আজ বাংলাদেশের আকাশের এক দীপ্তিমান নক্ষত্র, গর্বিত পিতা, উপমহাদেশের বরেণ্য আলিম, এক বিরল প্রতিভা, উস্তাদুল আসাতিযা আলহাজ্জ শহ মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের نور الله مرقده এর ৩৪তম ওফাত দিবস৷
মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন,“যখন মানুষ মৃত্যুবরণ করে তখন তার সকল আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তার তিন প্রকারের আমল চলমান থাকেঃ ১. ছাদাকায়ে জারিয়াহ ২. এমন ইলম বা বিদ্যা যার থেকে জনসাধারণ উপকৃত হতে পারে, আর ৩. এমন সৎ সন্তান যে পিতামাতার জন্যে দো‘য়া করতে থাকে”।
ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রচারের প্রাণ পুরুষ অধ্যক্ষ মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের ছিলেন এ হাদীসের প্রকৃষ্ঠ বাস্তবতা। তিনি বৃটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে চার দশক ধরে চট্টগ্রামের অনেকগুলো মাদ্রাসা ও দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুপারিনটেন্ডেন্ট ও প্রিন্সিপাল পদে অধিষ্ঠিত থেকে অসংখ্য আলিমে দীন তৈরি করেন। তঁর ছাত্র ও বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই বর্তমানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এক ব্যতিক্রমধর্মী অবদান রেখে চলেছেন।
বংশ পরিচয় ও জন্মস্থানঃ
মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের চট্টগ্রাম শহরের অদূরে বঙ্গোপসাগরের স্রোত বিধৌত প্রাচীন দ্বীপ কুতুবদিয়াস্থ বড়ঘোপ গ্রামের বড় মিয়াজী বাড়িতে ১৯১৩ সালে জন্ম লাভ করেন। তাঁর পিতা মওলানা মাহমূদ উল্লাহ ছিলেন এলাকার একজন অত্যন্ত পরহেজগার আলিমে দীন ও শিক্ষক। তাঁর মহিয়সী মাতা মোস্তফা বেগম ছিলেন অত্যন্ত পরোপকারী, সমাজহিতৈষী ও ইবাদতগুজার এক বিদুষী মহিলা। তিনি কুতুবদিয়ার সর্বজনপ্রিয় ও প্রসিদ্ধ জনাব হাফেয শামসুদ্দীন সাহেবের জেষ্ঠ কন্যা এবং কুতুবদিয়ার শাহ সাহেব হিসেবে পরিচিত মওলানা আবদুল মালেক আল-কুতুবীর বড় বোন। জানা যায়, মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযেরের পিতামহ চুনতীর প্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও গাযীয়ে বালাকোট নামে খ্যাত মওলানা আবদুল হাকীম রহ. এর ভাগিনা। এভাবে পিতামহের সূত্রে মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযেরের বংশধারা ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর ছিদ্দীক রঃ এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে (সূত্র: মরহুমের জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রফেসর ড. আবু বকর রফীক )।
‘আউলিয়ার দেশ কুতুবদিয়া’ গ্রন্থের রচয়িতা অধ্যক্ষ আবদুর রশীদের বর্ণনা মতে, “সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে মরহুম আবদুল্লাহ মিয়াজী রাঙ্গুনিয়া থানা হতে নিজ দুই পুত্র আমিনুদ্দীন ও লুৎফুল্লাহ সহ বড়ঘোপ গ্রামে এসে স্বহস্তে ভিটাবাড়ী আবাদ করত: বসবাস করে আসছিলেন। লুৎফুল্লাহ মিয়াজীর কোন পুত্র সন্তান ছিলনা। বড়পুত্র আমিন উদ্দীন মিয়াজী সাতকানিয়া থানার আধুনগর গ্রামের উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন এক বুযুর্গ শরীফ খান্দানের সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। তাঁর ঔরশে দুই পুত্র জন্ম গ্রহণ করেন। ১ম পুত্র ক্বারী নূরুদ্দীন অত্র গ্রামের একমাত্র শিক্ষাগুরু ও দীক্ষাগুরু হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি সুদূর আরব দেশ হতে আগত একজন মহা মনীষীর কাছে বিশুদ্ধ কোরআন শরীফ শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক সাধনায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তিনি বড়ঘোপ গ্রামের বশীর মোহাম্মদ সিকদারের প্রাচীন জামে মসজিদের প্রথম খতীব ছিলেন। বড় ভাই হিসেবে তিনি সকলের নিকট বড় মিয়াজী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সেকালে