শত বছরের সম্ভ্রান্ত ঐতিহ্যে লালিত চুনতি গ্রামের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বীর বিক্রম, পিএসসি। যিনি বাচ্চু মিয়া নামে তাঁর নিজ জন্মস্থানে বহুল পরিচিত। আমাদের চুনতি মায়ের কোল আলো করা বাচ্চু মিয়া কালের পরিক্রমায় হয়ে উঠেন দেশসেরা একজন চৌকস সেনা কর্মকর্তা।
তাঁর বাবা ইসহাক মিয়া ছিলেন তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদের সুযোগ্য চেয়ারম্যান। আর মা মেহেরুন্নেসা ছিলেন একজন গৃহিনী। বাবা মায়ের দুই সন্তানের মধ্যে তিনি ছোটজন। বড় ভাই মুহাম্মদ ইসমাঈল মানিক একজন সমাজকর্মী যিনি চট্টগ্রাম ইপিজেডে Pacific Group এ ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
চুনতি রত্ন জেনারেল আবেদীন তাঁর পেশাগত জীবনে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দেশ সেবায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ সরকার কতৃক “বীর বিক্রম” ও “অসামান্য সেবা পদক OSP" এর মত অত্যন্ত সম্মানজনক রাষ্ট্রিয় সম্মাননায় ভূষিত হন।
ঐতিহ্যবাহী চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে প্রাথমিক এবং ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের পাঠ চুকিয়ে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লং কোর্সে অফিসার হিসেবে ১৯৮০ সালে কমিশন প্রাপ্ত হন। উল্ল্যেখ্য তিনি এসএসসি এবং এইচ এস সি তে বোর্ডের মেধা তালিকায় যথাক্রমে ৭ম ও ৮ম স্থান অর্জন করে তাঁর অনন্য মেধার স্বাক্ষর রাখেন। বিএমএ তে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের কারণে তিনি তাঁর ব্যাচে দ্বিতীয় সেরা চৌকস ক্যাডেট হিসেবে নির্বাচিত হন এবং Chief of Army Staff CANE লাভ করেন।
সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন এবং প্রায় ১ বছর এমবিবিএস অধ্যয়ন করেন।
সুদীর্ঘ আর্মি ক্যারিয়ারে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি অত্যন্ত সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহকারী সামরিক সচিব হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁর পদার্পণ ঘটে। তখন তিনি ছিলেন লেঃ কর্ণেল পদমর্যাদার একজন অফিসার। ২০০৯ সালে তিনি মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন এবং এলিট ফোর্স এস.এস.এফ এর মহাপরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীতে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি সেনাপ্রধান কতৃক CAS Cane Tactics Plaque পদকে ভূষিত হন।
২০১১ সালে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ১৯৮৬ সালের ১০ ই জানুয়ারি উনার একই গ্রামের মেয়ে আসিফা আবেদীন চৌধুরী জিনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। উনার শ্বশুর রফিক আহমেদ চৌধুরী এবং শ্বাশুড়ি নোমেরা বেগম। উল্লেখ্য উপমহাদেশের কিংবদন্তী শিল্পী বুলবুল চৌধুরী উনার জেঠা শ্বশুর। তাঁদের দুই সন্তান। বড় মেয়ে সায়েবা রুজলানা যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহ্যাম থেকে এম.এস.সি ইন ইকোনোমিক্স কমপ্লিট করে পরিবার নিয়ে কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। দেশে থাকাকালীন তিনি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে সিনিয়র রিসার্চ এসোসিয়েট হিসেবে কর্মরত ছিলো। আর ছোট মেয়ে ফাবিহা বুশরা কানাডার কার্লটন ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনোমিক্সে মাস্টার্স করে এখন একই ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি অধ্যয়নরত রয়েছেন।
এই মহান ব্যক্তিত্ব তাঁর গোটা জীবনটাই দেশ মাতৃকার কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছেন। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত জনকল্যাণকর কাজে ব্রত থেকেছেন। স্বীয় জন্মস্থান চুনতির প্রতি তাঁর ছিলো হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা। এক মুহূর্ত সময় পেলেই ছুটে যেতেন প্রিয় গ্রামে। এ মাটির প্রতিটি ধূলিকণায় যেনো তিনি জীবন খুঁজে পেতেন।
রাস্তাঘাট, ব্রীজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ সহ গ্রামীণ অবকাঠামো বিনির্মাণে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় চুনতি মহিলা ডিগ্রী কলেজ ও আমিরাবাদ গোলামবারী উচ্চ বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়। অসংখ্য বেকার শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁর অবদানে চুনতিতে গড়ে উঠেছে ফায়ার সার্ভিস ও মাতৃসদন হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠা করেছেন এতদঞ্চলের দৃষ্টিনন্দন পর্যটন এলাকা চাম্বি রাবার ড্যাম।
তাঁর জীবনের শেষ দিককার এক অমর কীর্তি হলো উনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত চুনতি মেহেরুন্নেসা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চুনতি মেহেরুন্নেসা উচ্চ বিদ্যালয়। পাশাপাশি দুর্গম পার্বত্য এলাকার কোল ঘেঁষে অবস্থিত চুনতির সীমান্তবর্তী পানত্রিশা গ্রামে সুবিশাল এক ক্যাম্পাস নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন বীর বিক্রম জয়নুল আবেদীন উচ্চ বিদ্যালয়। অবহেলিত গ্রামীণ জনপদের হাজারো সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা এই স্কুলগুলোতে পড়াশুনা করছে। এলাকাবাসী ও স্কুলের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্তে তিনি তৈরী করে দিয়েছেন দৃষ্টিনন্দন ইসহাক মিয়া সড়ক। স্বপ্ন দেখতেন একটি সুখী সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল সোনার বাংলা গড়ার।
দেশ মাতৃকার কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ এই বীর সেনানী বিগত ১৭ই ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। অতঃপর তাঁকে তাঁর নিজ জন্মস্থান চুনতি গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। উনার শেষ বিদায়ের দিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশসরকার, সেনাবাহিনী, জনপ্রশাসন, দেশী বিদেশী কুটনিতিক মিশন, জাতীয় ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সিভিল সোসাইটি ও মিডিয়া সহ সর্বস্তরের লাখো মানুষ তাঁর বিদেহী আত্মার প্রতি এক নজিরবিহীন সম্মান প্রদর্শন করেন, যা ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান হয়ে থাকবে।
জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানকে আজ আমরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি। তিনি হয়তো আর আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু কোটি মানুষের স্মৃতিতে, স্মরণে, শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায় চির অমর হয়ে আছেন এ মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তান মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন বীর বিক্রম, পিএসসি। ১৭ই ডিসেম্বর আমাদের এই কীর্তিমানের ১ম মৃত্যুবার্ষিকী।
আপনার মহান কীর্তির মাঝেই লাখো মানুষের অন্তরে আপনি চির অমর হয়ে আছেন। এই জনপদের ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি আপনার মহত্তের কাছে ঋণী।
মহান আল্লাহ আপনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের শ্রেষ্ঠতম স্থানে অধিষ্ঠিত করুন।
স্যালুট হে কর্মবীর।
"চিহ্ন তব পড়ে আছে তুমি হেথা নাই"