ঐতিহাসিক জনপদ চুনতি'র ভৌগলিক গঠন ও ইতিহাস - একটি পর্যালোচনা

ওয়াহিদ আজাদ



চুনতির ভৌগোলিক গঠন অপেক্ষাকৃত নবীন লালচে পাহাড়ি ও অনেক স্থানে পাললিক স্তরযুক্ত। এখানকার ছোট ছোট টিলাগুলো কিছুটা দুর্বল গঠনের বালুকাময় পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ এগুলোর পাথুরে গঠন পেতে আরো হাজার বছর লেগে যেতে পারে। এখনো এখানকার ভূগর্ভস্থ শিলাস্তর বা টেকটোনিক প্লেট সক্রিয় রয়েছে, এমন মনে করা হয়। অত্র উপত্যকায় অসংখ্য প্রস্রবনের (geyser) অবস্থান এ বক্তব্যকে সমর্থন করে। উল্লেখ্য ভূগর্ভস্থ শিলাস্তরের (mantle) মধ্যবর্তী চাপে খনিজ পানি স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রচন্ড বেগে উর্ধ্বমূখে উঠে আসে, যা আমাদের নিকট স্বয়ংক্রিয় টিউব ওয়েল হিসেবে পরিচিত। ধারণা করা হয়, ২/৩ হাজার বৎসর পূর্বে প্লাইয়োষ্টেসিন যুগের শেষ পর্যায়ে কোন এক ভূমিকম্পের ফলে ত্রিপুরা ও বার্মা ফোল্ডের মধ্যবর্তী এই চুনতি উপত্যকার সৃষ্টি। এটি কর্নফুলি নদীর দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত ৭ টি পর্বত শ্রেনীর অন্যতম 'মুরানজা' পর্বত মালার মূল উৎপত্তিস্থল বলা যায়। আরো উল্লেখ্য চুনতি বান্দরবানের মুরানজা ও বাঁশখালীর জলদী পর্বত শ্রেনীর করিডোর যা অতীতের মতো এখনো 'হাতি' চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে পরিচিত।

কোন এক সময় চুনতি উপত্যকার নিম্নাঞ্চল জলাভূমি, যা হয়তোবা পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বিস্তীর্ণ খাঁড়ীর মতো বাঁশখালীর দক্ষিণাঞ্চলে কুতুবদিয়া-মহেশখালী মাঝ বরাবর সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত ছিল (অনেকটা নরওয়েজিয়ান ফিয়র্ডের মতো ভূমিরূপ)। ধারণা করা হয়, বর্ণিত জলাভূমির কিয়দংশের অস্তিত্ব এক/দেড়শো বছর আগেও ছিল। হয়তোবা এই জলাভূমির মৃতপ্রায় অংশ এখনো বাহের খাল ও ডলু খাল হিসাবে প্রবাহমান। এছাড়া হারবাং অভিমূখী বনাঞ্চল ও আধুনগর অঞ্চল সংলগ্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেক বা জলাশয় উক্ত কেন্দ্রীয় জলাভূমির অংশ।

বর্ণিত জলাভূমির মধ্য দিয়ে অতীতে লোকজন ছোট ছোট লঞ্চ, স্টিমারে চড়ে আশেপাশের এলাকায় গমনাগমন করতো, মালামাল বহন করতো ; এমনকি ধারণা করা হয়, কিছু কিছু স্টিমার বঙ্গোপসাগরের উপকূল অঞ্চলে যাতায়াত করতো। আমি শুনেছি '৮০ র দশকে মুন্সেফবাজার সন্নিহিত আমাদের পুরাতন সিকদার বাড়ির (পোতন সিকদার পরবর্তী ভূস্বামী ওয়াদুদ সিকদার ও ভাই সুলতান আহমেদের বাড়ি) খননকালে পুরাতন আমলের (১৯ শতকের) স্টিমারের সামনে থাকে এমন একটি কেরোসিনের বড় "ল্যান্টার্ন সার্চ বাতি"র ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। চুনতি মাদ্রাসা ও চুনতির বড় কবরস্থানের উত্তর অংশে ৫০/৬০ বছর আগেও বড় একটি জলাভূমি ছিল, যাতে পুরাতন আমলের স্টিমারের লোহা নির্মিত ধ্বংসাবশেষ পড়েছিল। কালের পরিক্রমায় জলাভূমি ভরাট হয়ে গেলে, উক্ত জাহাজের ধ্বংসাবশেষ মাটির অনেক নিচে চাপা পড়ে যায়। এলাকাটিকে তখন "জাহাজমারা" বলা হতো। চুনতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক যোগাযোগ মাধ্যম হচ্ছে "হাজির রাস্তা"। বর্তমানে যেটি "হাজির রাস্তার মাথা" হিসেবে আরাকান সড়কে যুক্ত হয়েছে, সেই স্থানে চুনতির বর্ণিত 'জলাভূমি' আধুনগর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার 'জলাভূমি'র সাথে মিশেছে। কারো কারো মতে, পুরনো যুগে হাজিরা বিভিন্ন স্থান হতে পদব্রজে কিংবা গরুর গাড়িতে চড়ে এখানে আসতেন ও নৌকা বা ছোট ছোট স্টিমারযোগে বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর চট্টগ্রাম যাতায়াত করতেন। যে কারণে এলাকাটি পরবর্তীতে "হাজির রাস্তা" হিসেবে পরিচিতি পায়।