তাঁর বহু কারামতের কথা লোক সমাজে প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁর দুইপুত্র ক্বারী আলীম উদ্দীন ও ক্বারী সিরাজুদ্দীন উভয়ে ফার্সী ভাষায় অগাধ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। বর্তমান বড় মিয়াজী বাড়ীর মরহুম মওলানা আবু সাঈদ মুহাম্মদ তাইয়িব ও মরহুম মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের এর পিতা মরহুম মওলানা আলহাজ্ব মাহমূদউল্লাহ ক্বারী সিরাজুদ্দীনের ওয়ারিশ” (সূত্র: অধ্যক্ষ আলহাজ্ব রশীদ আহমদ, আউলিয়ার দেশ কুতুবদিয়া) ।
শিক্ষা জীবনঃ
মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের পারিবারিক পরিসরে পিতামাতার তত্ত্বাবধানে পড়ালেখায় ব্রতী হন। এরপর বাল্য বয়সে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মৌলিক শিক্ষা অর্জন করেন। মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরায় অবস্থিত উম্মুল মাদারেস হিসেবে খ্যাত দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং ১৯৩৪ সালে সেখান থেকে আলিম পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। অত:পর উচ্চ শিক্ষার নিমিত্তে সুদূর কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৩৬ সালে ফাযিল কেন্দ্রীয় পরীক্ষার ফলাফলে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান লাভ করেন এবং মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে প্রথমবারের মত স্বর্ণপদক বিজয়ের গৌরব অর্জন করেন। পরবর্তীতে একই মাদ্রাসা হতে তিনি ১৯৩৮ সালে কৃতিত্বের সাথে কামিল পাশ করেন। এ সময় পাশাপাশি তিনি প্রবেশিকা (entrance) পরীক্ষায়ও অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৪০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে তিনি ইংরেজীসহ মোট ৪টি বিষয়ে লেটার মার্কসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার অনন্য গৌরব অর্জন করেন। তিনি কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজে স্নাতক শ্রেণীতেও পড়ালেখা শুরু করেন। তবে তাঁর উস্তাদ ও শ্বশুর শাহ সূফী মওলানা নযীর আহমদের সম্মতি না পাওয়ায় তিনি ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন বলে জানা যায়। অবশ্য তিনি বাংলা, উর্দু, আরবী, ইংরেজী ও ফার্সী ভাষায় সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন।
কর্ম জীবনঃ
মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের চট্টগ্রাম মুহসেনিয়া মাদ্রাসায় যোগদানের মাধ্যমে তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শুরু করেন। সেখান থেকে নিজ শিক্ষকদের টানে দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসায় চলে যান। দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসার হেড মওলানা স্বীয় উস্তাদ মওলানা শাহ সূফী নযীর আহমদের বিশেষ ইচ্ছায় তাঁর ইন্তেকালের পর ১৯৪৬ সালে তিনি চুনতী হাকীমিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদে যোগদান করেন। এ প্রসঙ্গে শায়খুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মদ আমীন উল্লেখ করেন, “পাকিস্তান আমলে প্রায় ১৮ বছর ধরে চুনতী মাদরাসার অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন অবিভক্ত বাংলার কৃতি ছাত্র স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত স্কলার জনাব মাওলানা মরহুম আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের ছাহেব রহ.