দক্ষিণ চট্টগ্রামের চুনতীতে ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী বাংলাদেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত প্রচারিত। এই মাহফিলে সীরতুন্নবীর স্বপ্ন দ্রষ্টা প্রতিষ্ঠাতা চুনতীরই সাধক পুরুষ মহান আশেকে রাসূল হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ.)। জনগণের কাছে হযরত শাহ ছাহেব কেবলা হিসেবে পরিচিত। তিনি ১৯৮৩ সালে ২৩ সফর ইন্তেকাল করেন। সীরত ময়দানে মসজিদে বায়তুল্লাহর দক্ষিণ পাশে তিনি সমাহিত। দেশ বিদেশে ঘরোয়াভাবে ৪০ দিন, ৬৩ দিন ব্যাপী ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির কথা শুনা গেলেও বৃহত্তর পরিসরে বিশাল আয়োজনে দীর্ঘ ১৯ দিন ব্যাপী ধর্মীয় মাহফিল বাংলাদেশ ত নয়ই, বিশ্বে আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। তিনি ১৯০৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এই বছর তাঁর দাদা বিখ্যাত জমিদার হযরত শাহ মাওলানা ইউসুফ আলী, তাঁর পুত্র (হযরত শাহ ছাহেব কেবলার পিতা) হযরত সৈয়দ আহমদকে সাথে নিয়ে হজ্বে গমন করেন। তথায় তাঁর দাদা হযরত ইউসুফ আলী ইন্তেকাল করেন। ফলে হযরত শাহ ছাহেব কেবলার জেঠা তথা দাদার প্রথম সন্তান হযরত শাহ মাওলানা ফয়েজ আহমদ (রহ.) পিতার জমিদারি এস্টেট দেখভাল করার জন্য ঘন ঘন আরাকান যাওয়া-আসা করতেন। এ সময় আরাকানে ভারতীয় উত্তর প্রদেশের মহান সূফী দরবেশ পীর হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.)’র মোলাকাত পান। যিনি আজমগড়ী হযরত হিসেবে এতদাঞ্চলে সমধিক প্রসিদ্ধ। হযরত মাওলানা ফয়েজ আহমদ আজমগড়ী হযরতের নিকট মুরিদ হন।আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম শহরে তরিকতের সফরে আসলে হযরত শাহ ছাহেব কেবলার জেঠা জমিদারি এস্টেটের প্রধান হযরত মাওলানা ফয়েজ আহমদ তাঁর পীর আজমগড়ী হযরতকে চাক্তাই থেকে বৃহদাকৃতির গদু নৌকা যোগে ঢলু নদীর গাটিয়াডাংগা ঘাটে পৌঁছান। তথা হতে ছোট নৌকায় আধুনগর নৌঘাটে নিয়ে আসেন। তথা হতে ঘোড়া/তাঞ্জান করে বা পায়ে হেঁটে চুনতী হযরত শাহ ছাহেব কেবলার পৈতৃক বাড়িতে পৌঁছেন। হযরত শাহ ছাহেব কেবলাও আজমগড়ী হযরতের সুদৃষ্টি পেতে পেতে ধন্য হতে থাকেন। হযরত শাহ ছাহেব কেবলা দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে ফাজিল পাস করেন। অতঃপর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং আর উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন।হযরত শাহ ছাহেব কেবলা ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। পরিণত বয়সে ৫০/৬০ বছর আগের ছাত্র জীবনের জ্ঞানার্জন করা আরবি, ফার্সি কবিতা, এমনকি তফসীর, হাদীস, ফিকাহসহ বিভিন্ন বিষয় মুখস্থ বলতে পারতেন। দেশ বিদেশের প্রখ্যাত আলেমগণ যখনই তাঁর সান্নিধ্যে আসতেন ওনার কোরআন হাদীসের আলোচনা শুনে তারা মুগ্ধ হয়ে একাগ্রচিত্তে তাঁর পানে চেয়ে থাকতেন।হযরত শাহ ছাহেব ছিলেন দুনিয়ার সব ভয় ভীতির উর্ধ্বে। অর্থ সম্পদের উপর তাঁর কোন মোহ ছিল না। ভক্তদের দেয়া অর্থও তিনি গরীব-দুঃখীদের মাঝে বিতরণ করে দিতেন। ইন্তেকালের সময় তাঁর সঞ্চয় বলতে এক কপর্দকও ছিল না।