্ণিত সকল শর্তাবলী যে কোন ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য হলে তাঁকে নিজের ও তাঁর অধীনে থাকা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে ও মেয়েদের পক্ষে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে হবে।ইমাম আলাউদ্দীন আল্ হাছকফী উল্লেখ করেন, যে কোন মুসলিমের উপর উপরিউক্ত শর্তাবলী প্রযোজ্য হলে তিনি নিজের এবং তাঁর নির্দিষ্ট নিছাবের মালিক নয় এমন অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের পক্ষে সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করতে বাধ্য থাকবেন। একই বিধান ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। (আল্ দুররুল মুখতার, পৃঃ১৪০) নির্দিষ্ট নিছাবের মালিক অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়েদের পক্ষে তাদের অভিভাবকেরা তাদের সম্পদ থেকে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করতে পারবে। (ফতাওয়া আল্ হিন্দিইয়্য়াহ, ১ঃ ২১১)স্বামীর উপর তাঁর স্ত্রীর এবং প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের পক্ষে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কারণ, সাদাকাতুল ফিতরের বিধান একমাত্র তাদের জন্যই প্রযোজ্য যাদের উপর তা প্রদানকারী ব্যক্তির পূর্ণ অভিভাবকত্ব এবং আর্থিক ভরণ পোষণের দায়-দায়িত্ব রয়েছে। তাই যেহেতু এক ব্যক্তি তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের একচ্ছত্র অভিভাবক এবং এদের সমস্ত ভরণপোষণের দায়িত্ব তাঁরই, তাই তিনিই তাদের পক্ষ থেকে সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করতে বাধ্য থাকবেন। তবে হাঁ, একজন পুরুষ তাঁর স্ত্রীর একচ্ছত্র অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত নন এবং স্ত্রীর সকল প্রকার ভরণপোষণের দায়িত্বও তাঁর উপর অর্পিত হয়না। স্ত্রীর উপর স্বামীর অভিভাবকত্ব ও রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কিত দায়িত্বের আওতা শুধু মাত্র পারস্পরিক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ থাকার কারণে যে কর্তব্য পালন আবশ্যক তার মধ্যে সীমিত। তদ্রূপ, স্বামীর যেসব কর্তব্য তার স্ত্রীর উপর বর্তায় তা হলো তার স্বাভাবিক জীবন ধারণের ব্যয়ভার বহন, পরিধেয় পোশাক সরবরাহ, খাদ্যদ্রব্য এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। এগুলোর বাইরে স্বামীকে তার স্ত্রীর কোন ব্যয়ভার বহন করতে হবে না।একইভাবে, একজন বাবা তাঁর প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের একচেটিয়া অভিভাবক নন; তাদেরকে বালেগ (প্রাপ্তবয়স্ক) হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া, পিতা তাঁর এই সন্তানদেরকে আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করতে বাধ্য নন। যেহেতু এ ক্ষেত্রে সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দু'টি উপাদানেরই ঘাটতি বিদ্যমান, সুতরাং স্বামীর উপর তাঁর স্ত্রীর, এবং বাবার উপর তাঁর সন্তানদের পক্ষে সাদাকাতুল ফিতর আদায় বাধ্যতামূলক হবে না।