দক্ষিণ চট্টগ্রামের চুনতী সম্ভ্রান্ত বংশে জন্ম লাভকারী হযরত শাহ ছাহেব কেবলা। তাঁর মূল নাম হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ.)। কিন্তু সর্বমহলে তিনি হযরত শাহ ছাহেব কেবলা হিসেবে পরিচিত। ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী প্রতিষ্ঠা করেন। এতে দেশ পেরিয়ে আর্ন্তজাতিকভাবে মহান আশেকে রাসূল হিসেবে খ্যাতিমান। তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। এই সালে তাঁর দাদা হযরত ইউসুফ আলী তাঁর পুত্র হযরত শাহ ছাহেব এর পিতা হযরত সৈয়দ আহমদসহ হজ্বে গেলে, তথায় হযরত ইউসুফ আলী ইন্তেকাল করেন। হযরত সৈয়দ আহমদ দেশে ফিরে আসেন। হযরত শাহ ছাহেব (রহ.)এর জেঠা হযরত শাহ মাওলানা ফয়েজ আহমদ পিতার জমিদারী এস্টেট দেখা শুনা করতে ঘনঘন আরাকানে যাওয়া-আসা করেন। হযরত শাহ ছাহেব কেবলা চুনতীতে ও অন্যখানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে শিক্ষা জীবন শেষ করেন। অতঃপর আরও উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং আরও উচ্চ ডিগ্রী লাভ করেন।তিনি অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। পরিণত বয়সে তিনি ৫০/৬০ বছর আগে ছাত্র জীবনের জ্ঞানার্জন করা আরবি, ফার্সি, কবিতা, এমনকি তফসীর, হাদীস, ফিকাহসহ বিভিন্ন বিষয় মুখস্থ বলতে পারতেন। দেশ বিদেশের প্রখ্যাত আলেমগণ যখনই তাঁর সান্নিধ্যে আসতেন ওনার কোরআন হাদীসের আলোচনা শুনে তারা মুদ্ধ হয়ে একাগ্রচিত্তে তার পানে চেয়ে থাকতেন।হযরত শাহ ছাহেব ছিলেন দুনিয়ার সব ভয় ভীতির উর্ধ্বে। অর্থ সম্পদের উপর তাঁর কোন মোহ ছিল না। ভক্তদের দেয়া অর্থও তিনি গরীব-দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করে দিতেন। ইন্তেকালের সময় তাঁর সঞ্চয় বলতে এক কপর্দকও ছিল না।হযরত শাহ ছাহেব কেবলার শারীরিক গঠন ছিল রাজাদী রাজের মত। তেমনি ছিল তাঁর জ্যোতির্ময় চেহারা।তাঁর দাদা হযরত কাজী ইউসুফ আলী (রহ.)এর বিশাল জমিদারী এস্টেট ছিল আরাকানে। হযরত শাহ ছাহেব কেবলা আরাকানে থাকা অবস্থায় শবে কদরের রাতে ফানাফির রাসূল হিসেবে নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেলেন।দীর্ঘ প্রায় ৩৭ বছর পাহাড়ে-পর্বতে লোকালয়ে বিচরণ করতে থাকেন রাত দিন, নিম্নলিখিত পংক্তি আউড়াতে থাকতেন। তা হল- হাম মাজারে মুহাম্মদ (স.) পে মর জায়েঙ্গে,জিন্দেগি মে য়াহি কাম কর জায়েঙ্গে।(অর্থাৎ) হযরত মুহাম্মদ (স.)এর উদ্দেশ্যে আমার জীবন উৎসর্গিত,সারা জীবন তাঁর ধ্যানেই আমি থাকব নিয়োজিত।