একজন সাদা মনের মানুষ ও সদা হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী।দেশে যে কয়েকজন নাম করা চিত্র শিল্পীদের মধ্যে তিনি উল্লেখযোগ্য একজন ভাল চিত্র শিল্পী ছিলেন। তিনি ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানার চুনতী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী সুবিখ্যাত ও সুপরিচিত পীরে কামেল হযরত শাহ সুফী আলহাজ মাওলানা আব্দুল হাকিম সিদ্দিকী (রহ.) (খলীফায়ে হযরত শহীদ সৈয়দ আহমদ বারীলভী (রহ.) যার নামানুসারে সুবিখ্যাত দ্বীনে প্রতিষ্ঠান চুনতী হাকিমিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা) এর বংশধর। তাঁর পিতার নাম অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুন নূর সিদ্দিকী। তার পিতা একজন প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন এবং অলীয়ে কামেল ছিলেন।মাওলানা আব্দুন নূর সিদ্দিকী সাবেক অধ্যক্ষ বাজালিয়া হেদায়াতুল ইসলাম সিনিয়ার মাদ্রাসা ও হুলাইন ইয়াছিন আউলিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসায় সুনাম ও দক্ষতার সহিত নিবিড়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি চুনতী হাকীমিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত মুহাদ্দিস এবং পদুয়া হেমায়াতুল ইসলাম সিনিয়ার মাদ্রাসা (আল জামেউল আনওয়ার)’য় সাবেক মুহাদ্দিস ছিলেন। তিনি চুনতী মিয়াজী পাড়া হযরত শাহ আবু শরীফ জামে মসজিদে পেশ ইমাম ও খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি চন্দনাইশ সাতবড়ীয়া আরিফ শাহ পাড়া জামে মসজিদ এবং কুসুমপুরা জামে মসজিদ (জিরি) এ ইমাম ও খতীব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এমন কি তিনি বাংলাদেশ ছাড়া বার্মা (মায়ানমার) এবং ভারতের কাশমীরী গেইট, উঁচী মসজিদ দিল্লী তে পেশ ইমাম ও খতীব হিসেবে নিবিড়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতের দিল্লী প্রদেশে“শ্রেষ্ঠ খতীব” হিসেবে সম্মাননা সনদ এবং পুরস্কার লাভ করেন। এমন কি এই আলেমে দ্বীনকে অভিজ্ঞ অধ্যক্ষ ও প্রশাসক হিসেবে স্বীকৃতি স্বরুপ চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্য্যায়ে “শ্রেষ্ঠ শিক্ষক” হিসেবে সম্মাননা প্রদান করেন । যিনি একই সাথে চুনতীর ঐতিহাসসিক ১৯ দিন ব্যাপী মাহফিলে সিরাতুন্নবী (সাঃ) এর প্রতিষ্ঠাতা হযরত শাহ হাফেজ আহমদ (রহঃ) এর শ্বশুর ছিলেন। তার মাতার নাম আয়েশা সিদ্দিকা। তার দাদার নাম মাওলানা আব্দুস সালাম (রহ)। পারিবারিক পরিবেশে কুরআন শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের পর প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ চুনতী হাকীমিয়া কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এই প্রতিষ্ঠান হতে রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী প্রথম বিভাগে ১৯৬৮ সালে দাখিল, ১৯৭০ সালে আলিম ও ১৯৭২ সালে কৃতিত্ব সহিত ফাজিল পাশ করেন। অতঃপর তিনি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসায় কামিল প্রথম বর্ষে ভর্তি হন এবং ১৯৭৪ সালে কামিল (হাদীস) বিভাগ হতে কৃতিত্ব সহিত উত্তীর্ণ হন। এইখানে তার বরণ্য হাদীসের উস্তাদদের মধ্যে ফখরুল মুহাদ্দেসিন শায়খ মুফতি মাওলানা আমিনুল মুহাদ্দিস (রহঃ), শায়খ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী মুহাদ্দিস (রহঃ), মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল আরকানী (রহ:) , প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল মান্নান (রহ) ও মাওলানা নাওয়াব হোসাইন প্রমুখ অন্যতম ছিলেন।