উপরিউক্ত আলোচনার ভিত্তিতে এটি প্রতীয়মান হয় যে, স্বামী তাঁর স্ত্রীর পক্ষে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করলে তা জায়েয (বৈধ) হবে। একইভাবে, পিতা তাঁর প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েদের পক্ষে ফিতরার অর্থ প্রদান করতে পারবেন। (শারহ্ ফাত্হুল কাদীর, ২ঃ ২৮৯-২৯০) বিবাহিতা বা অবিবাহিতা মহিলা যদি সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের জন্য প্রযোজ্য নিছাবের মালিক হন তখন তাঁর উপর ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। (ইমদাদুল্ ফতাওয়া, ২ঃ ১১০) তদ্রূপ, প্রাপ্তবয়স্ক নিছাবের মালিক প্রত্যেক ছেলে-মেয়েদের স্বস্ব সাদাকাতুল ফিতরের অর্থ নিজেকেই প্রদান করতে হবে। উল্লেখ্য যে, কোনও পুরুষকে তাঁর পিতা-মাতা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ভাইবোন এবং আত্মীয় স্বজনের পক্ষে সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করা অত্যাবশ্যকীয় নয়। তবে হাঁ, যদি তিনি তাদের পক্ষে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করে থাকেন তাহলে তা বৈধ বলে বিবেচিত হবে। (আল্ ফিকহুল্ ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু, ২ঃ ৯০৩)উপসংহারে, প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর সাদাকাতুল ফিতর প্রদান ওয়াজিব, যদি এ সম্পর্কিত সকল শর্তাবলী তাঁদের জন্য প্রযোজ্য হয়। সাদাকাতুল ফিতর কি দিয়ে আদায় করতে হবে?ইসলাম এমন এক জীবন বিধান যা স্থান-কাল ভেদে সর্বাবস্থায় অনুশীলনযোগ্য। এর অধিকাংশ বিধি-নিষেধের ভিত সহজ, সরল ও সাদামাটা উপাদানের উপর প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণস্বরূপ, সিয়াম (রোযা) পালনের দিনক্ষণ (সূচনা ও সমাপ্তি) চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। তেমনি সালাতের (নামাযের) সময় নির্ধারণের বিষয়টি সূর্যের অবস্থানকে কেন্দ্র করে সম্পন্ন করা হয়। তদ্রূপ, রোযা পালনের সময়কাল চূড়ান্ত করা হয় ভোরের উদয় ও সূর্যের অস্ত যাওয়ার উপর ভিত্তি করে। অন্য দিকে, একজন বিবাহিত ব্যাভিচারীর সাজা কার্যকর করার অন্যতম উপাদান অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সাপেক্ষে তার উপর প্রস্তর নিক্ষেপ। তদ্রূপ, ইসলামী আইনের নীতিমালার আলোকে কোন কোন আর্থিক অনুদানের মূল্য নির্ধারণ করা হয় খাদ্যদ্রব্য ও ব্যাপকভাবে উৎপাদিত শস্যাদির বাজারে সহজলভ্যতার উপর। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেছেন, “আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে সকল প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক, মুক্ত ও স্বাধীন এবং দাস-দাসীর পক্ষে যাকাত আল ফিতর দিতাম, এবং যা ছিল এক সা' পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য, বা এক সা' পরিমাণ পনির, বা এক সা' পরিমাণ বার্লি, বা এক সা' পরিমাণ খেজুর, বা এক সা' পরিমাণ কিশমিশ। (সহিহ মুসলিম ২ঃ১০৬)‘আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে এক সা' পরিমাণ খেজুর, বা এক সা' পরিমাণ যব দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ‘আবদুল্লাহ ইবনে উমর উল্লেখ করেন, পরবর্তীতে সাহাবায়ে কেরাম খেজুর ও যবের পরিবর্তে দুই মুদ্দ (½ সা’) পরিমাণ গম প্রদান করতেন। (সহীহ আল্ বুখারী, ১ঃ ৪১১)শায়্খ বাশার বাকরী আররাবী বিখ্যাত হানাফী সংকলন 'আল্ লুবাবের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেছেন, এক সা' পরিমাণ ৩.২ কেজি। এটি অন্য বিভিন্ন বিবরণ ও ভাষ্য দ্বারা সমর্থিত। সুতরাং, ½ 'সা' ১.