৪৫ বছরের ব্যান্ডজীবন। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যান্ড সোলসের শুরুর দিকের সদস্য, গড়ে তুলেছেন রেনেসাঁ।খুঁজে এনেছেন আইয়ুব বাচ্চুকে।সুরে খেলা করে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণ। নকিব খানের গানজীবনের মুখোমুখি হয়েছেন ওমর শাহেদ(কালের কন্ঠ)।
গানে কিভাবে এলেন?আব্বা মোহাম্মদ আয়ুব খান চট্টগ্রামের কাজেম আলী হাইস্কুলের আমৃত্যু প্রধান শিক্ষক, গানের খুব ভক্ত ছিলেন। মা আক্তার জাহান খানও গানের অনুরাগী ছিলেন। নানা ‘কাওয়াল’ ছিলেন। কলকাতা থেকে তাঁর লং প্লে (এলপি) বেরিয়েছিল। আমরা চট্টগ্রাম জেলার লোহাগড়া উপজেলার চুনতি গ্রামের বাসিন্দা। বড় ভাই মোহাম্মদ জিলু খান চট্টগ্রাম বেতারের নামকরা সুরকার ছিলেন, ভালো গাইতেনও।
তাঁদের ব্যান্ডদল ছিল—‘বালার্ক’। বাদ্যযন্ত্রগুলো আমাদের স্কুল কম্পাউন্ডের বাসায়ই থাকত। তাঁরা প্র্যাকটিস করতেন। ভাই গাইছেন, বাজাচ্ছেন, দেখে দেখেই আমার ও ছোট ভাই শাহবাজ খান পিলুর গান শেখা শুরু। তিনিই আমাদের দীক্ষাগুরু। কেজি ওয়ান থেকে গাই। গাইতে গাইতে গায়েন হয়েছি। চট্টগ্রাম বেতারে ছোটদের নাটকে অভিনয় করতাম। তখন ফোর-ফাইভে পড়ি। একসময় মনে হলো, গানই আমার জীবন। দুই-তিন বছর অভিনয়ের পর ফের গাওয়া শুরু করলাম। অনুপ্রেরণা?মা-বাবা ও বড় ভাই খুব সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের কাছে অনেক উৎসাহ পেয়েছি। চট্টগ্রাম শহরে তখন অনেক নামি মিউজিশিয়ান। চট্টগ্রামের ‘লাইটনিংস’ ব্যান্ডকে বিটলসের বাংলাদেশি সংস্করণ বলা হয়। ব্যান্ডের শাকিল ভাই অসাধারণ গিটারিস্ট, ভালো কি-বোর্ডও বাজাতেন। একদিন বাড়িতে এসে ইলেকট্রিক অর্গান দেখে বললেন, ‘একটু বাজাই?’ বাজানো শুরুর পর মুগ্ধ হয়ে গেলাম, মানুষ এত সুন্দর বাজায়! আরো অনুপ্রেরণা তৈরি হলো। তখন তো এত গান শোনার সুযোগ পেতাম না। তার পরও ওয়েস্টার্ন মিউজিক নিয়ে খুব ভাবতাম, রক ব্যান্ড ‘বিটলস’, ‘ঈগলস’, ‘ডিপ পার্পল’, ‘রোলিং স্টোন’-এর গান খুব শুনতাম। ডিপ পার্পলের কি-বোর্ডিস্ট জন লর্ডের বাজনা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁর স্টাইল অনুসরণের চেষ্টা করতাম। তো ঢাকায়ও তেমন ইনস্টিটিউশন ছিল না, চট্টগ্রামে তো ছিলই না। ফলে শুনে শুনে শিখেছি। সিনিয়র ভাই-আংকেলরা বিদেশ থেকে এলপি আনলে শোনার জন্য ধরনা দিতাম।ব্যান্ডের শুরু কি বালার্কে?আমরা তিন ভাই-ই বালার্কে পারফর্ম করেছি। ১৯৭২ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় ব্যান্ডে বাজানো শুরু করেছি। পিলু তখন থ্রি কি ফোরে পড়ে। সে বছর কক্সবাজারে জীবনের প্রথম কনসার্ট করলাম। জিলু ভাই কি-বোর্ড, আমি পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ন, পিলু ড্রামস-পারকাশন বাজাল। সে এত ছোট ছিল যে দেখাই যাচ্ছিল না। দর্শকরা অবাক হয়ে খুঁজেছেন। সেদিন বুঝলাম, দর্শক গান খুব ভালোবাসে। এরপর চট্টগ্রামে আমরা বেশ আলোচিত হয়ে গেলাম। ব্যান্ড সংগীতের এত প্রসার হয়নি বলে তখন সাংস্কৃতিক দল হিসেবে নানা জায়গায় বড় ভাইয়ের সুর করা গান গাইতাম। প্রবাল চৌধুরী, উমা চৌধুরীও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। প্রবালদার গলা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো, তিনি তাঁর গান গাইতেন, উমাদি লতা মুঙ্গেশকরের মতো। তাঁরা অনেক কাভার সং গাইতেন। তবে আমি তখন গাইতাম না, বাজাতাম। জিলু ভাই চাকরি শুরু করায় ১৯৭৩ সালে ব্যান্ডটি ভেঙে গেল।সোলসে কিভাবে এলেন?