বিশ্বের ইতিহাসে সুশৃংখল ও বিষয়ভিত্তিক রাসূল সা.এর মীলাদ ও সীরাত আলোচনার ১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলের আয়োজন চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার চুনতী সীরাতুন্নবী সা. ব্যতীত আরেকটি আছে কি না আমার জানা নেই। কুরআন সুন্নাহর আলোচনার পাশাপাশি লক্ষ মানুষের আপ্যায়নের ব্যবস্থাপনা এক বিরল দৃষ্টান্ত। ১৯৭২ সাল থেকে এই পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে আসা এই মাহফিল কুরআনের চলমান মুজিযার একটি অংশ ও অলিকুল শিরোমণি মুজাদ্দিদে মাহফিলে সীরাত হযরত হাফেজ আহমদ (শাহ সাহেব) রাহ. এর জীবন্ত কারামত। আবহমানকাল থেকে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রগামী চুনতীর ইতিহাস ও এতিহ্য ইসলাম প্রচারের ইতিহাসেও সমৃদ্ধ। জানা যায়, বৃটিশ ভারতে বাংলা অঞ্চলে যখন শিক্ষার হার শতকরা ২০, তখন চুনতী অঞ্চলে শিক্ষার হার প্রায় শতভাগ। ১৮৩১ সালে ভারত পাকিস্তানের সীমান্তে সংঘটিত বালাকোটের জিহাদে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী রহ. এর ডাকে সাড়া দিয়ে চুনতীর মর্দে মুজাহিদ হযরত মাওলানা আবদুল হাকিমসহ( গাজীয়ে বালাকোট রহ.) আমিরাবাদ এলাকার মাওলানা সৈয়দ ওয়ারেস আলী (শহীদে বালাকোট রহ.) লোহাগাড়া এলাকাকে ইসলামের জন্য উর্বর ভূমিতে পরিণত করেছেন। হযরত শাহ সাহেব রহ. বলেছেন, চুনতী খাঁর দিঘীর মসজিদ (বর্তমান মিডওয়ে হোটেলের দক্ষিণে চট্ট- কক্স রোডের পশ্চিম পাশে) এলাকায় রাসূল (সা.)এর দু'জন সাহাবীর কবর রয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, চারজন সাহাবী (রিদ.) চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের রামু পর্যন্ত ইসলাম প্রচার করেছেন। তাঁদের অন্য দু'জনের কবর বর্তমান চীনের ক্যান্টন অঞ্চলে রয়েছে। আল্লাহর অলীগণ কাশফের মাধ্যমে সর্বসাধারণের ধারণার বাইরে অজানা তথ্য দিতে সক্ষম, যা তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। শাহ সাহেব রহ.কাশফের জগতে অনেক উচু স্তরের একজন আল্লাহর অলী, এতে কোন সন্দেহ নেই। রাসূল সা. এর সাহাবা ও অলীগণের পদচারনায় মুখরিত এই চুনতীর দ্বীনি বাগান,যা চুনতীর পরিবেশ দেখলেই বুঝা যায়।চুনতী এলাকায় অনেক মাকবুল আল্লাহর বান্দা, অলী,মুহাদ্দিস, মুফাসসির, সমাজ সেবক, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের জন্ম। এই অঞ্চলের আবেদগণ আল্লাহর দরবারে চুনতীকে একটি মকবুল স্থান হিসেবে কবুল করাতে সক্ষম হয়েছেন। পূর্বপ্রস্তুতিসহ টানা ১৯ দিন ব্যাপী সীরাতুন্নবী সা. মাহফিলের চতুর্মাত্রিক আয়োজন শুধুমাত্র টাকা আর শ্রম দিয়ে সম্ভব নয়। এই মাহফিলের উপর রয়েছে আল্লাহর বিশেষ রহমত ও মদীনা মুনাওয়ারা থেকে রাসূল সা. এর বিশেষ সুনজর।খাবার তৈরি ও ব্যবস্থাপনা,পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, জালানী জোগাড়, খাবার পরিবেশনা, আলেম, আলোচক,মেহমান ও দাতাদের যথাযথ আপ্যায়ন ও থাকার ব্যবস্থা,স্যানিটেশন ব্যবস্থা, অজু ও ইবাদতের সুব্যবস্থা ইত্যাদি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। শতশত স্বেচ্ছাসেবক নিজের অর্থ, সময় ও শ্রম দিয়ে প্রতিনিয়ত নির্ধারিত জায়গায় নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন।মাহফিলকে অর্থবহ ও আলোচনা ফলপ্রসূ করার জন্য একদল দক্ষ আলেম ও গবেষক প্রতি বছর আমন্ত্রিত আলোচকগণের বিষয়বস্তু নির্ধারণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। মাহফিলের একেকটা আলোচনার বিষয় যেন এম ফিল ও পিএইচডি করার উপযোগী টপিক, যা ইতোমধ্যে দেশের শিক্ষিত ও গবেষকমহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। চুনতী হাকিমিয়া আলীয়া মাদরাসার শিক্ষকমণ্ডলী ও দেশের বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত চুনতীর সাবেক শিক্ষার্থীগণ এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এরকম সুশৃংখল বিষয়ভিত্তিক আলোচনার ধারাবাহিক মাহফিল ইতিহাসে বিরল। চুনতী মাদরাসার সাবেক নাজেমে আলা আল্লামা ফজলুল্লাহ রহ. বিষয় অনুযায়ী আলোচনা পদ্ধতির উদ্ভাবক। মাহফিলকে কেন্দ্র করে চুনতী ও আশেপাশের এলাকাগুলোতে উৎসবের আমেজ ও দ্বীনি আবহ সৃষ্টি হয়। আত্মীয়তার সম্পর্ক বা রেহেমকে পুনরুজ্জীবিত করার এক অনন্য মাধ্যম হলো সীরাত মাহফিল। নতুন পুরাতন, দূরের -কাছের আত্মীয় স্বজনের আগমণে মুখরিত হয় অত্র অঞ্চল। রেহেমের এই অটুট বন্ধনের কারণে পুরো চুনতীর উপর অঝোর ধারায় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়।শাহ সাহেব রহ. এর জীবিতাবস্থায় একদিন সীরাত মাহফিলে তাঁর অজান্তে ছোট বাচ্চাদের খাবার পরিবেশন না করায় তিনি অভিমান করে কয়েকদিন সীরাতের খাবার গ্রহণ করেন নি। না খেয়ে যাওয়া একজন (বর্তমানে যুবক) আমাকে জানান,ঐ দিনের অভুক্ত বাচ্চারা আজ প্রত্যেকেই একটি করে গরু দেয়ার সামর্থ রাখে। তারাই আজ সীরাতের হাল ধরেছে। একজন আল্লাহর অলীর কী দূরদর্শিতাা!!বাচ্চাদের প্রতি তাঁর সেদিনের সমবেদনা আজ মাহফিলের শক্তিতে পরিণত হয়েছে।বাংলাদেশের প্রতীতযশা আলেম,অধ্যাপক,বক্তা গবেষক,আলোচকগণ এখানে আলোচনার জন্য আমন্ত্রিত হন। বিষয়ের বাইরে নিজের ইচ্ছামত আলোচনা করলেই পর্যবেক্ষক কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী তাঁকে পরবর্তী বছরের জন্য অনোপযুক্ত ঘোষণা করা হয়।এই মাহফিল নি:সন্দেহে আল্লাহর কাছে মকবুল মাহফিল। হযরত শাহ সাহেব (রহ.) নিজ যোগ্যতাবলে এই মাহফিলকে আল্লাহর দরবারে কবুলিয়তের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। এই অঞ্চলে পদচারনা করলেই ইলম ও রূহানিয়তের অমীয় খুশবো পাওয়া যায়। দ্বীনি দুনিয়াবী শিক্ষার আবহে চুনতীর পাহাড়গুলোর চূড়ায় হেরার আলোর বিচ্যুরণ পরিলক্ষিত হয়। আল্লামা ইউসুফ রহ. এর বাগানের "শাহ মন্জিল" হাজার বছরের চুনতীর ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে রাসূল সা. এর সীরাতকে আজ বিশ্ব দরবারে মিডিয়ার বদৌলতে ঘরে ঘরে পৌঁছানোর ব্যবস্থায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।আল্লাহ তাআলা ১৯ দিন ব্যাপী সীরাতুন্নবী সা. মাহফিলকে কিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ রাতে ২০২২ সালের মাহফিল শেষ পর্যায়ে তাদেরকে আল্লাহ কবুল করুন।লেখকঃ ড. মোঃ ওয়ালী উল্লাহ
Make sure you enter the(*)required information