৬৩২ কেজির সমপরিমাণ। (আল্ লুবাব ফী শারহিল কিতাব, পৃ. ১৬৮) পূর্বোক্ত হাদিসের ভিত্তিতে ইমাম আল্ কাসানী বলেছেন, একজন ব্যক্তির নিম্নলিখিত পরিমাণে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা উচিত: ১ সা' পরিমাণ বার্লি, বা১ সা পরিমাণ খেজুর, বা½ পরিমাণ গম, বা১ সা পরিমাণ কিশমিশ।(বাদাই' আল্ সানাই', ২ঃ৫৪০)ইমাম ইবনুল হুমাম উল্লেখ করেন যে, সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের জন্য গম ছাড়া অন্য সবকিছুর ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির জন্য ১ সা' পরিমাণ আদায় বাধ্যতামূলক, আর গমের ক্ষেত্রে তা ১/২ সা' আদায় করলে চলবে। তাঁর মতে, এই মতটি হযরত মু'আবিয়া, তাউস, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব, ইবনে যুবায়ের, সাঈদ ইবনে জুবায়ের এবং আরও অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞজনদের দ্বারা সমর্থিত। (শারহ্ ফতহুল কাদীর, ২ঃ ২২৮)উপরে উল্লেখিত মূল খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নগদ অর্থ প্রদান করা শরীয়াহ অনুমোদিত। তবে হানাফী ইমাম মুহাম্মদ আল্ শায়বানির মতে শুধুমাত্র গমের মূল্য আদায় বিবেচনা করা যেতে পারে (যব বা খেজুরের মূল্য প্রদান প্রযোজ্য হবেনা)।(রদ্দুল মুহতার, ৩ঃ ৩২২) অন্তর্নিহিত অর্থ (দিলালাতূন্নাস) দ্বারা পণ্ডিতগণ উল্লেখ করেছেন, সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের লক্ষ্য দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে দরিদ্রের উন্নয়ন সাধন এবং প্রয়োজন পূরণ। এই উন্নয়নের বিধান এবং স্বয়ংসম্পূর্ণকরণের উদ্যোগ নগদ অর্থ প্রদান এবং অন্যান্য পণ্য আদায়ের মাধ্যমে সহজেই সম্পন্ন হয়। সুতরাং, এমন সবকিছু আদায় করা বৈধ হওয়া উচিত যার মূল্যমান বিদ্যমান। অন্য দিকে, যা কিছু ১.৬ কেজি গমের মূল্যের সমমান হবে তাই সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে আদায় করা ওয়াজিব। (আল্ ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু, (২ঃ ৯০৯-৯১০, বাদাই'য়ুস্ সানাই', ২ঃ৫৪৩) মোদ্দা কথা, সাদাকাতুল ফিতর হিসেবে এমন কিছু আদায় শরীয়াহ কর্তৃক অনুমোদিত যার পরিমাণ নির্ভর যোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। অথবা ১.৬ কেজি গমের সমমূল্য প্রদানও শরীয়াহতে স্বীকৃত হওয়া অত্যন্ত যুক্তিসংগত।গমের দাম হিসেব করার সময় সাদাকাতুল ফিতর আদায়কারী ব্যক্তিবর্গ যেখানে অবস্থান করেন সে স্থানে গমের প্রচলিত বাজার মূল্যকে বিবেচনায় রাখতে হবে।ইবনে নুজায়ম আল্ মিসরী বলেন, "যে শহর বা এলাকায় তাঁরা অবস্থান করেন পণ্যদ্রব্যের দামকে সে স্থান অনুসারে মূল্যায়ন করা আবশ্যক।" (আল্ বাহরুর রাইক্, ২ঃ ৪০০) সাদাকাতুল আল্ ফিতর কখন আদায় করতে হবে?সাদাকাতুল ফিতর বিতরণ ঈদুল ফিতরের দিনের [শাওয়াল মাসের প্রথম দিন] ভোর শুরু হওয়ার সাথে সাথে প্রত্যেক নিসাবধারী ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব শেষ হয়ে যায়। (বাদাইউস্ সানাই', ২ঃ ৫৪৪) ঈদগাহ অথবা ঈদের নামাযের জন্য নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হওয়ার আগেই সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করা মুস্তাহাব। (শারহ্ ফাতহুল কাদীর, ২ঃ ৩০৫) ঈদের দিনের