চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার একটি ইউনিয়নের নাম চুনতি। এ ইউনিয়নের একটি গ্রামের নামও চুনতি। প্রায় ১ বর্গমাইল আয়তনের গ্রামটি ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। প্রকৃতি যেন সমস্ত ঐশ্বর্য ঢেলে গ্রামটিকে সাজিয়েছে। সুফি-সাধকের আবাসভূমি হিসেবেও এটি প্রসিদ্ধ। গ্রামটির নামকরণের সাথে এলাকার অ ন্য কোন নামের মিল নেই। এ গ্রামের পূর্ব-দক্ষিণে পাহাড় এবং উত্তর-পশ্চিমে এর গা ঘেঁষে চলে গেছে ঐতিহাসিক আরকান সড়ক (চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক)। শুধু চট্টগ্রাম নয়, দেশে বিদেশে চুনতি গ্রাম ঐতিহাসিক অঞ্চল হিসেবে বেশ পরিচিত।চুনতি নামটির উৎপত্তি ফার্সি শব্দ চুনিদাহ থেকে। যার অর্থ পছন্দকৃত। উর্দুতে এর অর্থ প্রশংসনীয়। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ মতে, ভারতের সফল সম্রাট মোহাম্মদ আকবরের প্রপৌত্র বিখ্যাত তাজমহল নির্মাতা সম্রাট শাহজাহান (১৬২৭-১৬৫৮খ্রি.) ১৬৫৭ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় তাঁর বড় ছেলে দারাশিকো সিংহাসনের দাবিদার হন। সম্রাট শাহজাহানের তৃতীয় পুত্র আওরঙ্গজেবের এ সিদ্ধান্ত মেনে না নিয়ে ভাই শাহ সুজাকে (১৬৩৯-১৬৬০ বাংলার সুবেদার ছিলেন) সিংহাসন দখলের জন্য প্ররোচিত করেন। সরল বিশ্বাসে শাহ সুজা ১৬৬০ সালে নিজেকে বাংলার সুলতান ঘোষণা দেন। কিন্তু সম্রাট শাহাজাহান ও তাঁর বড় ছেলে দারাশিকো উভয়েই এ ঘোষণাকে বিদ্রোহ আখ্যা দিয়ে বাংলাকে মুক্ত করার জন্য রাজকীয় বাহিনী প্রেরণ করে।ফলে শাহ সুজা পিছু হটতে বা ধ্য হন এবং ভারতীয় উপ-মহাদেশের উত্তর প্রদেশের খাজুয়া প্রান্তর থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে চলে আসেন। সোনারগাঁওয়ে তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেবের সুবেদার মীর জুমলার তাড়া খেয়ে চট্টগ্রামের (তদানিন্তন ইসলামাবাদ) দক্ষিণ পূর্বে আরাকান রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বর্তমানে সে এলাকার চুনতি নামে পরিচিত।চুনতির পথিকৃৎ শাহ মাওলানা আবদুল হাকিম (রহ.) রচিত শজরামুলে জানা যায়, শাহ সুজা ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দের ১২ মে নিজ পরিবারের সদস্যবর্গ, ২শ জন একান্ত অনুগামী এবং ৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ইসলামাবাদ হয়ে পতুর্গিজ জাহাজে করে আরাকানে যাত্রা শুরু করেন। চট্টগ্রাম হতে সাঙ্গু ও ডলু নদের দক্ষিণ প্রান্তে এসে জাহাজ চলাচল উপযোগী পানিপথ শেষ হলে চুনতির বর্তমান কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ময়দানের পাদদেশে জাহাজ নোঙ্গর করে। তারপর তাঁরা পায়ে হেঁটে সামান্য দক্ষিণে গিয়ে সুপ্রশস্ত অনুচ্চ একটি পাহাড়ে অবস্থান করে চারিদিকে মনোরম দৃশ্য ও নিরাপদ জায়গা মনে করে শাহসুজা সেখনে আস্তানা স্থাপনের নির্দেশ দেন। ফার্সি ভাষায় তিনি চুনিদাহ অর্থাৎ পছন্দকৃত উচ্চারণ করেন।সেখান থেকে চলে যাওয়ার সময় তিনি চিহ্নিত স্বরূপ একটি লোহার খুঁটি গেঁড়ে দিয়ে যান। স্থানটিতে লোহার খুঁটি গাঁড়ার কারণে লোহাগাড়া নামকরণ হয়েছে বলে ঐতিহাসিকবিদরা মনে করেণ। ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান রচিত ছিদ্দিকী বংশের একটি পারিবারিক ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ভারতবর্ষের ইতিহাসে সোলতানী আমলে বাংলার রাজধানী গৌড়ের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন মুহাম্মদ ইউসুফ খানের উত্তরসূরী মাওলানা হাফেজ খান মজলিশ। তিনি বাংলার সুবেদার শাহ সুজার পীর ছিলেন। তিনি সুফী নছরত উল্লাহ খন্দকার গৌড় থেকে চুনতি গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। নছরত উল্লাহ খন্দকার বড় মিয়াজি এবং তাঁর পুত্র হযরত শাহ শরীফ ছোট মিয়াজি নামে পরিচিত। চুনতি এলাকায় বড় মিয়াজি ও ছোট মিয়াজি মসজিদ এবং সুফী মিয়াজি পাড়া আজ তাঁদের স্মৃতি বহন করছে। অন্যদিকে ১৬০০ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইসলাম প্রচারের জন্য একটি দল চুনতি গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। সম্রাট শাহজাহানের রাজ দরবারের অন্যতম শিক্ষক হযরত ইব্রাহিম খন্দকার শাহ সুজাকে অনুসরণ করে রামু পর্যন্ত যায়। সেখান থেকে তিনি বাঁশখালীর খানখানাবাদে কিছুদিন অবস্থান করে চুনতি গ্রামে এসে স্থায়ীভাবে বসতি শুরুকরেন। জনশ্রুতি রয়েছে, বর্তমান চুনতি জামে মসজিদের উত্তর পার্শ্বে ঈদগাহ পাহাড়ে তিনি বসতি স্থাপন করেন।