ভারতের উত্তর প্রদেশ। এ প্রদেশের বিভাগীয় শহর গুন্ডায় শায়িত রয়েছেন মহান অলি হযরত শাহ মাওলানা হাফজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.)। তাঁর জন্মস্থান ভারতের প্রসিদ্ধ আজমগড় জেলার কুহন্ডায়। আজমগড় জেলার বাসিন্দা বিধায় তিনি আজমগড়ী হযরত হিসেবে সমধিক পরিচিত। আজমগড়ের কুহন্ডায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭১/৭২ খ্রিস্টাব্দে। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি হাফেজে কুরআন ছিলেন। ফলে ঐ অঞ্চলে তাঁকে বড়া/বড় হাফেজী হুজুর হিসেবে সম্মোধন করা হয়। তাঁর পিতা হযরত শাহ সুফি মাওলানা শেখ করিম বক্স (রহ.) অলিয়ে কামেল পীরে ত্বরীকত ছিলেন। হযরত শেখ করিম বক্স (রহ.)’র পীর ছাহেব হচ্ছেন হযরত শেখ নেজাবত আলী (রহ.)। ত্বরীকতে তাবলীগের সফরে তাঁর অন্যতম খলিফা হযরত শেখ করিম বক্স (রহ.)’র বাড়িতে তাশরীফ আনলে তথায় তিনি ১৮৮৮/৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। ফলে হযরত শেখ করিম বক্স (রহ.) তাদের পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর মহান পীর হযরত শেখ নেজাবত আলী (রহ.) কে জানাজার পর দাফন করা হয়। আজমগড়ী হযরতের পিতা হযরত শেখ করিম বক্স (রহ.) একজন জরিপ বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ঐ অঞ্চলের জমিদার পরিবার হিসেবে স্বীকৃত। তিনি কর্তব্য কাজে অবিভক্ত বাংলার উভয় অঞ্চল সফর করতেন। সাথে তাবলীগে ত্বরীকতের খেদমতও করে যেতেন। তিনি চট্টগ্রামেও সফর করতেন। এমনকি কলকাতা চট্টগ্রাম হয়ে ইয়াঙ্গুন (রেঙ্গুন) ও আকিয়াব যাতায়াত করতেন। সেই ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের সাথে কক্সবাজার, আকিয়াব, ইয়াঙ্গুন, কলকাতায় নিয়মিত জাহাজ চলাচল করত। ফলে আজমগড়ী হযরতের পিতা চট্টগ্রাম হয়ে আকিয়াব, ইয়াঙ্গুন যাতায়াত করতেন দাপ্তরিক কাজে। বাংলার পশ্চিমাঞ্চল সফরকালে হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.)’র সাথে মোলাকাত হয়। ফলে হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) চিশতিয়া সিলসিলায় ত্বরীকতে দাখিল হন এবং পরবর্তীতে খেলাফত লাভ করেন। হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) তাঁর মহান পীর হযরত শেখ করিম বক্স (রহ.)’র সাথে একাধিক বার আজমগড়ের কুহন্ডা গমন করেছিলেন। হযরত শেখ করিম বক্স (রহ.)’র নিজের মাদারজাত অলি সন্তান হযরত হাফেজ হামেদ হাসান আলভীকে নিজের খলিফা হযরত ছৈয়দ আবদুল বারীর হাতে ত্বরীকতে দাখিল করান। হযরত শেখ করিম বক্স (রহ.) ইন্তেকাল করলে তাঁকে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে মহান পীর হযরত শেখ নেজাবত আলীর নিকটে দাফন করা হয়। এদিকে আজমগড়ী হযরত তাঁর শ্রদ্ধাভাজন পীর হযরত ছৈয়দ আবদুল বারীর (রহ.)’র নিকট থেকে ত্বরীকতে তালীম নিতে থাকেন এবং পিতার অনুকরণে কলকাতা চট্টগ্রাম হয়ে আকিয়াব ইয়াঙ্গুন যাতায়াত করতেন। অপরদিকে,হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) মুজাদেদ্দীয়া ত্বরীকায় হযরত সুফি গোলাম সালমানী (রহ.)’র হাতে ত্বরীকতে দাখিল হন এবং খেলাফত লাভ করেন। পরবর্তীতে সাত ত্বরীকার মহান ইমামগণ হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) কে সরাসরি খেলাফত দানে ভূষিত করেন। তিনি আওলাদে রসূল (স.)। ছিলেন হাসানী হোসাইনী উভয় দিক দিয়ে। তাঁর জন্ম ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে বলে জানতে পারা যায়। তাঁর পূর্ব পুরুষ পবিত্র আরব ভূমি থেকে দিল্লি হয়ে বাংলায় আসেন। তাঁর স্বাস্থ্য অতি দুর্বল থাকত। পেটের পীড়ায় ঘন ঘন আক্রান্ত হতেন। তিনি ১৬ রমজান ১৩১৮ হিজরি ২৯ ডিসেম্বর ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৪০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করলে পশ্চিম বঙ্গের হুগলি জেলার বিখ্যাত বান্ডেল রেল স্টেশনের একদম নিকটে মাত্র ২/৩ শ’ মিটারের মধ্যে জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়। তাঁর পার্শ্বে তাঁর পুণ্যবর্তী স্ত্রীও শায়িত। তখন তাঁর মুরিদ সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ জন। আজমগড়ী হযরত মায়ানমার থাকা অবস্থায় তাঁর শ্রদ্ধাভাজন পীর ছাহেব হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বে প্রকাশ্যে তাঁর অন্যতম যোগ্য দু’জন মুরিদ আজমগড়ী হযরত ও মাওলানা আবদুস সামাদ (রহ.) কে খেলাফত দিয়ে যান। আজমগড়ী হযরত আরাকানে শিক্ষকতা করতেন। মায়ানমার হল তাঁর পিতার কর্ম ও ত্বরীকত উভয় দিকের যাতায়াতের অঞ্চল। তথায় তাঁর পিতার অসংখ্য মুরিদ রয়েছে। নিজের পীর ছাহেব ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) অসুস্থতার সংবাদ শুনলে তিনি আকিয়াব থেকে সরাসরি বান্ডেল চলে আসেন। এরিমধ্যে সৈয়দ ছাহেব হুজুর ইন্তেকাল করেন। তথায় পৌঁছে জেয়ারতের পাশাপাশি তাঁর পীর ছাহেব কর্তৃক খেলাফত দানের কথা জানতে পারেন। তখন থেকে আজমগড়ী হযরত নিজ বাসস্থান আজমগড়ের কুহন্ডা থেকে বাংলার বান্ডেল হয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসতে থাকেন। চট্টগ্রাম থেকে আকিয়াব যাতায়াত করতেন সাগর পথে। আজমগড়ী হযরত চট্টগ্রাম হয়ে আকিয়াবে বৎসরে এক বা একাধিক বার তাবলীগে ত্বরীকতের সফরে আসতেন। এখানে উল্লেখ্য, হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ) ইন্তেকালের পর তাঁর দাদা পীর হযরত শাহ সুফি মাওলানা গোলাম সালমানী ফুরফুরা (রহ.)’র সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। দাদা পীর আজমগড়ী হযরতকে নির্দেশ দিয়ে ছিলেন বৎসরে কম করে হলেও তিন মাস তাবলীগে ত্বরীকতের সফর করতে। তিনি শারীরিক সক্ষম থাকা অবস্থায় তা পালন করে গেছেন। অবিভক্ত বাংলার পাশাপাশি মায়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে আকিয়াবে আজমগড়ী হযরতের কর্মস্থল পরবর্তীতে ত্বরীকতের জংশন ছিল। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া চুনতীর বিখ্যাত জমিদার হযরত মাওলানা কাজী মুহাম্মদ ইউসুফ আলী (রহ) ছিলেন আকিয়াব অঞ্চলের বিখ্যাত জমিদার। তিনি ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে হজ্বে গমন করলে তথায় ইন্তেকাল করেন। এতে তাঁর তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান হযরত মাওলানা ফয়েজ আহম্মদ (রহ.) তাঁদের জমিদারী দেখাশুনার প্রয়োজনে আকিয়াবে অবস্থান করতেন। ঐ সময় তিনি আজমগড়ী হযরতের হাতে মুরিদ হন। অপরদিকে, চুনতীর হযরত মাওলানা ফজলুল হক (রহ.) আকিয়াবে অবস্থানকালে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে আজমগড়ী হযরতের হাতে মুরিদ হন এবং পরবর্তীতে খেলাফত লাভ করেন। তিনি ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে চুনতী নিজ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আজমগড়ী হযরতের ১০ বছরের বড় ছিলেন। আজমগড়ী হযরত থেকে প্রথম দিকে খেলাফত প্রাপ্ত কয়েক জনের মধ্যে তিনি একজন। হযরত ছৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) ও সুফি গোলাম সালমানী (রহ.)’র সংস্পর্শ লাভ করেছিলেন। এমনকি হযরত সুফি ছৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)’র সাথে সম্পর্ক ছিল। কলকাতা মানিকতলায় জানাজা দাফনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে চুনতী নিজ গ্রামে ইন্তেকাল করেন। পর দিন শুক্রবার তাঁর জানাজায় তখনকার আমলে প্রায় ১০ হাজার লোকের সমাগম হয়েছিল। তাঁর ইন্তেকাল পরবর্তী ঈছালে ছাওয়াব তথা মেলার দিন নির্ধারণ করা হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি তথা বাংলা মাঘ মাসে। ইন্তেকাল পরবর্তী চুনতীবাসী ও তাঁর মুরিদগণ একটি মেজবানের আয়োজন করতে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সেকালে মেজবান আয়োজন করা সময় সাপেক্ষ কষ্টসাধ্য ছিল যথাযথ সরঞ্জামের অভাবে। এ মেজবান আয়োজনের কথা আজমগড়ী হযরতের কানে যাওয়া মাত্র তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং নির্দেশ দেন “ইয়ে সব বন্ধ কর” অর্থাৎ এসব কিছু বন্ধ কর। সে থেকে আজমগড়ী সিলসিলায় খলিফাগণের ইন্তেকালের পর যেয়াফত, ওরশ, মেলা ইত্যাদি করা বন্ধ হয়ে যায়। (আগামীবারে সমাপ্ত) সুত্র ঃ www.ahmadulislamchowdhury.info
Make sure you enter the(*)required information