১৯৭৩ সালে ‘সুরেলা’ নামের ব্যান্ড দলের নাম বদলে হলো ‘সোলস’। কি-বোর্ডিস্ট হিসেবে ১৯৭৪ সালে যোগ দিলাম। বালার্কের বোর্ড, ড্রামসসহ সব বাদ্যযন্ত্র সোলস কিনে নিল। এসব বাদ্যযন্ত্র দিয়েই সোলসের যাত্রা। ‘লাইটনিংস’ ভেঙে যাওয়ায় তাদের বাদ্যযন্ত্রও আমরা কিনে নিলাম। ফলে সোলস খুব সমৃদ্ধ হলো। চট্টগ্রামের নানা জায়গায় অনেক শো করলাম। আগ্রাবাদ হোটেলে নিয়মিত শো করেছি। যত দিন সাজেদ দেশে ছিল, তার কাজীর দেউরির বাসায় সোলসের প্র্যাকটিস হতো। সে বিদেশে চলে যাওয়ার পর আমাদের বাসায় প্র্যাকটিস হয়েছে। তপনও (চৌধুরী) তখন সোলসে। রনিদা, সাজেদ, লুলু, নেওয়াজ ভাই, রুডিসহ আরো অনেকেই আছেন। আমরা একসঙ্গে গাই, অনুশীলন করি। তপনের অনেক গানে আমি সুর দিয়েছি। ১৯৭৮ সালে লেখা ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ তো কিংবদন্তি। এটি আমারই লেখা, জিলু ভাই ও আমি মিলে সুর করেছিলাম। এ ধরনের আরো অনেক গান সোলসে করেছি, যেগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আগে সোলস আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ বা জনপ্রিয় লোকগান গাইত। আমি যোগ দেওয়ার পর থেকে তারা আমার সুরে মৌলিক গান গাওয়া শুরু করল। প্রথম দিকে এসব গান গাওয়ার পর মনে হতো, হয়তো দর্শকরা গানগুলো শুনছে না। সতীর্থ মিউজিশিয়ানরা সব সময় বলত, ‘ভাই, একটু পপুলার গান করেন, স্টেজে তো মানুষকে আনন্দ দিতে হবে। আপনার গান তো কেউ শুনবে না। ’ আমি বলতাম, ‘মৌলিক গান ছাড়া কোনো দিন আমরা দর্শকের মধ্যে স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারব না। মৌলিক গান গাইতেই হবে, সেগুলোই টিকে থাকবে। ’ সেটিই হয়েছে। প্রথম দিকে যখন স্টেজে ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’ গাইতাম, তেমনভাবে কেউ শুনত না। আমাদের অনেকেরই মন খারাপ হয়ে যেত। কিন্তু আমি বলতাম, ‘একসময় অবশ্যই এই গান মানুষ শুনবে, পছন্দ করবে। ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ একদিন না একদিন মানুষ শুনবেই। ’ এত বাধার পরও অনড় ছিলাম বলে সোলস ও আমরা সফলতা পেয়েছি। তখন আমি সোলসের গানে সুর করতাম। জিলু ভাইয়ের সুর করা অনেক গানও সোলস গেয়েছে। হেনা ইসলাম খুব ভালো গান লিখতেন। তাঁর কয়েকটি গান আমরা গেয়েছি। তাঁর লেখা, জিলু ভাইয়ের সুরে সোলসে এ দেশের প্রথম রক অ্যান্ড রোল গান গেয়েছি—‘দরগাহে মোম জ্বেলে কী হবে? মিথ্যে ফকির সেজে কী হবে?’ এটি প্রথম অ্যালবামে আছে।কিভাবে ‘সোলস’ নজর কাড়ল?চট্টগ্রামের ব্যান্ড ‘সোলস’ সম্পর্কে ঢাকায় কেউ তেমন কিছু জানতেন না। সুযোগটি এলো ১৯৭৬ সালে। ম্যাট্রিক পাস করে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘এই মুখরিত জীবনে চলার বাঁকে’, ‘ভুলে গেছ তুমি’—এসব গান তখনই আমার সুর করা। সে বছর ঢাকায় ‘অল বাংলাদেশ পপ মিউজিক কম্পিটিশন’ নামে পুরো দেশের পপ মিউজিকের প্রতিযোগিতা হলো। এ ধারার গানকে তখন ‘পপ মিউজিক’ বলা হতো। পিলু মমতাজ, আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীররা গাইতেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে সোলস প্রতিযোগিতায় অংশ নিল। আমাদের কেউ পাত্তাই দিচ্ছিল না। পরে আমাদের পারফরম্যান্স, মৌলিক গানে সবার তাক লেগে গেল। আমরা চ্যাম্পিয়ন হলাম। তখন তো ঢাকায় অনেক বিখ্যাত ব্যান্ড ছিল। আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদরা সুপার স্টার। তাঁদের বদলে আমরা সেরা হওয়ায় সবাই অবাক হয়ে গেলেন। আমার গাওয়া ‘মনে করো এখন অনেক রাত’, ‘বেস্ট সং’, আমি ‘বেস্ট কি বোর্ডিস্ট’, আমাদের ভোকাল তাজুল ইমাম ‘বেস্ট সিঙ্গার’ হলেন। ‘বেস্ট ব্যান্ড’সহ এত পুরস্কার পাওয়ায় প্রতিযোগিতার বিচারক সত্য সাহা, আলম খানের মতো সুরকাররা আমাদের জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘চট্টগ্রামে থেকে তোমরা এত ভালো মিউজিক করছ?’ সেই থেকে সোলসের উত্থান। ঢাকায় আমাদের প্রচার হয়ে গেল। অনেক শো করার আমন্ত্রণ এলো। আমার বন্ধু মোহাম্মদ আরিফ তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে পড়ে। সে তাদের মেডিক্যালে শোর আয়োজন করল। ঢাকার ছাত্রদের মধ্যেও আমাদের প্রচুর পরিচিতি হলো। শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক (সংগীত ও নৃত্যকলা) আমিনুল ইসলাম বুলবুল একাডেমিতে বিশাল শো করলেন। ভালো ব্যান্ড হিসেবে সোলসের নাম আরো ছড়িয়ে গেল। বিটিভিতে এক ঘণ্টার অনুষ্ঠান করলাম। সেদিনই টিভিতে প্রথম গাইলাম—‘মনে করো এখন অনেক রাত’। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে আমরা শো করতাম।‘সুপার সোলস’-এর পেছনের গল্প?শিল্পকলা, বিটিভিতে প্রগ্রামের পর শুভাকাঙ্ক্ষীরা অ্যালবাম প্রকাশ করতে বললেন। সিদ্ধান্ত নিলাম, গান রেকর্ডিং করব। বিটিভির জন্য অনেক গান রেকর্ডিং করলাম। ঢাকায় তখন অনেক সংগীত প্রযোজক। চট্টগ্রামের কুমার বিশ্বজিৎ, এম এ শোয়েবের ক্যাসেটও তাঁরা বের করেছিলেন। আমরা যোগাযোগ করলাম, কিন্তু কেউই অ্যালবাম করতে চাইলেন না। পকেটের পয়সা খরচ করে এত গান রেকর্ড করে ফেলে রেখেছি বলে আমরাও হতাশ হয়ে গেলাম। অনেক অনুরোধের পর শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের বড়ভাই, তবলাবাদক দেবুদা (দেবব্রত চৌধুরী) বললেন, ‘আমার তো কম্পানি নেই। কম্পানি খুলে তোমাদের অ্যালবাম করব। ’ ‘বৈশাখী প্রডাকশন’ নামের সে কম্পানি থেকে ঢাকায় রেকর্ডিংয়ের পর ‘সুপার সোলস’ বেরোলো। অ্যালবামটি প্রকাশের পর তাঁর ভাগ্য ফিরে গেল।অ্যালবামটির অনেক গান এখনো সুপারহিট।সুপার সোলসের ১২টি গানের মধ্যে তাজুল ভাইয়ের লেখা ও সুরে কয়েকটি গান আছে। চিত্রশিল্পী হলেও তিনি খুব ভালো গান লিখতেন, অসাধারণ গাইতেন, সুরও করতেন। ‘কান্দো ক্যানে মন’, ‘আচ্ছা পাগল মন রে’সহ কয়েকটি লোকগীতি ব্যান্ড ফরম্যাটে আছে। অ্যালবামটির প্রতিটি গানে সবার সঙ্গে আমি ও পিলু হারমোনাইজ করেছি। নিজে গেয়েছি, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’। তপনের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছি ‘ভুলে গেছ তুমি’। তার সঙ্গে হারমোনাইজ করেছি। সোলসের মাধ্যমেই বাংলাদেশে হারমোনাইজের ধারা শুরু হয়েছে। ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের সহপাঠী বন্ধু আবদুল্লাহ আল মামুন গানটি লিখেছে। তবে কুমার বিশ্বজিৎ আমাদের অ্যালবাম প্রকাশের আগেই বিটিভিতে গানটি গেয়েছে বলে তার নামেই এটি প্রচার হয়ে গেছে। সে এই এক গানেই সুপার স্টার হয়েছে। সে পিলুর বন্ধু, ক্লাসমেট ছিল। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’, আচ্ছা পাগল মন রে’, ‘নদী এসে পথ’, ‘ভুলে গেছ তুমি’সহ অ্যালবামের অনেক গান এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। ‘সুপার সোলস’ বলতে গেলে আমার হাতেই তৈরি। ৩০-৪০ বছর আগের এ গানগুলো মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে—এটাই অ্যালবামটির সুরকার হিসেবে আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার। তবে গানগুলোতে সবারই অবদান আছে। একেকটি গান আমরা নানাভাবে কম্পোজ করে দেখতাম। সবাই পরামর্শ দিত। টিমওয়ার্কই যেকোনো অ্যালবাম হিট করার মূল রহস্য।আপনার কয়্যার গ্রুপও তো ছিল?তখন ‘কলকাতা ইয়ুথ কয়্যার’-এর গান শুনে খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। এ ছাড়া আমার কয়েকজন প্রিয় মার্কিন জ্যাজ, ব্লুজ গায়ক এ ধরনের গান করেন। ফলে নিজের ভাবনা থেকেই ‘সৈকতচারী’ নামের দলটি গড়ে ‘ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে’সহ কয়েকটি জনপ্রিয় লোকগীতি, ‘ঝর পরের দে লো ছা, চান মুখে মধুর হাসি’সহ চট্টগ্রামের কয়েকটি আঞ্চলিক গান কয়্যার করে গেয়েছিলাম। বাদ্যযন্ত্র ছাড়া হারমোনাইজ, হামিং করে আমরা ১০-১২টি ছেলে ও ১০-১২টি মেয়ে মিলে গাইতাম। ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’, ‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’র হারমোনাইজিং, হামিংগুলো তখনই করেছি। সৈকতচারীতে আমরা এভাবে গানগুলো অনুশীলন করতাম। পরবর্তীকালে সোলসের অনেক বিখ্যাত গানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এভাবে করা হয়েছিল। আমার গানজীবনের উৎকর্ষ, গান নিয়ে গবেষণার নেপথ্যে সৈতকচারীই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। তবে ছেলেরা চাকরির জন্য ঢাকায় চলে গেল, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেল বলে কয়্যার গ্রুপটি বেশি দিন টেকেনি। এটি এমন একটি দল, যেখানে কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই, একসঙ্গে অনেক অনুশীলন না করলে তো দল রেখে লাভ নেই। ১৯৭৮ কি ৭৯ সালে কিংবদন্তি সেতারবাদক ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খানের ছেলে ওস্তাদ কিরীট খান আমাদের গান শুনে কলকাতায় আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গেলেন। সৈকতচারী কলকাতায় শো করল। তখন ভালো গাই শুনে সুচিত্রা সেন আমাদের গান শোনার জন্য তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁর বাড়িতে শো করতে হয়েছে। তিনি আমাদের সামনে আসেননি, ছবি তুলতেও দেননি। কাউকে জানাতেও বারণ করেছিলেন। তাঁর সামনে ‘মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’, ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘ও কি ও বন্ধু কাজল ভোমরা রে’সহ চট্টগ্রামের কয়েকটি আঞ্চলিক গান হারমোনাইজ করে গেয়েছি। তিনি আমাদের গান পছন্দ করেছেন। তাঁর সম্মানে আমরা সম্মানী নিইনি। তাঁর সম্মানে সে কথা এত দিন কাউকে বলিওনি। আলী ইমামের প্রযোজনায় সৈকতচারী বিটিভিতেও প্রগ্রাম করেছে।গায়ক কিভাবে হলেন?সে জন্য তপনকে ধন্যবাদ দিতে হয়। গাইলেও সোলসে আমি মূল গায়ক ছিলাম না, তপনই ছিল। ফলে বেশির ভাগ গানই তাকে গাইতে দেওয়া হতো। আমারও গায়ক হওয়ার কোনো শখ ছিল না। কি-বোর্ড বাজাতাম, গানে সুর করতাম। উপভোগও করতাম। ১৯৮০ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে সোলসের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শোর আগে হঠাৎ সে খুব অসুস্থ হয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে আসতে পারল না। ফলে তার ও আমার গানগুলোসহ পুরো শোতে গাইতে হলো। দর্শক সেগুলো পছন্দ করার পর মনে হলো বোধ হয় গাইতে পারব।
‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’র জন্ম কিভাবে?আমি আর জিলু ভাই গান নিয়ে বসেছি। দুজনই গুনগুন করছি। সেদিনই তিনি হারমোনিয়ামে ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’র মূল টিউনটি করলেন। তখনো গানটি লেখা হয়নি। আমার সেটি বেশ পছন্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে লেখা শুরু করলাম। যদিও সাধারণত গান লিখি না, তার পরও কিভাবে গানটি ভেতর থেকে বেরোতে লাগল জানি না। ওই মুহূর্তে না লিখলে তো গানটি হারিয়ে যাবে বলে লিখে রেখেছিলাম। তিনি মুখটি করলেন, লিখলাম। প্রথম অন্তরায় কিছুটা সুর দিলাম, তিনিও দিলেন। এভাবে লেখা হলো। সৈকতচারীতে কয়্যার করে গাইলাম। অনেকে পছন্দ করলেন। সোলসে আমরা নতুন করে কম্পোজ করলাম। সোলসের সেই কম্পোজিশন তখনকার যুগের খুব আধুনিক কম্পোজিশন ছিল। যে রিদম ব্যবহার করেছি, সেটি এখনো অনন্য। কোন কর্ডের পর কোনটি হবে—সেটিও আমার তৈরি। অনুশীলনের পর সোলস সেটি স্টেজে গাওয়া শুরু করল।আইয়ুব বাচ্চুকে কিভাবে খুঁজে পেয়েছিলেন?