হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.)। চট্টগ্রাম চন্দনপুরা দারুল উলুম মাদ্রাসার হেড মাওলানা আলেম জগতের মধ্যমনি, আজমগড়ী হযরতের অন্যতম প্রিয় ব্যক্তিত্ব ও খলিফা। ১৯৪৪ সালে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চুনতী নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর ইন্তেকাল নিয়ে রয়েছে অলৌকিকত্বের ঘটনা। তিনি মাত্র ৫৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। কিন্তু এ ৫৪ বছর হায়াতে তিনি বর্ণাঢ্য জীবন অতিবাহিত করেন। আজমগড়ী হযরত তাঁর অন্যতম প্রিয় খলিফা মহান আল্লাহ পাকের অলি শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.) ইন্তেকাল বিষয়ে অলৌকিকভাবে জানতে পারেন, বুঝতে পারেন। মহান পীর ছাহেব ভারতের উত্তর প্রদেশের হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) চাচ্ছেন তাঁর মহান খলিফা শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.)’র কয়েকটি ছবক বাকী আছে, ইন্তেকালের পূর্বে এ ছবকগুলো দিয়ে অভিষ্ট উচ্চ মকামে পৌঁছিয়ে দেয়া। তাঁর পীর ছাহেব আজমগড়ী হযরত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, যোগাযোগ একাধিক প্রতিকূলতায় সুদূর উত্তর প্রদেশ থেকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চুনতীতে পৌঁছা সহজসাধ্য ছিল না। ফলে তিনি বেছে নেন হযরত শাহ মাওলানা আবদুস সালাম আরাকানী প্রকাশ আরাকানী হযরত কে। আরাকানী হযরত যেমনি শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.)’র পীর ভাই তেমনি আজমগড়ী হযরতের সিনিয়র খলিফা। যার বিষয়ে প্রবন্ধ গত সপ্তাহে দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশিত হয়েছে। নিজের পীর ছাহেব আজমগড়ী হযরত থেকে নির্দেশ পান; তিনি যাতে চুনতী এসে হযরত শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.) কে বাকী ছবকগুলো দিয়ে দেন। উত্তর প্রদেশের সুদূর আজমগড় থেকে আরাকানের বুচিদং অলৌকিক নির্দেশনা বাদে চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আরাকানী হযরত নির্দেশ লাভ করে চুনতী আসার উদ্দেশ্যে নাফ নদীর তীরে আসেন ১৯৪৪ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সামগ্রিক প্রতিকূল পরিস্থিতি বিধায় ব্রিটিশ সৈন্যরা নদী পার হয়ে টেকনাফে আসতে দিচ্ছিল না। এখানে আরাকানী হযরত জানতে পারেন টেকনাফে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অফিসার অসুস্থ। এতে তিনি নিজেকে ডাক্তার তথা হাকিম পরিচয় দেন। তখন তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের সহায়তায় টেকনাফ এসে ঐ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অফিসারকে দেখতে যান। তাকে কোরানিক চিকিৎসা প্রদান করেন। এতে ব্রিটিশ অফিসার সুস্থতা অনুভব করেন। এই অফিসার আরাকানী হযরতে চুনতী পৌঁছাতে সহায়তা করেন। আরাকানী হযরত ছিলেন ধনী ব্যবসায়ী পিতার সন্তান। বুচিদং তাদের পাকা দালান-মসজিদ আভিজাত্য বহন করে। তিনি আকিয়াব থেকে সাগরপথে কলকাতা যাওয়া-আসা করতেন। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা ও আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সড়ক যোগাযোগ প্রতিকূলতায় এই বারেই প্রথম পীর ছাহেবের নির্দেশ পালনে চুনতীতে তথা চট্টগ্রাম সফরে আসছেন। আরাকানী হযরত চুনতী পৌঁছবে তা হযরত শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.)’র জানা হয়ে আছে। আরাকানী হযরত তাঁর পীর ভাই হযরত মাওলানা নজির আহমদ কে ৫/৭ টি তরিকতের ছবক ও তাওয়াজ্জু দেন। অতঃপর জানতে চান কি দেখলেন, কি পেলেন। মাওলানা নজির আহমদ (রহ.) বলেন, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়, “আই কেলা পাত্রা বাই বাই উরে উড়ি গেইগই”। অর্থাৎ আমি কলাগাছের ডগা বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। এডে দেখিদ্দি স্বর্ণের বাড়িঘর, প্রাসাদ। তখন আরাকানী হযরত বলেন, আমি ছবক দিলাম বলে আপনি এভাবে উডলেন। আমার পীর ছাহেব যদি ছবকগুলো দিতেন তা হলে আপনি স্বর্ণের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারতেন! এর ২/১ দিনের ব্যবধানে শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.) ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের সময় তাঁর কক্ষে রৌসনীময় ও নানান অলৌকিকত্ব প্রকাশ পাচ্ছিল। ইন্তেকালের আগে তাঁর একমাত্র পুত্র শাহ মাওলানা হাবীব আহমদ ও একমাত্র কন্যা মোছাম্মৎ জয়নাব বেগমকে আরাকানী হযরতের নিকট মুরিদ করিয়ে দেন। উক্ত সব বর্ণনা চুনতীসহ ঐ অঞ্চলের অনেকের মুখে মুখে। আরাকানী হযরত শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.)’র জানাযা পড়ান। এই জানাযায় ব্যাপক সমাগম হয়। অতঃপর চুনতীর প্রসিদ্ধ কবরস্থানে হযরত শাহ মাওলানা ফজলুল হক (রহ.)’র পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.) ইলমে লাদুন্নির অধিকারী ছিলেন। আজমগড়ী হযরতের সাথে হজ্বব্রত পালন করেন। কবিরাজী হাকিমি ফমূর্লার সংমিশ্রণে ‘বরস’ নামে এক মোদক (হালুয়া জাতীয়) ঔষধ বিক্রির মাধ্যমে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এতে তিনি চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে চন্দনপুরায় বিল্ডিং নির্মাণ করেন। নাম দেন বরস বিল্ডিং। ১৯৩৬-৩৭ সালের দিকে চুনতীতে দ্বিতল বিশিষ্ট পাকা দালান নির্মাণ করেন। আজমগড়ী হযরত প্রথম দিকে হযরত শাহ ছাহেব কেবলার দাদার বাড়ি ইউসুফ মঞ্জিলে তশরীফ রাখতেন। পরবর্তীতে শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.)’র এই দালানেও তাশরীফ রাখেন।আজমগড়ী হযরত বলতেন ‘মেরে নজির বে-নজির হে’।হযরত শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.) আরাকানের বিখ্যাত জমিদার চুনতীর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব হযরত আলহাজ্ব মাওলানা ইউসুফ (রহ.)’র মেয়ের ঘরের নাতি। তথা হযরত শাহ ছাহেব কেবলার ফুফাত ভাই। তিনি মোহসিনিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করার পর মায়ের একমাত্র ছেলে হওয়ায় পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার কারণে কলকাতা বা দেওবন্দ গমন না করে দারুল উলুম মাদ্রাসায় শিক্ষকায় যোগদান করেন। তার আগে কিছুদিন মোহসিনিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছিলেন। কিন্তু দারুল উলুম মাদ্রাসার হেড মাওলানা হিসেবে অতি প্রসিদ্ধ ছিলেন। দারুল উলুম মাদ্রাসা এই মহান হেড মাওলানাকে পেয়ে গর্বিত ছিলেন।প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন প্রফেসর ড.আবু বকর রফিক শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.)’র মেয়ের ঘরের সরাসরি নাতি। ১৯৫৫ সালে আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম সফরে এসে প্রথমে হালিশহর মরহুম হাফেজ ছাহেব হুজুর (রহ.)’র বাড়ীতে তাশরীফ রাখেন। প্রফেসর ড. আবু বকর রফিককে সাথে নিয়ে তাঁর পিতা হালিশহর যান আজমগড়ী হযরতের সাথে মোলাকাত করতে। মোলাকাতে পিতা আজমগড়ী হযরতের নিকট সন্তানকে পরিচয় করিয়ে দেন, এই শিশু শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.)’র নাতি। তখন আজমগড়ী হযরত তাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর সোহাগ করতে গিয়ে একটি কান ধরেন। প্রফেসর ড. আবু বকর রফিক এর অনুভূতি, আজমগড়ী হযরত তাকে আদর সোহাগ করে এক কান ধরাতে তিনি এতটুকু এসেছেন। দুই কান ধরলে আরও কোথায় উঠে যেতেন আল্লাহই জানেন। উক্ত বিষয় প্রফেসর ড. আবু বকর রফিক আমাকে একাধিক বার বলেন।আগেই উল্লেখ করেছি শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.)’র এক পুত্র, এক কন্যা। পুত্র হযরত শাহ মাওলানা হাবীব আহমদ ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। দারুল উলুম মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করেন। দেশে শিক্ষা লাভের পর কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে টাইটেল তথা কামিল পাস করেন। ১৯৪৪ সালে চুনতীতে ফিরে আসেন। তিনি পাস করে বাড়ি ফেরার পর তাঁর মহান পিতা ইন্তেকাল করেন। এই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তথা এই অঞ্চলে চরম প্রতিকূল অবস্থা বিরাজ করতেছিল। তিনি যখন টাইটেল তথা কামিল পাস করেন ঐ সময় এত উচ্চ শিক্ষিত আলেম ছিল হাতেগুনা। ১৯৪৬ সালে আরাকানী হযরত থেকে খেলাফত লাভ করেন। তিনি ১৯৭১ সাল থেকে দীর্ঘ সময় চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন খুবই নিরহংকারী। পদ, চেয়ার, গদি তথা দুনিয়ার মোহ আসক্ত থেকে নিজেকে মুক্ত রেখেছিলেন।এই মহান ব্যক্তিত্ব ২০০৬ সালের ২৬ নভেম্বর রবিবার ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকাল কালে তিনি হাজার মুরিদ রেখে যান। তৎমধ্যে ১৩ জনকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন।১৯৭০ দশকের শেষের দিকে বাঁশখালী হামেদিয়া মাদ্রাসা কমপ্লেক্সের এক মাহফিলে তাঁকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাই। বাঁশখালী আমাদের গ্রামের বাড়ীতে রাত্রিযাপন করেন। মাহফিলের মঞ্চে তুলতে তাঁর অনিহা দেখে অবাক হই। একালের মত অভিনয় নয়, আমাকে অনেকটা অতী আবদার কাটাতে হয় তাঁকে মঞ্চে তুলতে।শাহ মাওলানা হাবীব আহমদ (রহ.) ইন্তেকাল করলে পিতা এবং মামা শাহ মাওলানা মনির আহমদ (রহ.)’র পাশে শায়িত করা হয়।
লেখকঃ আহমদুল ইসলাম চৌধুরী প্রাবন্ধিক,গবেষক,কলামিস্ট।সুত্রা ঃ দৈনিক পূর্বকোণ , সোমবার ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, দৈনিক পূর্বকোণ
Make sure you enter the(*)required information