পূর্বেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা বৈধ। ‘আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) বলেন, “লোকজন ঈদুল ফিতরের একদিন বা দু'দিন আগেও সাদাকাতুল ফিতর আদায় করত"। (সহীহ আল্ বুখারী, ১ঃ ৪১১) *বর্তমান যুগের প্রেক্ষাপটে সাদাকাতুল ফিতর কয়েক দিন আগেই অগ্রিম প্রদান করা উত্তম। সাদাকাতুল ফিতরের আদায়ের মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে ঈদের দিন দরিদ্রের উপকার সাধন এবং তাদের প্রয়োজন মেটানো। পশ্চিমের মুসলিম সংখ্যালঘু অধ্যুষিত দেশ গুলোতে ঈদের নামাযের অব্যবহিত পূর্বে মসজিদ বা মুছল্লায় সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের যে প্রথা প্রচলিত আছে তা এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। অতএব, আদর্শগতভাবে (ideally) বেশ আগে থেকেই সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করা উচিত যাতে এটি উপযুক্ত সময়েই ফিতরা গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত ও যোগ্য লোকদের কাছে পৌঁছে যায়।* (কিতাবুল ফতাওয়া, ৩ঃ ৩২৩)কেউ কোন কারণে ঈদুুল ফিতরের নামাযের পূর্বে সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী সময়েও তা আদায় করা জায়েয। যদিও বিলম্বিত আদায়কে নিরুৎসাহিত করা হয় এবং তা অপছন্দনীয়ও বটে। (নূরুল ইদাহ, পৃঃ ১৬২) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: "কেউ ঈদের নামাযের আগে সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করলে এটিকে একটি গ্রহণযোগ্য দান হিসাবে বিবেচনা করা হবে, তবে যদি তিনি ঈদের সালাতের পরে তা প্রদান করেন তাহলে এটি একটি সাধারণ দান হিসাবে বিবেচিত হবে।" (সুনান আবু দাঊদ, পৃঃ ২৬৩)বলা বাহুল্য, সাদাকাতুল ফিতর ঠিক কত দিন আগে অগ্রিম আদায় করা যেতে পারে সে বিষয়ে প্রাচীন আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। অগ্রাধিকারযোগ্য অভিমত হলো, এমনকি রামাদান শুরু হওয়ার আগেই সাদাকাতুল ফিতর প্রদান করা যেতে পারে। তবে, রামাদান মাসের মধ্যেই এটি আদায় করা সর্বাধিক অগ্রাধিকারযোগ্য আমল, কারণ মতের পক্ষে সকল ওলামায়ে কেরামের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। (কিতাবুল ফতাওয়া, ৩ঃ ৩৪৩)*কারা সাদাকাতুল ফিতর গ্রহণ করতে পারবেন?*ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে ব্যক্তিগণ যাকাত নেয়ার যোগ্য একইভাবে তাঁরা সাদাকাতুল ফিতরও গ্রহণ করতে পারবেন। নিম্নলিখিত আয়াতটি তার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে।"যাকাত হল কেবল ফকিরের জন্য, মিসকীনের জন্য, যাকাত আদায়কারী ব্যক্তিদের জন্য, (ইসলাম গ্রহণ করার কারণে) যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের জন্য, দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য, ঋণ গ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথের জন্যে, এবং ভ্রমণকারীদের জন্যে। এটি একটি আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।" (সূরা আত্ তওবাহ, ৯ঃ ৬০)আল্ কুরআনের উপরিউক্ত আয়াতটি দ্বারা যাকাতের আটটি খাত প্রমাণিত হয়।১। ফুকারা' বা দরিদ্র সম্প্রদায়। এঁরা সে সব ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্ত যাঁদের নিকট ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোর বাইরে এমন কোনো সম্পদ উদ্ধৃত থাকেনা, যা নিসাবের (৬১২.