একটি অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় থাকে। তেমনি রয়েছে আমাদের প্রিয় চুনতিরও। ইতিপূর্বে আমি আমাদের গ্ৰামের ভূপ্রকৃতির ইতিহাস পর্যালোচনার চেষ্টা করেছি। সে অনুসারে চুনতির ভৌগলিক গঠন অপেক্ষাকৃত নবীন প্রাথমিক স্তরের এবং লালচে বালুকাময় পাহাড়িয়া ও স্থানে স্থানে জলাবদ্ধ নিম্নাঞ্চল সমৃদ্ধ বলে পরিলক্ষিত হয়। অঞ্চলটির এরূপ গঠন হতে ধারণা পাওয়া যায়, এখানকার জনবসতির ইতিহাস প্রাচীন নয়। সুদূর অতীতে চুনতি'র পূর্বে 'মুরানজা' পাহাড় শ্রেনী (মৈন পাহাড় হিসেবে স্থানীয়ভাবে পরিচিত) পর্যন্ত সমুদ্র বিস্তৃত ছিল বলে মনে করা হয়। উল্লেখ্য, মুরানজা পর্বত শ্রেনী দ: চট্টগ্রামে সমান্তরালে অবস্থিত ৭টি পাহাড় শ্রেণীর একটি। এর মধ্যে সর্ব পশ্চিমের পাহাড় শ্রেণীটি বাঁশখালীর সমুদ্রকুল ঘেষা 'জুলদি' পাহাড়মালা। এই জলদি এবং পূর্বের মুরান্জা পার্বত্য অঞ্চলের মাঝামাঝি উপত্যকায় চুনতির অবস্থান। সুদূর অতীতে প্রায় হাজারো বছর আগে দুই পর্বতমালার মাঝামাঝি বড় অংশ বঙ্গোপসাগরের মধ্যে থাকলেও চুনতির কিছু কিছু উঁচু অংশ নরওয়ের ফিয়র্ড (বাংলায় খাঁড়ি বুঝায়) এর মতো বাঁশখালীর জুলদি ও মুরানজা পাহাড়ের সাথে ভেসে ছিলো বলে অনুমান। ৫০০/৬০০ বছর আগেও এখানকার অপেক্ষাকৃত উঁচু উপত্যকাগুলোতে আমাদের পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিলো। চুনতি অতীত কাল হতেই ভৌগলিকভাবে চট্টগ্রাম জেলা অথবা সাবেক চট্টগ্রাম সদর মহকুমার অন্তর্ভুক্ত হলেও কক্সবাজার জেলা অর্থাৎ সাবেক কক্সবাজার মহকুমার সীমানায় অবস্থিত বিধায় চকরিয়ার প্রভাব বেশি পড়েছে বলে প্রতীয়মান। এ কারণে আঞ্চলিকতার জেরে buffer zone বিবেচিত হয়ে ইতিহাসে 'চুনতি' অঞ্চলের তথ্য বেশি পাওয়া যায় না। অথচ বাস্তবতা হলো 'চুনতি' নামক জনপদটি বাঁশখালী ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি রেঞ্জের মাঝ বরাবর অপেক্ষাকৃত সমতল করিডোর আকৃতির বিধায় সুদূর অতীতে স্থলপথে চট্টগ্রাম, উত্তর বংগ ও উত্তর-উত্তর পশ্চিম ভারতীয় ভূখণ্ড হতে বার্মা/আরাকান যেতে এর চেয়ে সহজ দ্বিতীয় কোন পথ ছিলো না। প্রাচীনকালে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলটি কখনো সুস্থির ছিল না। হরিকেল যুগে চট্টগ্রাম অঞ্চল নিগ্ৰীতা নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত ছিল বলে জানা যায়। পরবর্তীতে দ্রাবিড়িয়ান জনগোষ্ঠী নিগ্ৰীতাদের খেদিয়ে দেয়। এরপর খৃষ্টপূর্ব আনুমানিক ২/৩ হাজার বছর আগে মৌর্য সাম্রাজ্য শুরু হওয়ারও পূর্বে আর্য গোষ্ঠী ত্রিপুরা পর্যন্ত তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। আর্যদের কিছু অংশ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে দক্ষিনে চট্টগ্রাম অভিমুখে গমন করে ও স্থায়ী বসতি স্থাপন করে। যাহোক উত্তর চট্টগ্রামে ঘন ঘন বিভিন্ন শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটলেও দক্ষিণ চট্টগ্রাম অনেকটাই