সচরাচর ফোন করা হয় না এমন কারো সেল ফোন নাম্বার খুঁজতে contacts এ প্রবেশ করলেই প্রায়ই আমার মরহুমা মায়ের রবি নাম্বারটা উঠে এসে আমায় ভীষণভাবে নাড়া দেয়, দু'চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।অথচ কাঁদতে চেয়েও আমি ব্যর্থ হই আরবার, আরদিন।সেই মা, জন্ম দিয়ে যিনি আমাদের জন্য পুরো জীবন কেবল ত্যাগ স্বীকার করেছেন নিজের শখ আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে আমাদের চিন্তায় অস্থির থেকেছেন, বিশ্রাম শিকেয় তুলে, প্রায়দিন অভুক্ত থেকে আমাদের পথচেয়ে থাকতেন।প্রচন্ড শারিরীক অসুস্থতার সময়ে ও আমাদের জন্য নিজে পাকঘরে যেতেন-।প্রায় সারাজীবন অভাবে থেকেও মা' কখনো কোন অতিথি কে অবহেলা করেননি- নিজে না খেয়ে তাদের আপ্যায়ন করে তৃপ্ত হতেন।পড়শীদের দুঃখ কষ্টে কাতর হয়ে যথাসম্ভব সাহায্য সহায়তা করতেন, অনেক অসহায় মেয়েকে তিনি নিজ খরচে পাত্রস্থ করেছেন। অনেক ছাত্রকে ও তিনি বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন।পাশাপাশি মা' ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন খাঁটি দেশ প্রেমিক। দেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে, বনবিভাগে বাবার চাকুরী সূত্রে আমরা তখন দিনাজপুরে।বাবা না পারছেন পাকিস্তান সরকারের চাকুরী ছাড়তে না পারছেন চাকুরী করতে। আর্মিদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে তিনি রীতিমতো অসহায়।তেমনি একদিনে, ফরেষ্ট অফিস ষ্টাফ কোয়ার্টার এর একদম কাছে এসে পাকবাহিনীর একটা বড় দল তাবু ফেললো। নেতৃত্বে একজন মেজর আর কয়েকজন জুনিয়র অফিসার। এসেই নাকি বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিলেন- বাবার ছেলে ক'জন,তারা কে কি করে,পড়ে এবং শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে উনার কি ধারণা ইত্যাদি ইত্যাদি।যদিও বাবা শেখ সাহেব এর সাথে একই কলেজে পড়েছেন এবং মোটামোটি বংগবন্ধু সম্পর্কে জানেন তবু তিনি কথা বাড়ালেন না। আমাদের বড় ভাই শাহাবুদ্দিন খান তখন কলেজ পড়ুয়া ছিলেন,সেই তথ্য ও বাবা চেপে গেলেন শুধু বললেন আমার সন্তানরা সবাই স্কুল পড়ুয়া আর আমার সাথেই আছে।এরপর প্রায় প্রতিদিনই আর্মি অফিসাররা ক্যাম্প ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে যেতো। অনেক সময় দেখতাম লাকড়ির চুল্লায় ইয়া বড় বড় সব ডেকসি- বাতাসে মাংসের সুঘ্রাণ। তখন মা বলতেন ওরা সব হামলাকারী,খুনী বর্বর, জালিম।দেখবি বাংগালীরা এদের হটিয়ে দেবে এদেশ স্বাধীন হবেই হবে- ইনশাআল্লাহ। অতি উৎসাহ নিয়ে আমিও মায়ের সাথে সুর মেলাতাম - আম্মা হঠাত আক্রমণ করে ওদের মেরে ফেলা যায় না?মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক ঘটনার আমি ও একজন সাক্ষী কিন্তু মায়ের স্মৃতিচারণে সেই সব কথা উল্লেখ করলে লেখাটা অনেক বড় হয়ে যাবে,তাই পরে না হয় মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা বলবো। তখন মা নিয়মিত রেডিও শুনতেন, সংবাদ পত্রের খোজ করতেন।১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সময় আমরা রাজেন্দ্রপুর ফরেষ্টে।খাদ্যের চরম সংকটে পাখির মতো মারা যাচ্ছে মানুষ। কচু পাতা দূরের কথা লতাপাতাহীন ন্যাড়া প্রকৃতি। কি খেয়ে বাঁচবে মানুষ?জামালপুর থেকে একটা পরিবার এসেছে আমাদের ফরেষ্ট অফিসের সামনে। খাবার চায়, বেশ অনেকদিন ন্যকি অভুক্ত আছে। মা তাদের ভাত খাওয়ালেন।এরপর ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, ভৈরব সহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় প্রতিদিন একটার পর একটা অভাবী পরিবার আসতে শুরু করলো। দেখলে মনে হতো তাঁরা মানুষ নন, কংকাল, জীবন্ত লাশ একেকজন।সপ্তাহ না পেরুতেই প্রচুর ক্ষুধার্ত মানুষে পরিপূর্ণ হলো এলাকা। মা তাদের জন্য যতটা করা সম্ভব এমনকি নিজে না খেয়েও তাদের খাওয়াতেন। পুরনো শাড়ি, সার্ট, লুংগির জন্য সবার কাছে সুপারিশ করতেন।ফিরোজা আসে প্রতিদিন, এসেছে আজও,পাটখড়ির মতো এক হাত, তাও বহু কষ্টে নাড়ায়-খালাম্মা ছাবা অইবো?মুহুর্তে মার বাসন খালি হয়- নীচে এলুমিনিয়াম পাত।শীর্ণকায়ার দু'চোখ বেয়ে আনন্দ উপচায়ভাত খামু আইজক্যা,ভাত!মা ছিলেন একজন ভালো পাঠিকা। ১৯৭৫ পরবর্তীতে, তিনি দস্যু বনহুর পড়ে রোমেনা আফাজের লেখনির তারিফ করতেন। ঢাকায় আসলেই নীহার রঞ্জন, নিমাই,বিমলের বই কিনতেন। ময়মনসিংহ শহরে এলে বেগম পত্রিকার জন্য আমাদের ফুফাতো ভাইদের টাকা দিতেন- যদি বেগম না পাস,তবে যে কোন একটা গল্প উপন্যাসের বই হলে ও চলবে, হোক শরত বা জরাসন্ধ '।মায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলেন ফরহাত জাহান লক্ষী আপা, শাহনাজ শাহীন খালা, আফসানা ফুফু,শাহজাদী আমেনা বেগম আপা, আনছু খালা এবং মাইন্যা খালা।শেষ জীবনে এসে মা' আমাদের বলতেন- সম্ভব হলে গরীব মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করো, যাতে তারা জীবনধারণ করতে পারে, কখনো তাদের অবহেলা করবে না।বিশেষ করে এতিমদের প্রতি মা' বিশেষ খেয়াল রাখতেন, তাদের জন্য মায়ের মন কাঁদতো। কারণ,তিনি নিজে ও ছিলেন একজন বাল্য এতিম।মা যখন শিশু কালে বাবা-মা হারিয়ে এতিম হয়েছিলেন তখন উনাকে পরম যত্নে কন্যা স্নেহে বড় করে চুনতি ডেপুটি বাড়ির কবির উদ্দিন আহমেদ খান ডেপুটির মেঝ পুত্র সাঈদ আহমেদ খান এর সাথে বিয়ে দিয়েছেন যিনি তিনি মায়ের একমাত্র চাচী বেগম ইলিয়াস ছিদ্দীকি, বড় মৌলভী বাড়ি, চুনতি, একজন অসামান্য মহিয়সী নারী।আমার পরম সৌভাগ্য হয়েছে সেই গুণবতী দরদী নানিকে স্বচক্ষে দেখার- একজন অসম্ভব রূপবতী, কল্পনার পরী যেন। অবশ্য নানি আমাকে বিলাতী সাহেব ডাকতেন তাই আমি নানির সামনে পারতপক্ষে আসতে চাইতেম না।এইক্ষণে মায়ের বংশ পরিচিতি কিঞ্চিৎ হলেও আবশ্যক বোধ করছিঃচুনতিতে ছিদ্দীকি বংশের ১ম পুরুষ যিনি ক্রমিক অনুসারে ঐ বংশের ৩৭তম পুরুষ সেই শেখ আব্দুল্লাহর ( পেটান খলিফা) দৌহিত্র গাজীয়ে বালাকোট মাওলানা আব্দুল হাকিম (রঃ) ছিলেন একজন বুজুর্গ আলেম ও ত্যাগী পুরুষ। একজন জ্ঞানী ব্যক্তি ও একনিষ্ঠ মুজাহিদ হিসেবে তিনি শিখদের প্রতিপক্ষ উত্তর ভারতের মুসলমানদের হয়ে ভারত আফগান সীমান্তের বালাকোট নামক স্থানে সংঘটিত সেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পায়ে হেঁটেই তিনি সুদূর উত্তর পশ্চিম দীমান্ত প্রদেশের বালাকোটে উপস্থিত হয়েছিলেন।মাওলানা আব্দুল হাকিম (রঃ) (৩৯ তম) এর স্ত্রী ছিলেন চুনতির শুকুর আলী মুন্সেফের বড় বোন। শুকুর আলী মুন্সেফ এর দাদা ছিলেন আমানত আলী শিকদার আর বাবা গণি শিকদার। চুনতি গ্রামের জন্য যাদের অসামান্য অবদানের কথা আমরা প্রায় সবাই অবগত আছি।যা হোক, মাওলানা আব্দুল হাকিম (রঃ) এর ০৮ পুত্রের মধ্যে ০৭ তম ছিলেন মওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল( ৪০ তম ) যার ১ম পুত্র মুহাম্মদ আব্বাস ( ৪১ তম) স্ত্রী - মছহুদা বেগমের ০৫ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠা আমাদের আম্মা নুজহাত জাহান খান ( ৪২ তম)।২০১৪ খ্রিস্টাব্দে আমাদের আম্মা ইন্তেকাল করেছেন, আল্লাহ যেন মা'কে বেহেশতে স্থান দেন -আমিন।
Make sure you enter the(*)required information