৷ এসময় মাদরাসার হেড মাওলানা ছিলেন মরহুম মুফতী ইবরাহীম রহ. ৷" (সূত্র: মৌলানা মুহাম্মদ আমীন, চুনতী মাদরাসার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ৩৪তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সংখ্যা, আনজুমনে তোলাবায়ে সাবেক্বীন চুনতী হাকীমিয়া আলিয়া মাদরাসা)৷ উল্লেখ্য যে, মওলানা শাহসূফী নযীর আহমদ (রঃ) চুনতী মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মূলত মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযেরের সুদক্ষ পরিচালনা ও পাঠ দানের সৌন্দর্যে এ মাদ্রাসার সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন সময় তৎকালীন টংবু মাদরাসা (বার্মা), চট্টগ্রাম জামিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া, রংগীখালী ইসলামিক সেন্টার, গারাঙ্গিয়া ইসলামিয়া আলিয়া মাদ্রাসা ও শাহচান্দ আওলিয়া মাদ্রাসায় সুপারিন্টেন্ডেন্ট বা প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এছাড়া তিনি নিজ এলাকায় কুতুবদিয়ার বড়ঘোপ ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা এবং এর প্রথম সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবেও মাদ্রাসার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। তিনি চুনতী হাকীমিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় প্রায় ১৭ বছরেরও অধিক কাল যাবৎ সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় যেমন মাদ্রাসার প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয় তেমন তিনি এলাকার লোকজনের অকৃত্রিম ভালবাসা অর্জনেও সক্ষম হন। ফলশ্রুতিতে, পরবর্তীতে বহু স্বনামধন্য মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও তিনি সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে এবং তাঁর বাড়িটি মূলতঃ "সুপারিন্টেন্ডেন্ট মন্জিল" হিসেবেই পরিচিতি পায়।
পারিবারিক জীবনঃ
দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসার হেড মওলানা ও প্রখ্যাত অলীয়ে কামিল শাহ সূফী মাওলানা নযীর আহমদ রহ. এর একমাত্র কন্যা মোছাম্মত জয়নব বেগমের সাথে ১৯৩৯ সালে মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের সাহেব পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। মোছাম্মত জয়নব বেগম পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে প্রথাগত বিদ্যালয়ের শিক্ষা গ্রহণ না করলেও নিজ বাড়ীতে ও যোগ্যতম উস্তাদের বিশেষ তত্ত্বাবধানে বাংলা, উর্দু ও ফার্সী ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তির অধিকারী ছিলেন। তাঁর পুত্র ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. আবু বকর রফীকের মতে,“তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেও মায়ের নিকট লিখা পত্রের কোথাও কোন ভুল-ত্রুটি লক্ষ্য করা গেলে তাঁর মা প্রয়োজনীয় সংশোধনীসহ ঐ চিঠিখানা পূনরায় ছেলের কাছে ফেরত পাঠাতেন। যাতে বিশুদ্ধতার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়”।
১৯৪৬ সালে চুনতী মাদরাসায় যোগদান করার পর মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের সাহেব শ্বশুর বাড়ি এবং স্বীয় কর্মস্থলের পাশে স্থায়ীভাবে নিজস্ব বসতবাড়ি গড়ে তোলেন।
তাঁর ছয় ছেলের মধ্যে তিনজনই পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং একজন চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি এফসিপিএস অর্জন করেন। বড় ছেলে প্রফেসর ড. আবু বকর রফীক আহমদ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম‘র প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি: এর শরীআ‘হ সুপারভাইজারি কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। তিনি ইতিপূর্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুরে শরীয়াহ অনুষদের ডীন ও আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়াতে ছয় বছর সহযোগী অধ্যাপক পদে চাকুরী এবং আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে ১৯ বছর প্রো-ভিসির দায়িত্ব পালনসহ প্রায় ৪০ বছর ধরে অধ্যাপনা ও উচ্চশিক্ষা প্রশাসন পরিচালনায় কর্মরত ছিলেন। তাঁ আরেক ছেলে ড. আবু ওমর ফারূক আহমদ বর্তমানে জেদ্দার কিং আব্দুল আজীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক৷ সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ড. এ. কে. এম শাহেদ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের অধ্যাপক। মওলানা আবু নঈম ছিদ্দীক আহমদ ও মওলানা আবু নছর আতীক আহমদ যথাক্রমে দুটি আলিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ ছিলেনএবং প্রফেসর ডা. এ. জে. এম. ছাদেক চট্টগ্রামে ও পরবর্তীতে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনা শেষে বর্তমানে ইউএসটিসিতে শিশুরোগ বিষয়ের হেড অব দ্যা ডিপার্টমেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ অধ্যাপক ড. হাফেয মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন “একদা মওলানা সাহেব আপনজনদের উদ্দেশ্যে বলেন, "দেখ, রাজনীতিবিদ ও আইনবিদ ড. আলীম আল রাজী ক্লাসে আমাকে আল্লাহর রহমতে কখনো হারাতে পারেননি। আমি চেষ্টা করলে আলীম আল রাজীর মতোই বৈষয়িক জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতাম, কিন্তু তা আমার লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু আমি যা চেয়েছিলাম আলহামদুলিল্লাহ তা অর্জিত হয়েছে। আমি আমার সন্তানদেরকে দীনি শিক্ষা দিতে সক্ষম হয়েছি এবং নিজ হাতেই তাদের পড়ালেখার তদারকী করেছি, এটাই আমার জীবনের বড় পাওনা। আমি দুনিয়া অর্জন করলে আমার সন্তানদের জন্য হয়তোবা কিছু ধন রেখে যেতে পারতাম,কিন্তু কোন সুফল ভোগ করতাম না” (সূত্র: অধ্যাপক ড. হাফেজ মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা, মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের: একজন অবিস্মরণীয় সুপারিন্টেন্ডেন্ট,৩৪ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সংখ্যা)। উল্লেখ্য যে, কলিকাতা আলিয়ায় মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের সাহেব ফাযিল পরীক্ষায় ১ম স্থান লাভ করলে ড. আলীম আল রাজী ২য় স্থান লাভ করেছিলেন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যঃ
মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের উপমহাদেশের অন্যতম ছূফী সাধক ব্যক্তিত্ব হযরত হাফেজ হামেদ হাসান আলভী আযমগড়ী রহ. এর সুযোগ্য খলীফা মওলানা আবদুস সালাম আরকানী রহ. কর্তৃক তরীকতের খিলাফত প্রাপ্ত হন। অসাধারণ প্রতিভা ও প্রশাসনিক দক্ষতা ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনি সর্বদা সময়ের প্রতি যত্নবান এবং মাদ্রাসার কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ও দূরদর্শিতা ছিল তার নৈতিক গুণ। ১৯৮৩ সালে তিনি হজ্ব ব্রত পালন করেন। সর্বস্তরের জনগণের মাঝে দীনি শিক্ষা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তিনি নিরন্তর প্রয়াস চালিয়েছেন। ফলে ডা. খাগেন্দ্রনাথ বিরচিত ‘কুতুবদিয়ার ইতিহাস’ নামক গ্রন্থে কুতুবদিয়ার শিক্ষিত মানুষদের তালিকায় মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযেরের নাম সর্বাগ্রে স্থান পেয়েছে। অনুরূপভাবে অধ্যক্ষ রশীদ আহমদ লিখিত ‘আউলিয়ার দেশ কুতুবদিয়া’ নামক বইয়েও মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযেরের পরিবারকে ১৪টি বিশিষ্ট পরিবারের মধ্যে অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। “নিরহংকার, সরলচিত্তের অধিকারী তথা বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন হওয়ার কারণে লোক সমাজে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। প্রখর মেধাবী আলিম ও বরেণ্য ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সারা দেশে তার পরিচিতি ছিল ব্যাপক” (ড. আহসান সাইয়েদ,বাংলাদেশে হাদীছ চর্চা: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ)।
ইন্তেকালঃ
মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের ১৯৮৫ সালে ৩০ ডিসেম্বর ভোররাতে চুনতীতে নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। পরদিন তাঁকে আউলিয়াআল্লাহ ও ওলামায়ে কেরামের পদচারণা ধন্য চুনতীর প্রাচীন জামে মসজিদের পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। চুনতীর স্বনামধন্য বুযর্গ মওলানা শাহ নযীর আহমদের একমাত্র পুত্র শাহ মৌলানা হাবীব আহমদ তাঁর নামাযে জানাযার ইমামতী করেন।
মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযের পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন কিন্তু রেখে গেছেন ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত এমন এক উচ্চ শিক্ষিত প্রজন্ম যাঁরা দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, গবেষণা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। শিক্ষা-সততা, হালাল ও ইখলাছের আদর্শ তাঁর অধস্তন বংশের শোণিতধারায় সতত প্রবাহিত। বস্তুতপক্ষে একজন মুত্তাকী ও মুখ্লিছ আলিম হিসেবে এখানেই মওলানা আবু তাহের মুহাম্মদ নাযেরের সাফল্য বলে অত্যুক্তি হবেনা।
সুত্রঃ সাংবাদিক রায়হান আযাদের ফেসবুকে দেয়া স্টেটাস থেকে৷
Dear moderator, Please publish my following posting in Chunati.com মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে যত প্রাপ্তি। ------------------------------ আলহামদুলিল্লাহ, মাদ্রাসায় কামিল পর্যন্ত অধ্যয়ন করে জীবনে যা লাভ করেছি তা অনন্য, অসাধারণ, অতুলনীয় এবং এক বাক্যে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি (achievement)। সংগত কারণেই বিশ্বাস করি, আরবী ভাষায় সরাসরি কুরআন, হাদীস, তাফসীর ও ফিকহ্সহ ইসলামী শরী'আহর অন্যান্য বিষয়ে জানতে পারাটা আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহ ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। যতদূর মনে পড়ে, মাদ্রাসায় পড়ার কারণে কোনদিন এক মুহুর্তের জন্যও হীনমন্যতায় ভুগিনি, বরং বারবার নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেছি। যাঁদেরকে মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালীন সময়ে বা পরবর্তীতে যে কোনো কারণে নিজেদের পরিচয় লুকাতে দেখেছি কেন জানিনা তাঁরা সাফল্যের পথ পেরিয়ে বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেননি ঐসব সতীর্থের তুলনায় যাঁরা মাদ্রাসায় অধ্যয়নকে শুধু যে খাটো করে দেখেননি তা নয়, আজীবন এর সাথে নিজের সংশ্লিষ্টতাকে জীবনের পুঁজিও মনে করেছেন। শুধু কি তাই? প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ও নিজেদের যোগ্যতা দিয়ে কর্মজীবনে তাঁরা তা প্রমাণও করেছেন। বলা বাহুল্য, যাঁরা হীনমন্যতার দরূন পরিচয় সংকটে (identity crisis) ভূগেন তাঁরা এক ধরনের কাপুরুষ। আমি নিজের কথাই বলি, যদিও এটি আত্মপ্রচারের পর্যায়ে পড়ে যায়। জীবনে সফল হওয়ার বিষয়টি আপেক্ষিকই বটে, তাই আমার সফলতা অন্যান্য অনেকের জন্য গৌণ হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। সে যাই হোক, আমি জীবনের মোক্ষম সময়টি (মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের বছরগুলো বাদ দিলে সর্বসাকুল্যে সতের বছর) মাদ্রাসায় অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করার কারণে আল্লাহর তায়ালার বিশেষ রহমতে আমার পারিবারিক শিক্ষক পরম শ্রদ্ধেয় মা-বাবা, বড় ভাই এবং উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথাক্রমে চুনতী হাকীমিয়া ও দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম-এর স্বনামধন্য শিক্ষক মহোদয়ের নিকট থেকে (যাঁদের মধ্যে উস্তাদুল আসাতিযাহ হযরত মওলানা মুযাফ্ফার আহমদ, মওলানা আব্দুর রশীদ, মওলানা ফযলুল্লাহ, মওলানা মুহাম্মদ আমীন, মওলানা শফীক আহমদ, মওলানা আহমদুল্লাহ, মওলানা কামালুদ্দিন, মওলানা কাছেম, মওলানা আহমদ কবীর, মুফতি ও মুহাদ্দিস্ মওলানা মুহাম্মদ আমীন, মুহাদ্দিস্ ওলানা মুতীউর রহমান নিজামী এবং মুহাদ্দিস্ মওলানা ইসমাইল আরকানী রাহিমাহুমুল্লাহ এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য) ইসলামের মৌলিক জ্ঞানের