ইন্দোচীন মঙ্গোলয়েড অর্থাৎ তিব্বত-বর্মার নৃগোষ্ঠীর অধীনে ছিল। আরাকান বা মগরা এ ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন চুনতি ও আশেপাশের অঞ্চল শাসন করেছে বলে ধারণা করা হয় ( ১৬/১৭ বা ১৮ শতকের "মগের মুল্লুক" হিসেবে বিবেচিত হবারও বহু পূর্ব হতে)। এতদঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের একটি ভালো প্রভাব রয়েছে। কথিত আছে, গৌতম বুদ্ধ উত্তর ভারত হতে আরাকান গিয়েছিলেন। তিনি স্থলপথে চট্টগ্রাম হয়ে আরাকান গিয়েছিলেন বলে কারো কারো অভিমত। উল্লেখ্য পটিয়ার 'হাইঁদগাও' এলাকায় তিনি থেমেছিলেন বলে জনশ্রুতি আছে। যদি স্থলপথে তিনি আরাকান গিয়ে থাকেন তবে অবশ্যই তিনি চুনতি অতিক্রম করেছিলেন। দক্ষিণ চট্টগ্রামের পুরনো বৌদ্ধবিহারগুলো এ ধারণাকে কিছুটা সমর্থন করে। একই সময়ে ত্রিপুরার সাথে চট্টগ্রামের ভৌগলিক সম্পর্ক ছিল বলে ইতিহাসবিদদের অভিমত। তখন সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন আসাম কিংবা উত্তর ভারত হতে ত্রিপুরা হয়ে স্থলপথে চট্টগ্রামের উপর দিয়ে আরাকান যাতায়াত করতো। উল্লেখ্য, আরাকানে অতীতে সাময়িক কিছু সময় যাবৎ হিন্দু শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। একারনে এ অঞ্চলে সনাতন ধর্মের প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। যাই হোক প্রাচীনকালে ত্রিপুরা ও আরাকানীরা চট্টগ্রাম শাসনকালে চুনতি কিংবা এর আশেপাশের অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান নিয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়। এর ফলে চুনতি'র আদি বাসিন্দাদের সাথে ত্রিপুরা ও আরাকানীদের সামাজিক সম্পর্কের অবকাশ রয়ে যায়। বিশেষত একাদশ শতকে বার্মার পাগান রাজা আরাকান দখলে নিয়ে আরো উত্তরে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রাজ্য সম্প্রসারণ করে। এ সময় জনৈক পাগান রাজা 'অনরটা' তাঁর প্রধান পুরোহিত 'শিন অরহন হীনযান' কে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারণার জন্য চট্টগ্রাম প্রেরণ করেন। ধারণা করা হয় তিনিও বৃহত্তর চুনতি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করেছেন। উক্ত পুরোহিত এতদঞ্চলে প্রচলিত 'সংস্কৃতির' পরিবর্তে 'পালি' ভাষার প্রবর্তন করেন বলে জানা যায়। বার্মার বর্ণিত অপর এক প্রভাবশালী পাগান রাজা 'অলৌঙ সিত্তে' দ্বাদশ শতকের কোন সময়ে ত্রিপুরা অধিকার করতে আরাকান-রামু-হারবাং-চুনতি করিডোর হয়ে উত্তর চট্টগ্রাম প্রবেশ করেন বলে কথিত রয়েছে। ত্রিপুরার তৎকালীন রাজা আক্রমণকারী পাগান রাজার নিকট নিজ কন্যা বিবাহ দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। আনুমানিক একাদশ শতকে চট্টগ্রামের আরবগন স্থলপথে আরাকান যাতায়াত শুরু করে, যে কারণে চুনতি ও আশেপাশের অঞ্চলে আরবি উত্তরসূরীদের রেখে যাওয়া সামাজিক প্রভাব দেখা যায়। অবশ্য আরো বহু আগেই আরবরা সমুদ্রপথে আরাকান