হযরত শাহ মাওলানা আবদুস সালাম আরাকানী (রহ.)। আরাকানের বাসিন্দা বিধায় এই অঞ্চলে আরাকানী হযরত হিসেবে প্রসিদ্ধ। তিনি ভারতে উত্তর প্রদেশের হযরত শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) প্রকাশ আজমগড়ী হযরতের অন্যতম খলিফা। আরাকানে প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। আরাকানের বুচিদং নদীর তীরে প্রকান্ড দালান নিয়ে জমিদারী স্টাইলের বাড়িঘর। ১৯৬৮ সালে আরাকানে তথা জন্মভূমিতে ইন্তেকাল করলে তাঁকে তথায় দাফন করা হয়। ১৯৪৪-৬৮ সাল এই ২৪ বছর আরাকান মায়ানমারের পাশাপাশি আমাদের এই অঞ্চলে তরিকতে তাসাউফে তাঁর রয়েছে বিশাল খেদমত।১৯৭০ এর দশক থেকে আরাকানে মুসলমানের উপর বিপর্যয় নেমে আসে। ১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে অনেক আরাকানী মুসলমান আমাদের দেশে আশ্রয় নেয়। ১৯৮০ এর দশকে আরাকানী হযরতের সরাসরি নাতি হযরত মাওলানা জহরুল ইসলাম (রহ.) চট্টগ্রাম সফরে আসেন। সাতকানিয়া খানকাহ, চট্টগ্রাম ঘাটফরহাদবেগ খানকাহতে যাওয়া-আসা করেন। সেই বছর চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার সভায় গমন করেন। হযরত শাহ ছাহেব কেবলা আরাকানী হযরতের নাতি জানতে পেরে তাঁর প্রতি আবেগপ্রবণ হয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে চুমু দিতে থাকেন। ১৯৮০ এর দশকে আরাকানী হযরতের পরিবার এ অঞ্চলে স্থায়ী বসবাসের জন্য ২০/৩০ শতক সমতল বা পাহাড়ী জমি কোন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু দুঃখের বিষয় ২/৩ জন ব্যক্তি যারা সহযোগিতায় ছিলেন তাদের দ্বারা যাদের কাছে জায়গা পাওয়ার সহায়ক ছিল তারা কেন জানল না! পিতার সম্মতি ছিল এখানে সুযোগ হলে তারা আরাকান থেকে চট্টগ্রামে হিযরত করবেন। বড় লোকের নাতি চেয়েছিলেন এখানে সুযোগ-সুবিধা হয় কিনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে আরাকানী মুসলমানদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসে। এতে ২০১৭ সালে মানবিক কারণে বাংলাদেশ সীমান্ত খুলে দেয়া হয়েছিল। ফলে আজ ৮-১০ লাখ মুসলমান বাংলাদেশে অস্থায়ী ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সরকারী পৃষ্টপোষতায় অনেক রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে আসে। যে কয়েক লাখ মুসলমান আরাকানে রয়ে গেছেন তাদের জীবন বিপন্ন।হযরত আলহাজ্ব মাওলানা জহরুল ইসলাম (রহ.) দীর্ঘ দিনের সৌদি আরবে জেদ্দা প্রবাসী। সৌদি আরব গেলে আমার সাথে মোবাইলে বারে বারে আলাপ হত। দেশ থেকেও একাধিক বার আলাপ হয়। হজ্বের সময় মিসফালাহ আমার হোটেল কক্ষে তাঁর সাথে দীর্ঘ সময় নিয়ে আলাপ আলোচনা করি। তিনি বারে বারে আরাকানের বুচিদং তাদের পরিবারের লোমহর্ষক প্রতিকূলতার বর্ণনা দেন। তাঁর স্ত্রী সন্তানেরা তথায় রয়েছেন। কিন্তু তিনি হয়ত ইয়াঙ্গুন আসতে পারবেন নিজের জন্মভূমিতে যেতে পারবেন না মায়ানমারের জালেম সরকারের বিধি নিষেধের কারণে। তারপরও পরিবার বর্গের চরম প্রতিকূলতায় তিনি জেদ্দা থেকে ইয়াঙ্গুন (রেঙ্গুন) পৌঁছেন গত রমজানের আগে। ফুফুর বাড়ীতে অবস্থান নেন। ওখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। গত নভেম্বর ডিসেম্বরে মাসখানেকের সফরে ওমরাহ ও যেয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় অবস্থান করা হয়। দাম্মামে এক আরাকানীর মোবাইল নাম্বার আমার কাছে সেইভ করা আছে। তাকে ফোন করলে আমি তাকে চিনতে না পারলেও মূর্হূতেই তিনি আমাকে চিনতে পেরেছেন। তিনি হযরত মাওলানা জহরুল ইসলাম (রহ.)’র সরাসরি শ্যালক। তাঁর থেকে হযরত মাওলানা জহরুল ইসলামের ইয়াঙ্গুনে ইন্তেকালের খবর জানতে পারলাম।হযরত শাহ মাওলানা আবদুস সালাম আরাকানী (রহ.) আজমগড়ী হযরতের ৪৪ জন খলিফার মধ্যে অন্যতম সিনিয়র খলিফা।ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের সাথে আরাকানের রাজধানী আকিয়াব ও মায়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন সাগরপথে যাতায়াত ছিল। তেমনিভাবে কলকাতার সাথেও চট্টগ্রাম, আকিয়াবের নিয়মিত জাহাজ সার্ভিস ছিল। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রাম-ইয়াঙ্গুন আকাশপথে ফ্লাইট ছিল।ধনী পিতার সন্তান আরাকানী হযরত আকিয়াব থেকে সাগরপথে কলকাতা যেতেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার কৃতি ছাত্র ছিলেন। আরও কৃতি ছাত্র ছিলেন আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের।আরাকানী হযরত কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আজমগড়ী হযরতের হাতে মুরিদ হন। আজমগড় নিজ পীর ছাহেবের বাড়িতে এক নাগাড়ে ২২ বছর সময় দেন। আজমগড়ী হযরতও বিশাল সম্পদশালী মিয়া করিম বক্স (রহ.)’র একমাত্র পুত্র। এতে আজমগড়ী হযরতও নিজে পিতার দিক দিয়ে সম্পদশালী। আরাকানী হযরত আজমগড়ে অবস্থানকালে নিজের শেখ আজমগড়ী হযরত এশারের নামাজের পর তাঁর গায়ের চাদরটি আরাকানী হযরতের মাথার উপর ঢেকে দিতেন। ফজরের নামাজের আগে তাহাজ্জুত পড়তে এসে আবার উঠিয়ে নিতেন। ইনিই হলেন আরাকানী হযরত যিনি ভারতবর্ষসহ বৃহত্তর মায়ানমারের অন্যতম মহান অলি। আজমগড়ী হযরত নিজেও এই মহান খলিফাকে মূল্যায়ন করতেন। আরাকানী হযরত প্রথম চট্টগ্রামে ঢুকেন ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। পীর ছাহেবের আধ্যাত্মিক নির্দেশ পেয়ে তিনি আসতে চাচ্ছিলেন চুনতী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অবস্থা বিধায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তাঁকে নাফ নদীর তীরে আটকে দেয়। কিন্তু তিনি জানতে পারেন ঐ সময় টেকনাফে সাদা চামড়ার অফিসার অসুস্থ। তখন আরাকানী হযরত ব্রিটিশ সৈনিককে তিনি একজন হাকিম হিসেবে পরিচয় দেন। এতে ব্রিটিশরা তাকে স-সম্মানে টেকনাফে এনে অসুস্থ অফিসারের নিকট নিয়ে যায়। সেই এক বর্ণনা। তিনি চুনতী আসেন হযরত শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.)’র বাড়ীতে অবস্থন নেন। এখানে গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর কেবলার সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। হযরত শাহ মাওলানা হাবীব আহমদ (রহ.)সহ তাঁরা তিন জন আজমগড় যান কয়েকদিন অবস্থান করেন। হযরত শাহ মাওলানা হাবীব আহমদ (রহ.) দেশে ফিরে আসেন। আরাকানী হযরত ও গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর (রহ.) পাঞ্জাবে সেরহিন্দ ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আল ফেসানী (রহ.)’র যেয়ারতে যান।১৯৪৪-১৯৬৮ সাল ইন্তেকাল পর্যন্ত আরাকানী হযরত কক্সবাজার জেলাসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম, ঢাকা, বগুড়াসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় তরিকতের খেদমত করেন।সাতকানিয়া উপজেলা সদরে রয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত খানকাহ। অপরদিকে চুনতীসহ চকরিয়া কক্সবাজার উখিয়া টেকনাফে আরাকানী হযরতের বিশাল খেদমত রয়েছে।এই অঞ্চলে আরাকানী হযরতের দীর্ঘ ২৪ বছরের খেদমতে রয়েছেন ন্যূনতম হাজার হাজার মুরিদ। এদের মধ্যে থেকে কয়েক জন খলিফার নাম পাওয়া গেছে। যথা-১. মাওলানা হাবীব আহমদ, চুনতী ২. মাওলানা শফিক আহমদ, চুনতী ৩. মাওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাজের,কুতুবদিয়া (বর্তমান চুনতী)৪. মাওলানা এলাহী বক্স-শেখেরখীল, বাঁশখালী ৫. মাওলানা ওয়াহেদ আলী-শেখেরখীল, বাঁশখালী ৬. মাওলানা রশিদ আহমদ-শাকপুরা, বোয়ালখালী ৭. মাওলানা আবুল ফসি মুহাম্মদ ফোরকান, মহেশখালী ৮. মাওলানা বদিউর রহমান, হ্নীলা, ৯. মৌলভী সিদ্দিক আহমদ, সাতকানিয়া ১০. মাওলানা হামিদুর রহমান খাগরিয়া ১১.মাওলানা আবদুল গণি,নাইক্ষ্যংছড়ি। আমার বিশ্বাস কক্সবাজার জেলায় আরাকানী হযরতের আরও খলিফা রয়েছেন। কারও জানা থাকলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে বিনীত অনুরোধ রাখছি। মোবাইল-০১৮৪১-২৪৪৩৫৫ বা ০১৭১৩-১১৫৬০১। যেহেতু ওয়াইসী হয়ে আজমগড়ী সিলসিলা গ্রন্থটি তৃতীয় প্রকাশের কাজ চলমান। এ গ্রন্থে আজমগড়ী হযরতের এতদাঞ্চলের ১৬ জন মহান খলিফার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে। তৎমধ্যে আরাকানী হযরতও। আরাকানী হযরত ইন্তেকালের মাত্র সপ্তাহখানেক আগে সাতকানিয়া খানকাহ হতে আরাকান নিজ বাড়িতে চলে যান। ১৯৬৮ সালের ১৭ জুন ২০ রবিউল আউয়াল ৮৫ বছর বয়সে সোমবার দুপুরে ইন্তেকাল করেন। তথায় তাঁকে শায়িত করা হয়। তাঁর জন্মও হয় সোমবারে। তিনি ২ পুত্র ৪ কন্যা সন্তানের পিতা।লেখকঃ আহমদুল ইসলাম চৌধুরী প্রাবন্ধিক,গবেষক,কলামিস্ট।সুত্রা ঃ দৈনিক পূর্বকোণ , সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫,
Make sure you enter the(*)required information