উল্লেখ্য, মানচিত্র কিংবা ভূমিরূপ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, আরাকান সড়কটি মোগল আমলে বা তারও আগে হাজির রাস্তা পয়েন্ট বা সংলগ্ন আধুনগর হতে সোজা দক্ষিনে সরলরেখার মত মুন্সেফবাজার বা সংলগ্ন এলাকার উপর দিয়ে বনপুকুর পয়েন্টে বর্তমান মূল সড়ক বরাবর বিস্তৃত ছিল, যা পরবর্তীতে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্ঘটনা কিংবা কোলাহল মুক্ত রাখার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে লোকালয়কে এড়িয়ে বর্তমান পাহাড়ি অঞ্চলের ভেতর দিয়ে ধনুকাকৃতি বাইপাস হিসেবে বনপুকুর এলাকায় মূল সড়কের সাথে মিশেছে। মুন্সেফ বাজার তৎকালীন সময়ে নিয়মিত বাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও স্থানীয় প্রভাবশালী বাসিন্দাদের উদ্যোগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বা তারও কিছু পূর্বে সৈন্য ও যুদ্ধের যানবাহন চলাচলে সৃষ্ট ঝামেলা হতে আবাসিক এলাকা কোলাহলমুক্ত রাখার প্রয়াসে বাজার সম্প্রসারিত হয়নি। একই কারণে এখানে পোস্ট অফিস স্থাপিত হয়নি বলেও অনেকের অভিমত । ইত্যবসরে চুনতি ডেপুটি বাজার বেশ প্রসার লাভ করে। পূর্বে এটি "এড্ডাইক্কা হাট" নামে পরিচিত ছিল (একটু খেয়াল করলে পরিলক্ষিত হয় এ স্থানে ভূমির তল অনেকটা কাত হয়ে আছে)।

যাই হোক চুনতির ভূমিরূপের কথা আলোচনা করছিলাম। খনিজ অনুসন্ধান ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রাপ্ত সমীক্ষা প্রতিবেদন ব্যতিত এতদঞ্চলের ভৌগলিক গঠনের ইতিহাস পুরোপুরি সঠিক পাওয়া সম্ভব নয়। তবে অতীতে অত্র অঞ্চল ও আশেপাশের এলাকায় হাইড্রোকার্বন প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা শোনা যায়, যে কারণে পাকিস্তান আমলে PPL নামক একটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে "বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন লিঃ" (BAPEX) বিদেশি কোম্পানিদের সাথে পরিচালিত যৌথ উদ্যোগে বিভিন্ন সিসমিক সার্ভে ও স্যাটেলাইট সার্ভে পরিচালনার পাশাপাশি স্থানীয় ভূমিরূপ পর্যালোচনা/গবেষণার মাধ্যমে এখানে পেট্রোলিয়াম/গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখতে পায়। অবশ্য অতিরিক্ত কাঁদা গ্যাসের প্রবাহকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে বানিজ্যিকভাবে এর উত্তোলন লাভজনক নয় প্রতীয়মানের অজুহাতে স্বাধীনতার পূর্বে কয়েকটি প্রকল্প সিলগালা করে দেয়া হয়। বস্তুত নেপথ্যে অন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারন ছিলো বলে অনুমান। স্বাধীনতা পরবর্তীকাল হতে অদ্যাবধি এখানে BAPEX এর অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত আছে। বিভিন্ন সূত্র মারফত এতদঞ্চলের ভূ অভ্যন্তরে প্রচুর হাইড্রোকার্বনের মজুদ আছে বলে জানা যায়। উল্লেখ্য চুনতি বৃহত্তর মায়ানমার/মিজোরামস্থিত আরাকান ইয়োমা পর্বত রেঞ্জের মহীসোপান ঢালে পটিয়া এন্টিক্লাইন, জলদী অ্যান্টিক্লাইন ও মাতামুহুরী অ্যান্টিক্লাইন মধ্যবর্তী হওয়ায় পটিয়া/জলদীর পাশাপাশি বড় হাতিয়া ও চুনতির পুটিবিলা সম্ভাব্য হাইড্রোকার্বনের "হটস্পট" বলে অভিহিত।

সূত্র: "Geography of Bangladesh" by Harunur Rashid, The Daily Star, Magazine "Energy & Power", Internet এবং এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বি ও স্থানীয়ভাবে আলাপ-আলোচনা মারফত আমার লদ্ধ পর্যালোচনা।

তারিখ: ০৭.০৬.২০২২




Comments

Leave a Replay

Make sure you enter the(*)required information