লিড গিটারিস্ট সাজেদ বিদেশে চলে যাওয়ায় আমরা খুব বিপদে পড়লাম। চট্টগ্রাম শহরে কে ভালো লিড গিটার বাজায় খুঁজতে লাগলাম। তখনই আইয়ুব বাচ্চু আমার নজরে এলো। সে অন্য ব্যান্ডে বাজাচ্ছিল। দেখলাম, ১৭-১৮ বছরের এই ছেলেটি বেশ ভালো বাজায়। চট্টগ্রামের প্রধান ব্যান্ড সোলস তখন তো সুপারহিট। সে-ও আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাইছিল। বললাম, ‘বাসায় আসো, একসঙ্গে জ্যামিং করি। ’ এলো। তার গিটার বাজানো দেখেই পছন্দ হলো। বলে দিলাম, ‘তুমি আমাদের সঙ্গে বাজাবে। ’ এর পর থেকে সে সোলসে লিড গিটারিস্ট হিসেবে বাজানো শুরু করল। এ দেশে বাচ্চুর মতো ভালো গিটারিস্ট খুব কম আছে। অত্যন্ত মেধাবী এই ছেলেটি গায়ক হিসেবেও খুব জনপ্রিয়। তপন গাইলেও সুপার সোলসের ‘নদী এসে পথ সাগরে মিশিয়ে দিতে চায়’ আমার অন্যতম প্রিয় গান। এই গানে একটি লিড পিস আছে। তাতে বাচ্চু এত সুন্দর গিটার বাজিয়েছে যে সেটি তার সিগনেচার টিউন হিসেবে থেকে গেছে। সে সান্তানার গিটার বাদন খুব পছন্দ করে। তিনি তাঁকে খুব প্রভাবিত করেছেন। এই গানটিতে সে তাঁর প্রভাবে একটি পিস বাজিয়েছে। পিসটির জন্যই গানটি জনপ্রিয় হয়ে গেছে। ১৯৮৩ সালে আমি সোলস ছেড়ে দেওয়ার পরও সে ছিল। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৮৪ সালে তাকেও তো ঢাকায় চলে আসতে হলো। ইংরেজি গায়কের প্রয়োজন ছিল বলে ১৯৮০ সালে সোলসে নাসিম আলী খান যোগ দিল। দেখলাম, ছেলেটি ভালোই গায়। পিলুর বন্ধু, একই ক্লাসে পড়ে, ব্যান্ডে একসঙ্গে বাজায়। যখন সোলসে ছিলাম, আমাদের সমস্যা হয়নি। রেনেসাঁয়ও তাই। ব্যান্ড দুটি টিম ওয়ার্ক, গণতন্ত্র ও সবার সমান অবদানের কারণে এখনো টিকে আছে।ঢাকায় এলেন কেন?১৯৮২ সালে হঠাৎ আব্বা মারা গেলেন। বড় ভাই তখন ঢাকায় থাকেন। তিনি আমাকে ও পিলুকে লেখাপড়া করাবেন বলে ১৯৮৩ সালে ঢাকায় নিয়ে এলেন। পরের দুটি বছর কোনো ব্যান্ডে ছিলাম না। কিন্তু ‘হ্যাপি আখন্দ’সহ আরো কিছু মিউজিশিয়ানের সঙ্গে আড্ডা দিতাম। হ্যাপির মতো মেধাবী মিউজিশিয়ান খুব কমই দেখেছি। সে অসাধারণ কি-বোর্ড, পিয়ানো বাজাত, অসাধারণ হারমোনাইজ করত। তার মতো এত সুন্দর অ্যাকুইস্টিক রিদম গিটার বাজাতে এখনো কাউকে দেখি না। লাকী আখন্দ ভাইয়েরও খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম। খুব আদর করতেন। তখন আমি, পিলু, রেনেসাঁর বেজ গিটারিস্ট মোটো, মামুন ‘উইন্ডি সাইড অব কেয়ার’ ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট ফজলে ভাইয়ের মহাখালীর ডিওএইচএসের বাসায় অনুশীলন করতাম। সে বাসায় ব্যান্ডটির বাদ্যযন্ত্রগুলো ছিল। মোটো, মামুন ও তিনি সেই ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন।রেনেসাঁর জন্ম?১৯৮৫ সালে ফয়সাল সিদ্দিকী বগি বিদেশ থেকে ফিরলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর সাবেক এই অধ্যাপক আগে ‘অ্যাবনরম্যাল থ্রি প্লাস টু’ ব্যান্ডে ছিলেন। আমি, পিলু, মোটো, মামুন ও বগি ভাই আলাপ করলাম—আমরা তো একসঙ্গে বাজাচ্ছি, ব্যান্ড করি না কেন? তখনো ব্যান্ডের কোনো নাম ছিল না। সোনারগাঁও হোটেলে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের বার্ষিক সভায় প্রথম শোটি নাম ছাড়াই হলো। দর্শকদের নাম দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলে তাঁরা অনেক নাম দিলেন। কিন্তু কোনোটিই পছন্দ হলো না। বিটিভির ‘ঝলক’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে গাওয়ার আমন্ত্রণ এলো। টিভি প্রগ্রাম করতে হলে তো নাম দিতে হবে, তাই সবাই মিলে নাম দিলাম ‘রেনেসাঁ’। বাংলায়ও ব্যবহৃত এই ফরাসি শব্দের অর্থ—‘নবজাগরণ’। এ দেশে তখন ব্যান্ড মিউজিকের ধারাটি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছিল। হেভি মেটাল ও রক বেশি হচ্ছিল। হয়তো বাংলা গানের সঙ্গে সেগুলো মিলছিল না, বাংলা গান বাংলা গানের মতো হচ্ছিল না। বাংলা গানের দুটি মূল উপজীব্য—লিরিক্যাল ভ্যালু ও মেলোডি। আমরা আমাদের ব্যান্ডে এগুলোর প্রাধান্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাংলা গানকে ব্যান্ডের গান হিসেবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এ দুটির কোনো বিকল্প নেই বলে আমাদের মনে হয়েছে। এগুলো বাদ দিয়ে কোনো বাংলা গানই স্থায়ী হবে না—এটি আমাদের বিশ্বাস। এখনো আমরা গানের কথা ও মেলোডি বাদ দিয়ে কোনো গান গাইনি। গানের মাধ্যমে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা পূরণের কিছু মেসেজ দেওয়ার জন্য চেষ্টা করব বলেও আমরা ‘রেনেসাঁ’ নামটি পছন্দ করেছিলাম।