হযরত শাহ ছাহেব কেবলার শারীরিক গঠন ছিল রাজাদী রাজের মত। তেমনি ছিল তাঁর জ্যোতির্ময় চেহারা।তাঁর দাদা হযরত কাজী ইউসুফ আলী (রহ.)’র বিশাল জমিদারী এস্টেট ছিল আরাকানে। হযরত শাহ ছাহেব কেবলা আরাকানে থাকা অবস্থায় শবে কদরের রাতে ফানাফির রাসূল হিসেবে নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেলেন।দীর্ঘ প্রায় ৩৭ বছর পাহাড়ে-পর্বতে লোকালয়ে বিচরণ করতে থাকেন রাত দিন, নিম্নলিখিত পংক্তি আউড়াতে থাকতেন। তা হল- হাম মাজারে মুহাম্মদ (স.) পে মর জায়েঙ্গে,জিন্দেগি মে য়াহি কাম কর জায়েঙ্গে।(অর্থাৎ) হযরত মুহাম্মদ (স.)’র উদ্দেশ্যে আমার জীবন উৎসর্গিত,সারা জীবন তাঁর ধ্যানেই আমি থাকব নিয়োজিত।এ দীর্ঘ সময় তাঁর পূর্ণবতী স্ত্রী (চাচাত বোন), ১ পুত্র ১ কন্যা সন্তানকে নিয়ে জীবন অতিবাহিত করেন। ১৯৬০ এর দশকে এসে তিনি পর্যায়ক্রমে অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে থাকেন। তাও কিন্তু শতভাগ নয়। এমনি অবস্থায় তিনি পৈতৃক বাড়ী থেকে ৩/৪ শত মিটার দক্ষিণে নতুন বাড়ী নির্মাণ করে চলে আসেন। যা শাহ মঞ্জিল হিসেবে সর্বজনের কাছে পরিচিত। তিনি ১৯৭২ সালে শাহ মঞ্জিলের দক্ষিণ পাশে মাহফিলে সীরতুন্নবীর আয়োজন করেন ১ দিনব্যাপী। ১৯৭৩ সালে ৩ দিন, ১৯৭৪ সালে ৫দিন, ১৯৭৬ সালে ১০ দিন, ১৯৭৯ সালে ১২ দিন, ১৯৭৮ সালে ১২ দিন, ১৯৮৯ সালে ১৫ দিন সে সময় আরও ২ দিন বাড়িয়ে ১৭ দিন, আবার আরও ২ দিন বাড়িয়ে ১৯ দিনে গিয়ে মাহফিল সমাপ্ত হয়। ১৯৮০ সাল থেকে অদ্যাবধি ১৯ দিনব্যাপী এ মাহফিলে সীরতুন্নবী আজিমুশশান হিসেবে চলমান। রবিউল আউয়াল মাসের চাঁদ উঠার পর হতে তিনি বেহাল হয়ে পড়তেন। মাহফিলে সীরতুন্নবীর আখেরী মোনাজাতের পর বেশ কিছুদিন তিনি শোকাহত মনে কান্না জড়িত অবস্থায় থাকতেন।তিনি জীবদ্দশায় মাহফিলে মেরাজুন্নবী চালু করেন। সাথে সাথে শবে বরাত, শবে কদর, আশুরা দিবস, ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম আয়োজন করে ছিলেন। শাহ মঞ্জিলের পশ্চিম দিকে প্রায় ১৩ একর এরিয়া নিয়ে বিশাল আকারে মাহফিলে সীরতুন্নবীর ময়দান প্রতিষ্ঠা করেন। এই ময়দানের পশ্চিম পাশে মসজিদে বায়তুল্লাহ নির্মাণ শুরু করে দেন। তিনি ছিলেন মানব দরদী, মানুষকে ভালবাসতেন। শিশুদের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অপরিসীম। ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবীতে শিশুদের আলাদা খাবারের ব্যবস্থা থাকায় অসচ্ছল গরীব হাজার হাজার পরিবারের শিশু এ খাবার খেয়ে থাকেন। তিনি যেমন আত্মীয়ের হকের প্রতি খবর রাখতেন, তেমনি তাঁর অসংখ্য গুণাগুণের মধ্যে অন্যতম একটি হল কৃতজ্ঞতাবোধ। অর্থাৎ অতীতের মূল্যবোধ তাঁর দিলে জাগরুক থাকত। একালে শত ত নয়ই হাজারে কয়জনই বা অতীতকে মনে রাখে। মানুষ কতই না স্বার্থপর। আর হযরত শাহ ছাহেব কেবলা ছিলেন তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অতীতকে মনে রাখতেন।তাঁর দাদার জমিদার বাড়ী ইউসুফ মঞ্জিল মেহমানদারীর জন্য প্রসিদ্ধ। সেই সময় রাতে মুসাফিরকে খাবার প্রদানের জন্যও প্রসিদ্ধ ছিল। এ শাহ মঞ্জিল নতুন বাড়ীতে আজও নিয়মিত মেহমান আসা-যাওয়া জারি রয়েছে।চুনতীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতিও ছিল তাঁর দরদ। সেই সাথে অবদান। বিশেষ করে চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফাজিল থেকে কামিল স্তরে উন্নিত করা, মাদ্রাসার অবকাঠামোগত উন্নয়নে হযরত শাহ ছাহেব কেবলার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। চুনতী প্রাইমারী স্কুল, হাই স্কুল, মহিলা মাদ্রাসা, ডিগ্রী কলেজে তাঁর কোন না কোনভাবে অবদান খাট করে দেখার সুযোগ নেই।চুনতীতে রয়েছে যেমনি বাঘাবাঘা শিক্ষাবিদ, তেমনি রয়েছেন আল্লাহর মহান অলি দরবেশ। বিশেষ করে হযরত মাওলানা আবদুল হাকিম, তাঁর সহোদর ভ্রাতা নাসির উদ্দিন ডেপুটি, শুকুর আলী মুন্সেফ, মাওলানা ফজলুল হক, মাওলানা নজির আহমদ, মাওলানা হাকীম মুনির আহমদসহ অনেকে ।কিন্তু ১৯৭০ এর দশক থেকে মাহফিলে সীরতুন্নবীসহ হযরত শাহ ছাহেব কেবলার কর্ম তৎপরতায় চুনতী গ্রামকে দেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রসিদ্ধতা এনে দেয়।এ মহান আশেকে রাসূল হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ.) ১৯৮৩ সালে ২৯ নভেম্বর তথা ২৩ সফর মাহফিলে সীরতুন্নবীর মাত্র ১৬ দিন আগে নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। সীরত ময়দানে জানাযার পর মসজিদে বায়তুল্লাহ এর দক্ষিণ পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তিনি ইন্তেকাল করে গেছেন ৪১ বছর হল। কিন্তু ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে সীরতুন্নবী সুন্দর সুচারুভাবে চলমান। ১৯ দিনব্যাপী মাহফিলে হাজার হাজার নবী প্রেমিক আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছেন। প্রতি বছর যার অংক হয়ত সর্বসাকুল্যে কয়েক কোটি টাকা হবে।১৯৬০ এর দশকে ছাত্র জীবন থেকে তাঁকে দূর থেকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করে আসছিলাম। ১৯৭৩ সালে তাঁর অনেকটা সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য লাভ হয়। ২০০৭ সালে ৩৭২ পৃষ্টাব্যাপী জীবনীগ্রন্থ লেখা। যা চুনতীর জমিনে প্রথম জীবনীগ্রন্থ।তিনি জীবনে ৬ বার হজব্রত পালন করেন। প্রথমবার ১৯৭০ সালে, ২য় বার ১৯৭২, ৩য় বার ১৯৭৪, ৪র্থ বার ১৯৭৬, ৫ম বার ১৯৭৮, ৬ষ্ঠ বার ১৯৭৯ সালে।তিনি একাধিকবার ভারত সফর করেন। যেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করেন কলকাতা, বান্ডেল, আজমগড়, দিল্লি, আজমীর, মুম্বাইসহ অনেক স্থানে।ইন্তেকালের ২/৩ বছর আগেও তিনি ভারত সফর করেন। এই সফরে ভারত থেকে কলকাতা পৌঁছেন। বান্ডেল গমন করেন হযরত সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনীর যেয়ারতে । বিমানে কলকাতা থেকে বানারস হয়ে আজমগড় গমন করেন। আজমগড় থেকে গোন্ডা যান। আজমগড়ী হযরতের যেয়ারতে তথায় রাত্রি যাপন করেন। পরদিন দিল্লি অতঃপর আজমীর গমন করেন যেয়ারতে।মহান আল্লাহ পাক মাহফিলে সীরতুন্নবী কিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন। সাথে সাথে হযরত শাহ ছাহেব কেবলাকে পরকালে আলা মকাম দান করুন। আমিন॥দৈনিক পূর্বকোণ সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
Make sure you enter the(*)required information