গিয়েছে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে আরবদের আধিপত্য ঠেকাতে ৯ম শতকে আরাকানি রাজ 'ষোলসিংহ' নিজ বাহিনী নিয়ে রামু-হারবাং-চুনতি হয়ে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা দেয়। এ সময় চট্টগ্রাম পুনরায় আরাকানদের দখলে আসে। আরাকানিদের একটি ক্ষুদ্র অংশ নিষ্ঠুর 'মগ' হিসেবে পরিচিত ছিল। এরা অত্যাচার, নিপীড়ন করতো। এদের মধ্যে "ব্ল্যাক ম্যাজিকের" চর্চা ছিল। 'মইগ্যা বান' বা 'টোনা' এদের একটি শক্ত মন্ত্র। ছিনতাই-ডাকাতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ এরা চুনতিসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখত। এগুলো যাদু-টোনার মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকতো, এমন গুজবের কারণে সাধারণ যে কেউ এ ধরনের সম্পদ হস্তগত করতে পারতো না বা সাহস করতো না বলে ময়-মুরুব্বিদের মুখে শোনা যায়। চতুর্দশ শতকে গৌড়ের সুলতান ফখরুদ্দিন প্রথম চট্টগ্রাম অধিকার করেন। তাঁর প্রধান সেনাপতি 'কদল খাঁ গাজী' দক্ষিণ চট্টগ্রামে তৎকালীন আরাকান সীমানা পর্যন্ত এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীতে ষোড়শ শতকে চকরিয়া পর্যন্ত গৌড়ের সুলতান রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে ইতিহাসে জানা যায়। ১৫২৫/২৬ সালে তৎকালীন গৌড়ের সুলতান গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ শাহ'র একজন সেনাপতি খোদাবক্স খাঁ চকরিয়ার প্রতিনিধি ছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এমন হলে চুনতি অঞ্চলে অবশ্যই তাঁর যাতায়াত ছিলো, ধরে নেয়া যায়। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি আরাকানি রাজা 'মিনকিঙ' রামু হয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চকরিয়া পর্যন্ত দখলে নেন বলে জানা যায়। চুনতিকে প্রাচীনকালে বৃহত্তর চকরিয়ার প্রান্তীয় অঞ্চল হিসেবে গন্য করা হতো বলে ধারণা করা হয়। দক্ষিণ চট্টগ্রাম শাসনকারী সর্বশেষ প্রভাবশালী আরাকান রাজা ছিলেন 'কংগ্লাফ'। তিনি আনুমানিক ১৭৫৬ সালে মোঘলদের কর্তৃক উৎখাত হন বলে জানা যায়। তৎকালীন বাংলার মোঘল শাসক তৎকালীন স্বনামখ্যাত সুবাদার শায়েস্তা খান ও তাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খাঁ এর মাধ্যমে আরাকান, আরাকানের রাখাইন নৃ-গোষ্ঠী মগ ও তাদের সহযোগী হিংস্র হার্মাদ (পর্তুগিজ) বাহিনীকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। আনুমানিক ১৬৬৬ সালে বুজুর্গ উমেদ খাঁ আরাকান সীমান্তে ১২ জন 'হাজারী' (এক হাজার সৈন্য বাহিনীর কমান্ডার বা মনসবদার) নিয়োগ দিয়েছিলেন, যাদের দুজন সাঙ্গু নদীর উত্তর প্রান্তে অবস্থান করছিল। এ কারণে উক্ত জনপদ 'দোহাজারী' নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এই দুজন হাজারীর একজন হলেন আধু খাঁ, যার নামে চুনতির উপকণ্ঠে 'আধুনগর' বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। ধারণা করা হয়, চুনতি