প্রথম অ্যালবাম?‘রেনেসাঁ’ নামেই ১৯৮৮ সালে এটি রিলিজ হলো। প্রথম গানটি হলো—‘ভালো লাগে জোছনা রাতে। ’ গীতিকার চট্টগ্রামেরই বন্ধু ডাক্তার মোহাম্মদ আরিফ। এই অ্যালবামের সুপারহিট গান ‘ও নদী রে, তুই যাস কোথায় রে’, ‘আচ্ছা কেন মানুষগুলো’সহ সে আমাদের অনেক গান লিখেছে। তখন সে ঢাকা মেডিক্যালে পড়ে। একদিন ট্রেনে আমরা ঢাকা আসছি। রাত নেমে গেল। জোছনার আলো পড়ছে, কিছু মেঘ চাঁদের গায়ে পড়ছে আবার সরে যাচ্ছে। খাতা-কলম নিয়ে সে লিখল—‘ভালো লাগে জোছনা রাতে, মেঘ হয়ে আকাশে ভাসতে, ধানের শিষে বাতাস হয়ে কিষানির মন ছুঁয়ে যেতে। ’ বলল, ‘দোস্ত, দেখ তো সুর করতে পারিস কি না?’ গানের কথাগুলো এত ভালো লাগল যে গুনগুন করে সুর বসাতে লাগলাম। ঢাকায় পৌঁছার আগে তার গান লেখা, আমিও সুর করে ফেলেছি। বব মার্লে আমার খুব প্রিয়। তাঁর র্যাগি বিট এই গানে ব্যবহার করেছি। ‘আচ্ছা, কেন মানুষগুলো এমন হয়ে যায়’ অ্যালবামটির প্রথম রেকর্ড করা গান। এখন ‘ফিউশন’ কথাটি অনেক বেশি শোনা যায়, কিন্তু তখনই এই গানে আমি ওয়েস্টার্ন কম্পোজিশনের সঙ্গে ঢোল ও দোতারা ব্যবহার করে সত্যিকার অর্থে ফিউশন করেছি। অ্যালবামের আরেকটি হিট গান ‘রানওয়ের মাটি ছুঁয়ে’ খালিদ আহসান লিখেছেন, আমার সুরে মামুন গেয়েছে। ‘ঘুম নেই, ঘুম হারা’ও আমার খুব প্রিয় গান। এই অ্যালবামে চারটি মৌলিক ইংরেজি গান আছে। দুটি বগি ভাই সুর করে গেয়েছেন। ওমর খালেদ রুমী তখন আমাদের ব্যান্ডে ছিলেন। তাঁর দুটি মৌলিক গান আছে—‘টেম্পরারি লাভ’ ও ‘নো ওয়ান বাট ইউ’। ‘ভালো লাগে জোছনা রাতে’, ‘ও নদী রে’ আমি গেয়েছি, ‘আচ্ছা কেন মানুষগুলো’ পিলু। অ্যালবামের গানগুলো কনসার্টে গাইবার সময় দর্শকের উচ্ছ্বাস দেখে মনটা ভরে যায়। সারগাম থেকে প্রকাশিত এই অ্যালবামের প্রতিটি গানেই মেলোডি আছে। সেই থেকে এখনো রেনেসাঁর সব গানে সে ধারাটি আমরা ধরে রেখেছি। তবে প্রথম দিকে খুব ভয় পেতাম, স্রোতের বিপরীতে গিয়ে মেলোডিনির্ভর গান করছি, শুনবে তো? পছন্দ করবে? ‘রেনেসাঁ’ প্রকাশের পর পুরোপুরি সার্থক হলাম। আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ থেকে শুরু করে সমসাময়িক ব্যান্ডস্টাররাও আমাদের গানগুলো খুব পছন্দ করেছেন।এরপর তো ‘তৃতীয় বিশ্ব’?আমরা বলি, রেনেসাঁ সব সময় বক্তব্যপ্রধান গান করে। তৃতীয় বিশ্ব, তার চরিত্র ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ‘তৃতীয় বিশ্ব’ সাজানো হয়েছে। টাইটেল গান—‘তৃতীয় বিশ্ব’। এটি শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা, সুর করে পিলু গেয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় গান হলো ‘হৃদয় কাদামাটির কোনো মূর্তি নয়। ’ এটিও জঙ্গী ভাইয়ের লেখা, আমার সুর, বগি ভাই গেয়েছেন। এ আমার অন্যতম প্রিয় সৃষ্টি। গানটিতে ক্যারিবিয়ান ও আফ্রিকান রিদমের সঙ্গে আমাদের দেশীয় ব্যান্ডপার্টির ট্রাম্পেট ও খঞ্জনির বাদন মিশিয়েছি। লোকগীতির মতো হলেও এই গানের কথাগুলো খুবই আধুনিক। শ্রদ্ধেয় নিলুফার ইয়াসমিন একে পূর্ণতা দিয়েছেন। বিটিভির ‘জলসা’ অনুষ্ঠানে তিনি আমাদের সঙ্গে এটি গেয়েছেন। সেদিন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা আপা আগের অ্যালবামের ‘এই মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’ গেয়েছেন। অ্যালবামের ‘আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই’ শিশুদের অধিকারের গান। যেসব শিশু জন্ম নেয়, তাদের সবারই বাঁচার মতো বাঁচার অধিকার আছে—এ কথাই আমরা বলতে চেয়েছি। এটিও জঙ্গী ভাইয়ের লেখা, পিলুর সুর ও গাওয়া। ‘চিরদিনই ভাবতে পারো’ নির্জলা প্রেমের গান। আসিফ ইকবালের লেখা এই গানটির মাধ্যমে আমরা বলতে চেয়েছি—নির্জলা প্রেমের গানও দেশাত্মবোধক হতে পারে। বেজ গিটারিস্ট মোটো মোটামুটি গান করে, সে এখানে গেয়েছে ‘চৌকিদার’। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলন নিয়েও গান আছে—‘জানালা খুলে দেখি ওপাড়ার ঝাঁকড়া চুলের সেই শান্ত যুবক মিছিলের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে’। সেজান মাহমুদের লেখা গানটি এরশাদ পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল কনসার্টে প্রথম গেয়েছিলাম। ব্যান্ড দলগত, সলো গায়কদের মতো একার নয়। ব্যান্ড সমাজকে কিছু বক্তব্য দিতে পারে, সমাজে ভূমিকা রাখতে পারে। সেটিই বিশ্বাস করি বলে আমাদের সব অ্যালবামের সব গানে সামাজিক দায়বোধ ও দেশের কথা থাকে। ১৯৯৩ সালে ‘মিউজিক এশিয়া’ ‘তৃতীয় বিশ্ব’ প্রকাশ করেছিল। পরে সঙ্গীতা আবার প্রকাশ করেছে।‘একাত্তরের রেনেসাঁ’ কিভাবে তৈরি হলো?এই অ্যালবাম ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হলেও শুরুটি অনেক আগে হয়েছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলোকে ব্যান্ড ফরম্যাটে এনে ১৯৯৫ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে কনসার্ট করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি আক্কু চৌধুরী গানগুলো শুনে আমাদের অনুপ্রেরণা জোগালেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্য ট্রাস্টিরা ও মুনতাসীর মামুন বললেন, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাচ্ছে। তোমরাই একমাত্র ব্যান্ড, যারা এই গানগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দিতে পারো। ’ সে উৎসাহে কথা ও সুর অবিকল রেখে আমরা গানগুলোর কম্পোজিশন ব্যান্ড ফরম্যাটে নিয়ে এলাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত পরিচালক সমর দাস আমাদের খুব সহযোগিতা করেছেন। গান কম্পোজের পর আমরা তাঁকে নিয়ে যেতাম। তিনি ‘ওকে’ করার পর গান ফাইনাল করেছি। তিনি আমাদের কাজে খুব সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তিনি এবং মুক্তিযোদ্ধা, পপগুরু আজম খান অ্যালবামের মোড়ক উন্মোচন করেছিলেন। ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘শোনো একটি মজিবরের থেকে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’, ‘বাঁধ ভেঙেছে বাঁধ ভেঙেছে’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান, আমরা সবাই বাঙালি’, ‘ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছে পথে’, ‘হাজার বছর পরে’ ছাড়াও বিদেশি বন্ধু জর্জ হ্যারিসনের ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ ও জোয়ান বায়েজের ‘স্টোরি অব বাংলাদেশ’ তাঁদের শ্রদ্ধা জানিয়ে ইংরেজিতে গেয়েছি। বব মার্লের র্যাগি বিটে ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ করার পর মূল সুরকার সমরদা শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘অসম্ভব ভালো কাজ করেছ। ’ নজরুলগীতি ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ ওয়েস্টার্ন ফরম্যাটে করেছি। ‘শোনো একটি মজিবরের’ এত সুন্দর যে অবিকল গেয়েছি। অ্যালবামটি জি-সিরিজ প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গানগুলোর আদি লিরিকস, আদি সুর সংগ্রহে সাহায্য করেছে। অ্যালবামে আবদুল জব্বারের ‘হাজার বছর পরে, আবার এসেছি ফিরে, বাংলার বুকে আছি দাঁড়িয়ে’ গানটি আমি গেয়েছি।