শাহ সুজার সফর সঙ্গী ছিলেন ১৮ জন সেনাপতি, ২২ জন উচ্চপদস্থ আলেম ও বিশাল সৈয়দ বাহিনী। শাহ সুজা আরকানে আ শ্রয়ের ৬ মাসের মধ্যে সেখানে নির্মমভাবে খুন হন। এ পরিস্থিতিতে আলেম-ওলামা ও বিশাল মোঘল বাহিনীর একটি দল চলে আসেন চুনতি গ্রামে। এ ঐতিহাসিক ঘটনায় ইতিহাসের পাতায় স্থান পায় চুনতি। সুফী-সাধকের আবাসভূমি বা চারনক্ষেত্র হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করে গ্রামটি। শিক্ষার প্রভাব ও পড়ে গ্রামটিতে। ফলে এখানে গড়ে ওঠে আদি পুরুষ ও আদি পরিবারের আবাসভূমি। আদি পুরুষদের মধ্যে হযরত মাওলানা নছরত উল্লাহ খন্দকার, শাহ শরীফ মিয়াজি, সুফী আবদুর রহমান, গাজীয়ে বালাকোট আধ্যাত্মিক সাধক হযরত মাওলানা আবদুল হাকিম (রহ.) হযরত মাওলানা ওয়াজি উল্লাহ খান সামী, নাছির উদ্দীন খান ডেপুটি, শুকুর আলী মুন্সেফ, মাওলানা মো. ইউসুফ, হযরত মাওলানা ফজলুল হক, শাহ মাওলানা নজির আহমদ, মাওলানা শাহ আতাউল্লাহ হোসাইনী ও শাহ সাহেব কেবলার নাম উল্লেখযোগ্য। পরিবারের মধ্যে রয়েছে মিয়াজি পরিবার, সিকদার পরিবার, কাজী পরিবার, ছিদ্দিকী পরিবার, ডেপুটি পরিবার, শুকুর আলী মুন্সেফ পরিবার, মুন্সী পরিবার, ইউসুফ মৌলভী পরিবার ও দারোগা পরিবাল। অন্যদিকে চুনতি হাজী রাস্তার ঐতিহাসিক রাফিয়া মুড়া ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। রাফিয়া মুড়ার রয়েছে প্রাচীন বটবৃক্ষ ও তেঁতুল গাছ। এ বটবৃক্ষের নিচে এলাকার হাজীগণ সৌদি আরবে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মিলিত হতেন। রাফিয়া মুড়ার পার্শ্ববর্তী কাজীর ঢেবা হতে পালের নৌকাযোগে আরবে পাড়ি দিতেন হাজীরা। হযরত খলিফা আবু বক্কর (র.) এর বংশধর ও ছিদ্দিকী বংশের প্রথম পুরুষ হযরত আবদুল লতিফ ছিদ্দিকী (রহ.) ১৪০০ সালে মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আরব সা¤্রাজ্যের হেজাজ প্রদেশের গভর্নর ছিলেন তিনি আরব থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে লোহাগাড়ায় আসেন বলে ধারণা করা হয়। রাফিয়া মুড়ার পুরাতন তেঁতুল গাছের নিচে এ মহাপুরুষের কবর আছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি শিক্ষা-দীক্ষা সংস্কৃতি ও কাব্যচর্চায় মোঘল আমল থেকে খ্যাতি শীর্ষে রয়েছে চুনতি। ১৮১০ সালে হযরত মাওলানা আবদুল হাকিম (রহ.) প্রতিষ্ঠিত চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদরাসা উপজেলার প্রাচীণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মোঘল ও ব্রিটিশ আমল থেকে দেশে-বিদেশে এলাকাটির রয়েছে অনেক খ্যাতি। ইতিহাস ও ঐতিহ্যম-তি এ চুনতি গ্রামের বৃক্ষরাজি, পাহাড় এবং পাহাড়েসৃজিত বাগান, পাখির কলতান সব মিলিয়ে যেনপ র্যটন কেন্দ্র। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। এশিয়ান হাতি প্রজনন কেন্দ্র চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য অঞ্চলটি এ গ্রামে অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দক্ষিণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উভয় পাশে অবস্থিত উভয় পাশে অবস্থিত এ গ্রামটি পুরো চট্টগ্রাম নয়, গোটা দেশে ঐতিহাসিকভাবে খ্যাতি রয়েছে।লেখক :মোহাম্মাদ ইলিয়াছ, সহযোগী অধ্যাপক, আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।
Make sure you enter the(*)required information