তৎকালীন সময়ে একটি আবাসিক গ্রাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এর উপকণ্ঠে বাণিজ্যিক প্রয়োজনে সেনাপতি আধু খাঁ উক্ত বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তবে চুনতি'র অদুরে কোন একটি পাহাড়/টিলার উপর আধু খাঁ আরাকান/মগদের দমন করার লক্ষ্যে দুর্গ তৈরি করেছিলেন। কথিত আছে, আনুমানিক ১৬৬৬ সালে আরাকানিদের হটিয়ে দিয়ে স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তিনি এই দুর্গের পাশেই একটি 'লোহার গড়' স্থাপন করেছিলেন, যা পরবর্তীতে এই এলাকাকে 'লোহাগাড়া' হিসেবে পরিচিত করিয়েছে। এরপর দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটভূমি পর্তুগিজ, আরাকান ও ইংরেজদের হাত বদলের মধ্য দিয়ে আবর্তিত হতে থাকে। দক্ষিণ চট্টগ্রাম ইতিহাসের পাতায় আলোচিত হয়ে উঠে মোঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম দাবীদার শাহ সুজার আরাকান পলায়ন কালে। প্রথমে বড় ভাই দারাশিকোর নিকট ও সর্বশেষ ছোট ভাই আওরঙ্গজেবের নিকট পরাজিত হয়ে তৎকালীন বাংলার গভর্নর শাহ সুজা ১৬৫৯/৬০ সালে ঢাকা হতে স্থলপথে দাউদকান্দি ও দাউদকান্দি হতে নৌপথে আরাকানের জাহাজে নোয়াখালী (তৎকালীন ভূলুয়া) হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছেন। পরবর্তিতে চট্টগ্রাম হতে বর্তমান আরাকান রোড দিয়ে তিনি আরাকান রাজ্যে পৌঁছেন। এই আরাকান রোডকে তাই একসময় "শাহ সুজা সড়ক" বলা হতো। আনুমানিক ১৬৫৯ সালে তিনি শতাধিক পাল্কিসমেত প্রায় ৩০০ জনের বহর ও বিপুল ধন-সম্পদ নিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ করিডোর 'চুনতি' অতিক্রম করেন। এ সময়টি আমাদের বহুল আলোচিত প্রিয় গ্ৰাম 'চুনতি'র জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু ঐতিহাসিকদের মতে এ সময়কাল হতেই অঞ্চলটিকে 'চুনতি' নামকরন করা হয়। যাহোক, দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রাপথে শাহ সুজার বহরের বিরতির দরকার ছিল। এ সময় বিশ্রামের জন্য উপযুক্ত জায়গার সন্ধান করা হচ্ছিলো। ধারণা করা হয়, পাহাড় ও গাছের ছায়ায় জলাভূমি বেষ্টিত এই অঞ্চলকে মোটামুটি কিছুদিনের বিশ্রামের জন্য পছন্দ করা হয়েছিল, যে কারণে এই অঞ্চলটি "পছন্দের স্থান" বা ফার্সিতে "চুনাতি" হিসেবে ইতিহাসে প্রথমবার অভিহিত হয়। পরবর্তীতে অবশ্য কিছুটা বিবর্তিত হয়ে 'চুনতি' হিসেবে পরিচিতি পায়। বিশ্রামকালে বহরের সাথে থাকা কয়েকজন ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা ক্লান্তির কারনে আর যেতে আগ্ৰহী না হয়ে চুনতিতেই নেমে পড়েন। চুনতির পরিবেশ ও সামাজিক অবস্থা তাদের এখানে স্থায়ীভাবে থেকে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে মতান্তরে জানা যায় (এদের মধ্যে একজন ছিলেন সম্ভবত মোঘল সম্রাট পরিবারের গৃহ শিক্ষক)। অবশ্য ঐ সময়ের দীর্ঘ যাত্রা আর যাত্রাপথে বাহনের অনুপযুক্ততার জন্য ভ্রমন বেশ দুরূহ ছিল বিধায় কেউ কেউ সুযোগ বুঝে আরকান রোডের স্থানে স্থানে স্থায়ীভাবে বহর ত্যাগ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। শাহ সুজার বর্ণিত যাত্রা বেশ বিপদসংকুল ছিল, যেহেতু মোঘল সেনাপতি মীর জুমলা তাকে ধাওয়া করছিলেন। শাহ সুজার উক্ত ঐতিহাসিক যাত্রাপথে ঈদ উল ফিতরের দিন পাওয়া যায়। চকরিয়ার উপকণ্ঠে এক স্থানে তিনি ও তাঁর বহর ঈদ উল ফিতরের নামাজ আদায় করেন। এই স্থানটিই বর্তমানে 'ঈদগাহ' নামে পরিচিত হয় বলে জানা যায়। শাহ সুজার চুড়ান্ত পরিনতি নিয়ে ইতিহাসে দ্বিমত রয়েছে। অধিকাংশের মতে আশ্রয়দাতা আরাকান রাজা ধন সম্পদ ও শাহ সুজার সুন্দরী কন্যার লোভে শাহ সুজাসহ অপরাপর সদস্যদের হত্যা করে। কারো কারো মতে তিনি ও জীবিত কয়েকজন সদস্য আরাকানের স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর সহায়তায় জাহাজে চড়ে মক্কায় গমন করেন। আবার কারো কারো ধারণা, তিনি গোপনে ছদ্মবেশ নিয়ে পুনরায় আরাকান রোড হয়ে ত্রিপুরা গমন করেন ও পরবর্তীতে ত্রিপুরা রাজার সহযোগিতায় মক্কা যাত্রা করেন। তবে কেউ কেউ শাহ সুজার প্রস্থানের বিষয়কে অতিরিক্ত রহস্যময় করে তুলেছেন এই বলে যে, তিনি আদৌ আরাকান পৌঁছেননি, বরং আরাকান রোডের মাঝপথে কোন এক জায়গায় স্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছিলেন। এমন রহস্যময় ইতিহাস সত্য হলে, চুনতি নামক স্থানে তাঁর স্থায়ী বসবাসের বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ইতিহাস পর্যালোচনায় পরিলক্ষিত হয়, বাংলার মোঘল শাসক শাহ সুজার এ অঞ্চল দিয়ে প্রস্থানকালে বা অব্যবহিত পরে চুনতি অঞ্চলে শিক্ষিত লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়েছিলো। এ সময় আনুমানিক ১৬৯০/৯৫ সালে গৌড় হতে সুফি নসরত উল্লাহ মিয়াঁজী মতান্তরে খন্দকার (চুনতির ঐতিহাসিক বড় মিয়াঁজী ও ছোট মিয়াঁজীর পিতা), ১৭০৮/১০ সালে আরাকান হতে মাওলানা মুকিম আল আজাদ প্রমূখ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ চুনতি আসেন ও বসবাস শুরু করেন (ইতিহাসে আরাকানীদের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হলেও সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি ও শেষ দিকে এখানে মুসলিমদের কিছু আধিপত্য দেখা দিয়েছিল। এ সময় সংস্কৃতিমনা বিশিষ্ট আমলা মাগন ঠাকুর ও কবি আলাওলের উত্থান দেখতে পাওয়া যায়)। শ্রদ্ধেয় বড় ভাই কাজী আব্দুল বাসেত দুলাল এর মতে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে গৌড় হতে মৌলানা আমজাদ হোসেন খন্দকার প্রথম বিশিষ্ট ব্যক্তি হিসেবে চুনতি অঞ্চলে পদার্পণ করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। উল্লেখ্য তিনি চুনতিবাসীর অন্যতম মূল পূর্বপুরুষ ইব্রাহীম খন্দকারের দাদার বাবা ছিলেন। এসময় হতে মূলত চুনতি একটি শিক্ষিত ও সুষ্ঠু ধর্মীয়/আধ্যাতিক চর্চা সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে আশেপাশে পরিচিতি অর্জন করতে শুরু করে । ইতিহাসে