এ দীর্ঘ সময় তাঁর পূর্ণবতী স্ত্রী (চাচাত বোন), ১ পুত্র ১ কন্যা সন্তানকে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৬০ এর দশকে এসে তিনি পর্যায়ক্রমে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে থাকেন। তাও কিন্তু শতভাগ নয়। এমনি অবস্থায় তিনি পৈতিৃক বাড়ী থেকে ৩/৪ শত মিটার দক্ষিণে নতুন বাড়ী নির্মাণ করে চলে আসেন। যা শাহ মঞ্জিল হিসেবে সর্বজনের কাছে প্রসিদ্ধ। তিনি ১৯৭২ সালে শাহ মঞ্জিলের দক্ষিণ পাশে সীরতুন্নবী মাহফিলের আয়োজন করেন ১ দিনব্যাপী। ১৯৭৩ সালে ৩ দিন, ১৯৭৪ সালে ৫দিন, ১৯৭৬ সালে ১০ দিন, ১৯৭৯ সালে ১২ দিন, ১৯৭৮ সালে ১২ দিন, ১৯৭৯ সালে ১৫ দিন সে সময় আরও ২ দিন বাড়িয়ে ১৭ দিন, আবার আরও ২ দিন বাড়িয়ে ১৯ দিনে গিয়ে মাহফিল সমাপ্ত হয়। ১৯৮০ সাল থেকে অদ্য অবধি ১৯ দিনব্যাপী এ মাহফিলে সীরতুন্নবী আজিমুশশান হিসেবে চলমান। রবিউল আউয়াল মাসের চাঁদ উঠার পর হতে তিনি বেহাল হয়ে পড়তেন। মাহফিলে সীরতুন্নবীর আখেরী মোনাজাতের পর বেশ কিছুদিন তিনি শোকাহত মনে কান্না জড়িত অবস্থায় থাকতেন।তিনি জীবদ্দশায় মাহফিলে মেহেরাজুন্নবী চালু করেন। সাথে সাথে শবে বরাত, শবে কদর, আশুরা দিবস, ফাতেহা ইয়াজদ্দম আয়োজন করে ছিলেন। শাহ মঞ্জিলের পশ্চিম দিকে প্রায় ১৩ একর এরিয়া নিয়ে বিশাল আকারে মাহফিলে সীরতুন্নবীর ময়দান প্রতিষ্ঠা করেন। এই ময়দানের পশ্চিম পাশে মসজিদে বায়তুল্লাহ নির্মাণ শুরু করে দেয়। তিনি ছিলেন মানব দরদী, মানুষকে ভালবাসতেন। শিশুদের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অপরিসীম। ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবীতে শিশুদের আলাদা খাবারের ব্যবস্থা থাকায় সচ্ছল গরীব হাজার হাজার পরিবারের শিশু এ খাবার খেয়ে থাকেন। তিনি যেমন আত্মীয়ের হকের প্রতি খবর রাখতেন, তেমনি তাঁর অসংখ্য গুণাগুণের মধ্যে অন্যতম একটি হল কৃতজ্ঞতাবোধ। অর্থাৎ অতীতের মূল্যবোধ তাঁর দিলে জাগরুক থাকত। একালে শত ত নয়ই হাজারে কয়জনই বা অতীতকে মনে রাখে। মানুষ কতই না স্বার্থপর। আর হযরত শাহ ছাহেব কেবলা ছিলেন তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অতীতকে মনে রাখেন।তাঁর দাদার জমিদার বাড়ী ইউসুফ মঞ্জিলে মেহমানদারীর জন্য প্রসিদ্ধ। সেই সময় রাতে মুসাফিরকে খাবার প্রদানের জন্যও প্রসিদ্ধ ছিল। এ শাহ মঞ্জিল নতুন বাড়ীতে আজও নিয়মিত মেহমান আসা-যাওয়া জারি রয়েছে।চুনতীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিও ছিল তাঁর দরদ। সেই সাথে অবদান। বিশেষ করে চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসা ফাজিল থেকে কামিল স্তরে প্রতিষ্ঠা করা, মাদ্রাসার অবকাঠামোগত উন্নয়নে হযরত শাহ ছাহেব কেবলার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চুনতী প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুল, মহিলা মাদ্রাসা, ডিগ্রী কলেজে তাঁর কোন না কোনভাবে অবদান খাট করে দেখার সুযোগ নেই।