যে মূল্যবাণ মণি-মুক্তা আহরণ করতে পেরেছি তার অনেক কিছুই পাথরে খোদাই করা নকশার মতো আমার স্মৃতিতে এখনো অমর হয়ে আছে العلم في الصغر كالنقش في الحجر । বলতে দ্বিধা নেই যে, বাল্যকালের সেই আহরিত জ্ঞানই আজ অবধি আমার একমাত্র পুঁজি (asset), দিকনির্দেশনা, এবং এটি আজীবন আমার জীবন চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ। এটি 'পেলেও পেতে পারেন' জাতীয় প্রাপ্তি নয়, বরং 'নিঃসন্দেহে এটি একটি অমূল্য রতন'। আল্লাহর ইচ্ছায়, মাদ্রাসার সেই বরকতপূর্ণ ইসলামী জ্ঞানের হাতেখড়ি ও মূলভিত্তি (fundamentals) আমাকে এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে বলে যৌক্তিক কারণেই বিশ্বাস করি। কেউ কেউ মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করার কারণে নিজেদেরকে কর্মজীবনে অসফল মনে করেন। মাদ্রাসার ডিগ্রী থাকার কারণে অনেকে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোন চাকরি পাচ্ছেননা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এবং মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রতি অনেক ক্ষেত্রে বিমাতাসূলভ আচরণের ফলে এটি অনেকাংশে সত্যও। এ ব্যাপারে আমি বলবো, সকলেই চাকুরীজীবি হতে চাইলে আমাদের মতো কয়েক কোটি বেকারের দেশে চাকরির সংকট হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে আপনি একজন উদ্যোক্তা হবার চেষ্টা করুন, অথবা ঘরে বসে অনলাইনে যে কোন ছোট খাট ব্যবসা শুরু করতে পারেন। মোটকথা, দৃঢ় মনোবল, যোগ্যতা ও মাথায় উদ্ভাবনী চিন্তা থাকলে আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির এ চরম উৎকর্ষের যুগে অনেক কিছুই অর্জন করা যায়। এবার আসল কথায় ফিরে আসা যাক। যাঁরা মনে করেন, মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে তাঁদের জীবনটাই 'ষোল আনা মিছে', তাঁদের ব্যাপারে বলবো, এ সব মাদ্রাসা-পড়ুয়া ভাইদের এটি মনে করার পেছনে সাধারণত দু'টি ব্যাধি সক্রিয়ভাবে কাজ করে। প্রথমত, হীনমন্যতার জটিলতায় (inferiority complex) ভোগা;আর দ্বিতীয়টি, যেটি সম্ভবত তাঁদের ভিতর প্রথম রোগের উপসর্গ বিরাজমান থাকার কারণে, মাদ্রাসার পড়াশোনায় আন্তরিক ও মনোযোগী না হওয়ায় ভালো ফলাফল বা ইসলামের মৌলিক বিষয় সমূহের উপর নিজেদের জ্ঞানের ভিতকে সুদৃঢ় করতে না পারা। ফলে অপূর্ব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এ অমূল্য ভান্ডার থেকে নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য অনেক কিছুই সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু আশ্চর্য জনক হলেও সত্য যে, এদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের এ ব্যর্থতার দায়ভার গোটা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার উপর চাপাতে চান। এটি স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের দেশের কোন শিক্ষা ব্যবস্থাই ত্রুটিমুক্ত নয়। এর মধ্যে নানা কারণে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা অধিকতর ত্রুটিপূর্ণ। তবে এ নিরেট সত্যটি সম্পর্কে আমরা কমবেশি সকলেই অবগত আছি যে, ব্যক্তিগত সাফল্য ও অর্জনের সিংহভাগ নির্ভর করে নিজের প্রাণান্তকর সাধনা ও নিরলস অধ্যবসায়ের ওপর, যদিও অনেকাংশে এর ভিত রচিত হয় পরিবেশ, মা-বাবা, গৃহ শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহের সাহায্যে । এ পরিণত বয়সে উপনীত হয়েও আমাকে দৈনিক কমপক্ষে ৭-৮ ঘন্টা লেখা পড়া করতে হয় নিজেকে নিত্য পরিবর্তনশীল পেশাগত জ্ঞানের সাথে নিয়মিত আপডেট রাখার জন্য। তাই নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়ের কোন বিকল্প নেই। দয়াময় প্রভু আমার! দয়া করে আমার জ্ঞানের পরিধিকে সমৃদ্ধ করে দিন। رب زدني علما وانْفَعْنِي بِمَا عَلَّمْتَنِي، وَعَلِّمْنِي مَا يَنْفَعُنِي، وارْزُقْنِي عِلْماً تَنْفَعُنِي بِهِ
Make sure you enter the(*)required information