আরো একবার দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও চুনতি'র নাম আলোচিত হতো যদি শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ইংরেজরা সড়কপথে রেঙ্গুন নির্বাসনে পাঠাতো। কিন্তু তা হয়নি। ১৮৫৮ সালে জাহাজ পথে তাকে রেঙ্গুন পাঠানো হয়েছিল। তবে ঐতিহাসিকভাবে গুঞ্জন রয়েছে, ঐ সময়ে বাহাদুর শাহ জাফরের কিছু অনুসারী স্থলপথে আরাকান সড়ক হয়ে চুনতির উপর দিয়েই আরাকান হয়ে বার্মার রাজধানী রেঙ্গুন পৌঁছেছিল। ইতিহাসের পাতায় চুনতির নাম তেমন আলোচিত না হলেও, চুনতি নামক অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের যাতায়াত ঘটেছে। চুনতির স্থানীয় আদি বাসিন্দাগন তাদের সংস্পর্শ পেয়েছেন, তাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়েছেন, এমনকি তাদের সাথে পারিবারিক সম্পর্কও গড়েছেন। হতে পারে তারা আরাকানি, মগ, সনাতন, বৌদ্ধ, পর্তুগিজ, আরবি, আফগানি, গৌড়, ত্রিপুরা, মোঘল অথবা ইংরেজ বংশদ্ভুত। যাই হোক না কেন, চুনতির বর্তমান বাসিন্দাদের অনেকের পূর্বপুরুষের ধারা এমন ক্রমানুসারে বিবর্তিত হয়েছে। এছাড়াও ১৯ শতকে চুনতি হাকিমিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হলে আশেপাশের অঞ্চল হতে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের লোকজন শিক্ষা গ্রহণ কিংবা শিক্ষা প্রদানের সূত্রে চুনতিতে আবাস গড়েন। এরা সচরাচরভাবে চুনতিতে বিয়ে করে স্থায়ী হয়েছেন। এতদঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ও সহজ যাতায়াতের একমাত্র করিডোর চুনতি এভাবে পারিবারিক ও সামাজিক সূত্রে গণ্যমান্য সম্প্রদায়ের সাথে আবদ্ধ হয়ে একটি আধুনিক প্রজন্মের সৃষ্টি করেছে। এ ধারাবাহিকতায় আজকের চুনতি বিভিন্ন শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, প্রভাবশালী ও বনেদি পরিবার/বংশের পরিচয়ে সমুজ্বল হয়েছে। [সূত্র: ওহিদুল আলম রচিত 'চট্টগ্রামের ইতিহাস', সৈয়দ মুস্তাফা আলীর 'চট্টগ্রামের ইতিহাস', আহমাদুল হকের 'History of Arakan', আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ এর 'আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য', কালের কন্ঠ পত্রিকা (অন লাইন) , ১৪ এপ্রিল, ২০১৫ ('হাজার সৈন্য ছিল দোহাজারীতে' শীর্ষক প্রতিবেদন), উইকিপিডিয়া ও আরো কিছু সূত্র মারফত প্রাপ্ত আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ , বিভিন্ন সময়ে এলাকার বড় ভাই কাজী আব্দুল বাসেত দুলাল ভাই, হাবিব ভাই, আলমগীর ভাই, শ্রদ্ধেয় জ্যাঠামশাই মরহুম ওসমান গনি, শ্রদ্ধেয় মরহুম হারুন চাচা, বিশিষ্ট মুরব্বি জাফর মাস্টার, আমার বাবা মরহুম আফতাব উদ্দিন, বড় ভাই মরহুম শামসুদ্দিন পারভেজ, আনোয়ার ভাই ও মোহাম্মদ ভাইসহ আরো অনেকের নিকট হতে শোনা/প্রাপ্ত তথ্য]।
ছবির ক্রেডিট: আদরের ভাগ্নে চুনতি 'র গর্ব আব্দুল হালিম।
ওয়াহিদ আজাদ ২৮.০৭.২০২২
Make sure you enter the(*)required information