প্রায় ১৩ একর বিশাল এরিয়ার ময়দানে মাহফিলে সীরতুন্নবী বাংলাদেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাড়া জাগায়। বিশ্বে ১৯ দিনব্যাপী ধর্মীয় মাহফিল হযরত শাহ ছাহেব কেবলা প্রথম প্রবর্তন করেন। এই মাহফিলে রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি, স্পিকার, মন্ত্রীসহ দেশ বিদেশের অনেকে অতিথি হয়ে আগমন করেন। অপরদিকে, আলোচক হিসেবে আসেন সৌদি আরবের প্রধান বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত, সারাদেশের অলি, পীর মাশায়েখ মোফাচ্ছের, মোহাদ্দেস, মুফতিগণ ওয়ায়েজগণ ।চুনতীতে রয়েছে যেমনি বাঘাবাঘা শিক্ষাবিদ, তেমনি রয়েছে মহান আল্লাহর অলি দরবেশ। বিশেষ করে হযরত মাওলানা আবদুল হাকিম তাঁর সহোদর ভ্রাতা নাসির উদ্দিন ডেপুটি, শুকুর আলী মুন্সেফ, মাওলানা ফজলুল হক, মাওলানা নজির আহমদ, মাওলানা হাকীম মুনির আহমদসহ অনেকে ।কিন্তু ১৯৭০ এর দশক থেকে মাহফিলে সীরতুন্নবীসহ হযরত শাহ ছাহেব কেবলার কর্ম তৎপরতায় চুনতী গ্রামকে দেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রসিদ্ধতা এনে দেয়।এ মহান আশেকে রাসূল হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ.) ১৯৮৩ সালে ৩০ নভেম্বর তথা ২৪ সফর মাহফিলে সীরতুন্নবীর মাত্র ১৬ দিন আগে নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। সীরত ময়দানে জানাযার পর বায়তুল্লাহ এর দক্ষিণ পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তিনি ইন্তেকাল করে গেছেন ৩৯ বছর হল। কিন্তু ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী সুন্দর সুচারুভাবে চলমান। ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে হাজার হাজার নবী প্রেমিক আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছেন। প্রতি বছর যার অংক হয়ত সর্বসাকুল্যে কয়েক কোটি টাকা হবে।তিনি জীবনে ৬ বার হজব্রত পালন করেন। প্রথমবার ১৯৭০ সালে, ২য় বার ১৯৭২ সালে, ৩য় বার ১৯৭৪ সালে, ৪র্থ বার ১৯৭৬ সালে, ৫ম বার ১৯৭৮ সালে, ৬ষ্ঠ বার ১৯৭৯ সালে।তিনি একাধিকার ভারত সফর করেন। যেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করেন কলকাতা, বান্ডেল, আজমগড়, দিল্লি, আজমীর, মুম্বাইসহ অনেক স্থানে।তিনি ইন্তেকালের ২/৩ বছর আগেও ভারত সফর করেন। এই সফরে ভারত থেকে কলকাতা পৌঁছেন। বান্ডেল গমন করেন হযরত সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনীর যেয়ারতে । বিমানে কলকাতা থেকে বানারস হয়ে আজমগড় গমন করেন। আজমগড় থেকে গোন্ডা যান। আজমগড়ী হযরতের যেয়ারতে তথায় রাত্রি যাপন করেন। পরদিন দিল্লি অতঃপর আজমীর যেয়ারতে গমন করেন।মহান আল্লাহ পাক মাহফিলে সীরতুন্নবী কিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন। সাথে সাথে হযরত শাহ ছাহেব কেবলাকে পরকালে আলা মোকাম দান করুন। আমিন॥সুত্র ঃ দৈনিক পূর্বকোণ, সোমবার, ৩ অক্টোবর ২০২২
Make sure you enter the(*)required information