৩৬ গ্রাম রৌপ্য) মূল্যের সমমান। ২। মাসাকীন বা অভাবী গোষ্ঠী। কোন কোন বিজ্ঞ আলিমদের মতে, এঁরা এমন লোকদের অন্তর্ভূক্ত যাঁদের আর্থিক অবস্থা দরিদ্রদের চেয়েও খারাপ। বলাবাহুল্য, এ পার্থক্যটি নিতান্তই পারিভাষিক, তবে বাস্তবে তাঁদের উভয়েরই নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজন মেটানোর বাইরে এমন কোন অতিরিক্ত ধনসম্পদ নেই যা নিসাবের মূল্যের সমপরিমাণ হবে। ৩। আল্ আ'মিলীনা আলায়হা, অর্থাৎ যাকাত আদায় বা সংগ্রহে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ। মূলতঃ এঁরা সেসব কর্মচারীদের অন্তর্ভূক্ত যাঁদেরকে রাষ্ট্র যাকাত আদায়ের জন্য নিযুক্ত করে থাকে। ৪। মুআল্লাফাতুল কুলুব, বা ইসলাম গ্রহণ করার কারণে যাদের অন্তরে প্রশান্তির সমন্বয় সাধনের প্রয়োজন বিরাজমান। এখাতটি মহানবীর (সঃ) নবুওয়াত প্রাপ্তির অব্যবহিত পরবর্তী সময়ের জন্য প্রযোজ্য ছিল। ইসলামের প্রথম দিকের যুগে যাকাত সরবরাহ করার সুযোগ ছিল। সে সময়ে তিন ধরণের লোককে যাকাতের অর্থ দেওয়া হতো: ক) সেসব অবিশ্বাসীগণকে যাদের ব্যাপারে এটা মনে করা হতো যে, এদেরকে এ অনুদান প্রদান করা হলে তারা ইসলাম গ্রহণ করবে।খ) অবিশ্বাসীদের নেতাদেরকে যাতে তাদের ক্ষতি থেকে বিশ্বাসীদের সুরক্ষা প্রদান করা যায়।গ) যাঁরা সদ্য ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাঁদেরকে। এই অনুদান তাদের মনোবল চাঙ্গা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতো।হানাফী ওলামায়ে কেরামের মতে, এই খাতটি এখন আর কার্যকরী নয়। (শরহ্ ফতহুল কাদীর, ২ঃ২৬৫)৫। দাস মুক্ত করা (ফির্ রিকাব): যাকাতের অর্থ কোন দাস-দাসীকে তার মালিকের কাছ থেকে কিনে মুক্ত করে দেয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এটিও এখন প্রয়োগযোগ্য নয়। ৬। ঋণগ্রহীতা (আল্ গারিমীন): এ খাতটি এমন ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য যে অনেক সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তিনি ঋণের ভারে ন্যুব্জ এবং তার ঋণের পরিমাণ এতই অধিক যে তা তাঁর মোট সম্পদের মূল্যকেও ছাড়িয়ে গেছে। ৭। যাঁরা আল্লাহর পথে নিয়োজিত রয়েছেন (ফী সাবীলিল্লাহ): অধিকাংশ আলেমেদের মতে, এ খাতটি কেবলমাত্র সেই সব লোকদের জন্যই যাঁরা জিহাদে (সামরিক সমরে) নিয়োজিত রয়েছেন। ৮। ভ্রমণকারী ব্যক্তিগণ (ইবনুস্ সাবীল): এ খাতটি সে সব ভ্রমণকারীদের প্রতি ইঙ্গিত বহন করে যাঁরা প্রতিকুল পরিস্থিতির স্বীকার এবং তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত আয় ব্যবহার করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। যেহেতু আজকাল বিশ্বজুড়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই টাকার নাগাল পেয়ে যাওয়া সম্ভব, তাই যিনি ভ্রমণকালিন সময়ে সহজেই তাঁর টাকার সন্ধান পেয়ে যাবেন তিনি যাকাত বা সাদাকাতুল ফিতর গ্রহণ করতে পারবেননা। বর্তমানে কেবল দরিদ্র, অভাবী, ঋণগ্রহীতা, মুজাহিদীন এবং ভ্রমণকারীগণই যাকাত ও সাদাকাতুল ফিতর গ্রহণ করতে পারবেন।-------------------------মূল: মুফতি ফারায ইবন আদম।ভাবানুবাদ: ড. আবু ওমর ফারূক আহমদসহযোগিতায়: মোহাম্মদ তামজীদ হোসাইন।
Make sure you enter the(*)required information