মাদরাসা শিক্ষা শেষ করার পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। ১৯৭৯ সালে অনার্স ও ১৯৮০ সালে এম এ ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮৪ সালে জার্মানি থেকে টেক্সটাইল ডিজাইন ও প্রিন্টিং এর উপর পোস্টগ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা অর্জন করেন।রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী ছাত্র জীবনে যেমনিভাবে সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেছেন তেমনিভাবে কর্মজীবনেও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি একজন কীর্তিমান জননন্দিত চারুকলা শিল্পী হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। সামজিক দায়বদ্ধতা ও রাষ্ট্রের অন্যায় ও প্রতিবাদ গুলি রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকীর লেখালেখিতে ফুঠে উঠত। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্র, চাকসুর (১৯৭৯-৮০) সাবেক বার্ষিকী সম্পাদক ছিলেন। তিনি 'চিটাগাং ডায়িং এন্ড প্রিন্টিং', 'মোনাভী টেক্সটাইল', 'রিজেন্ট টেক্সটাইল' ও 'এইচ. এইচ টেক্সটাইল' এ জেনারেল ম্যানেজার পদে সুনাম সহকারে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৭ সাল থেকে ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত "শান্ত-মরিয়ম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজী (SMUCT)তে ফ্যাশন ডিজাইন ও টেকনোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পাশাপাশি নিজস্ব এ্যাড ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী শুধুমাত্র একজন শিক্ষক কিংবা চিত্রশিল্পী ছিলেন না। একজন আদর্শ পিতাও ছিলেন। এমনকি একজন অভিভাবক বঠে। তিনি প্রত্যেকটি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নিজ সন্তানের মত মনে করতেন। আর ছাত্র-ছাত্রীরাও তাঁকে পিতৃতুল্য স্থানে স্থান দিতেন। রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী একজন চিত্রশিল্পী হলেও কুরআন, হাদীস, আরবী, উর্দু ও ফার্সি ইত্যাদি ইসলামী শিক্ষায় পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি উত্তম আদর্শ ও অনুপম চরিত্রের অধিকারী সুমহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। নম্রতা ও বিনয়বনতা, দানশীলতা প্রভৃতি গুণাবলীতে তিনি ছিলেন অনন্য ও অসাধারণ। ব্যবহার ছিল অমায়িক, সুমধুর এবং নিরহংকার। কোন দিন তিনি বংশীয় ঐতিহ্য এবং জ্ঞানের বাহাদুরী করতেন না। তিনি বড়দের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন এবং ছোটদের প্রতি স্নেহ করতেন। তিনি সত্য ভাষী, সহিষ্ণু, ধৈর্যশীল এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন ছিলেন। তিনি সমাজসেবকমূলক বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথেও জড়িত ছিলেন। সাংস্কৃতিক জগতেও তার পদচারণ ছিল।রফিকুল ইসলাম সিদ্দিকী ২৬ জুলাই ২০১৯ দিবাগত রাত একটায় তার প্রভুর ডাকে সাড়া দেন। তিনি দীর্ঘদিন কিডনির জটিল রোগে ভুগছিলেন। শুক্রবার সকাল ৭টায় "শান্ত-মরিয়ম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজীতে প্রথম জানাজা নামাজ, বিকেল ৩টায় চারুকলা ইনস্টিটিউটস্থ শিল্পী রশিদ চৌধুরী আর্ট গ্যালারি চত্বরে তার দ্বিতীয় জানাজা নামাজ এবং সবশেষে রাত ৮টায় চুনতীর ঐতিহ্যবাহী ১৯ ব্যাপী সীরাত মাঠ প্রাঙ্গনে পীরে কামেল মাওলানা আব্দুন নূর সিদ্দিকী (রহ)'র মেঝো ছেলে তথা মরহুমের ভাই শিক্ষাবিদ মাওলানা জোবাইর হোসেন সিদ্দিকীর ইমামতিতে ৩য় জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়।পরে তাঁকে তার পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মহান আল্লাহর কাছে এই মহান ব্যক্তিত্বর জান্নাত কামনা করছি।লেখক : মোহাম্মদ ইমাদ উদ্দীন, কলামিস্ট। প্রচার ও প্রকাশনা সচিব,বাংলাদেশ মুসলমান ইতিহাস সমিতি।
Make sure you enter the(*)required information