‘একুশ শতকের রেনেসাঁ’?এটি আমাদের মৌলিক অ্যালবাম। বিশ্ব তখন নতুন শতকে প্রবেশ করছে। কয়েকজন বিদেশি যন্ত্রসংগীতশিল্পী আমাদের ব্যান্ডে সাক্সোফোন ও ট্রাম্পেট বাজাতেন। তাঁরাও এখানে কাজ করেছেন। বাংলা গানে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তাঁরা খুব খুশি হয়েছেন। নিজেরাই স্টাফ নোটেশন লিখে যে সুর বাজাতে হবে, তা আমাদের সঙ্গে অনুশীলন করেছেন। বিশ্বের অন্যতম সেরা সাক্সোফোন বাদক ট্রাভিস জেনকিনস বাংলাদেশে পড়েছিলেন, কেউ জানতেনও না। তিনি মারা গেছেন। তিনি এখানে সাক্সোফোন বাজিয়েছেন। ‘তুমি কী আজ বন্ধু যাবে আমারই সাথে’ অ্যালবামটির বিখ্যাত গান। বাংলাদেশ নিয়ে অন্য অ্যালবামের মতো এখানেও গান আছে—‘হে বাংলাদেশ, তোমার বয়স হলো কতো?’ গানটিতে আমি প্রাচ্যের সুরে ওয়েস্টার্ন রিদমের ব্যবহার করেছি। ফ্লুট ও হারমোনিকার সুর আছে। সব অ্যালবামের মতো এতেও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান আছে—‘ননাইয়া ননাইয়া কতা কই। ’ এই গানে ব্লু্লজ কম্পোজিশনের মাধ্যমে আঞ্চলিক গানকে বৈশ্বিক কম্পোজিশনে নিয়ে এসেছি। এ দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য তুলে ধরতে দিনাজপুর থেকে সাঁওতালদের আমন্ত্রণ জানিয়ে এনে তাদের দিয়ে তাদের ভাষায় দুটি গান করিয়েছি। এটি আমাদের চারটি অ্যালবামের মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধ অ্যালবাম।রেনেসাঁর গানগুলো আলাদা কেন হয়?আমরা প্রতিটি গানে খুব সাধারণ ভাষা বেছে নিই, সিম্পল মিউজিক কম্পোজিশনের চেষ্টা করি। আমি নিজে কোনো গানে সুর করার আগে বেশ কয়েকবার পড়ি। হৃদয়ঙ্গমের চেষ্টা করি গানটিতে গীতিকার কী লিখেছেন, মানুষকে কী বলতে চেয়েছেন। সেটি না বুঝলে তো এখানে আমার সুর পূর্ণাঙ্গ হবে না। কথার সঙ্গে সুরের মেলবন্ধন না হলে গান কখনো ভালো হবে না, হিটও করবে না।সুরকার হিসেবে অনেক কাজ করেছেন।বিশ্বজিতের প্রথম গান ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে’ আমারই সুর করা। এটিও ওয়েস্টার্ন কম্পোজিশন। এই একটি গানের মাধ্যমে সে সুপারহিট হয়েছে। তার প্রথম অ্যালবামের সুরকারও আমি। তার ‘সুখ ছাড়া দুখ’সহ আরো অনেক হিট গান আমার সুরে গাওয়া। সামিনা চৌধুরীর প্রথম অ্যালবাম আমার করা। অ্যালবামের ‘ওই ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায়’ অনেকেই শুনেছেন, সুপারহিট হয়েছিল। ফাহমিদা নবীর প্রথম অ্যালবামও আমার সুরে করা। শেখ ইশতিয়াকের কিছু কাজ করেছি। তপনের অনেক গানে সুর করেছি। তার ‘মন পবনের নাও’, ‘মন শুধু মন ছুঁয়েছে’, ‘কান্দ কেন মন’ বিখ্যাত হয়েছে। তার সলো অ্যালবামেও সুর করেছি। ক্লোজআপ ওয়ানের থিম সংটিও আমার সুর করা।কেন মিউজিককে পেশা হিসেবে নিলেন না?রেনেসাঁর আমরা কেউই মিউজিককে পেশা হিসেবে নিইনি। নিজের কথা বলতে পারি—বাবা মারা যাওয়ার পর ঢাকায় এসে ছবিতে, কনসার্টে বাজাতাম। সাবিনা ইয়াসমিন আপার সঙ্গে স্টেজে কি-বোর্ড বাদক হিসেবেও বাজাতাম। তখন মিউজিশিয়ান হিসেবে যে টাকা পেতাম, তা দিয়ে চলতাম, লেখাপড়া করতাম। একসময় মিউজিককে প্রফেশন হিসেবে নেওয়ার চিন্তাও করেছিলাম। কিন্তু ফিল্মে যখন বাজাতে গেলাম, তখন এই জগৎ, এর পরিবেশ আমার ভালো লাগেনি। আমার মিউজিক্যাল ভাবনার সঙ্গেও এটি যাচ্ছিল না। এরপর চাকরিতে যোগ দিলাম। তবে গানেই ডুবে থাকি। আমাদের দেশে ‘ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইট’ আইন আছে; কিন্তু এর প্রয়োগ নেই। ফলে আমার যতগুলো জনপ্রিয় গান আছে, তার একটিরও যদি রয়্যালিটি পেতাম, আমাকে হয়তো তাহলে চাকরি করে খেতে হতো না।(৬ অক্টোবর, ২০১৭ ধানমণ্ডি ২৭, ঢাকা)
সুত্র; কালের কণ্ঠ
Make sure you enter the(*)required information