কেউ যদি টিলায় বসে হিমালয়ের পরিমাপ করতে চায় অথবা পুকুরের পাড়ে বসে সমুদ্রের বিশালতা উপলব্ধি করতে চায়, তাহলে তাকে অর্বাচীন বললে কম বলা হয়। ঠিক আমার পক্ষে নৃত্যাচার্য বুলবুল চৌধুরী সম্পর্কে কিছু লেখা মহা অর্বাচীনতা বলেই আমি মনে করি।তবু বুলবুল নৃত্যানুসারী এক নৃত্যশিল্পী হিসেবে আমাদের ঈশ্বর স্তুতি কোনো অপরাধ নয় বলে আমি মনে করি।প্রথম বাঙালি মুসলিম নৃত্যশিল্পী, যিনি জগতের মাঝে সৃজনশীল বা সমকালীন বাঙালি নৃত্যশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। উদয় শঙ্করের পর সম্ভবত তিনিই আমাদের নৃত্য জগৎসভায় এক উজ্জ্বল রত্ন। বাঙালি হিসেবে এ কথা ভাবতেও আমরা গর্ববোধ করি। বাঙালিদের সম্মান বিশ্বের দরবারে যে কয়জন শিল্পী বাড়িয়েছেন, তাদের মধ্যে বুলবুল চৌধুরী অন্যতম। তার প্রতিভা বিপুল এবং এ বিপুলত্ব ক্ষুদ্র পরিসরে বিস্তৃত করা সম্ভব নয়। শুধু কয়েকটি ঘটনা ছুঁয়ে যেতে পারি মাত্র। রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় নৃত্যের আঙিনায় যে মুক্তধারার স্রোত এনেছিলেন, সে ধারায় জোয়ার এনেছিলেন বুলবুল চৌধুরী। আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১ জানুয়ারি ১৯১৯ সালে বগুড়ায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে দেবশিশুর শোভা আর সৌন্দর্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন বুলবুল চৌধুরী। পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রামের চুনতি গ্রামে। পিতা মোহম্মদ আজমউল্লাহ চৌধুরী, মাতা মাহফুজা খাতুন। টুনু ছিল তার আদরের ডাকনাম। বাবার এক বন্ধু পূর্ণেন্দু গোস্বামী তাকে দেখে বলেছিলেন, ‘টুনুর কপালে কলালক্ষ্মী যেন জয়তিলক এঁকে দিয়েছে। এ ছেলে একদিন যশস্বী হবে।’ তার বাণী উপলব্ধি করেছে বিশ্ববাসী। তিন ভাই, চার বোন। এক বোন আর এক ভাই অকালে মারা যায়। বুলবুল চৌধুরী বড়। দ্বিতীয় রত্তশন আখতার বেগম, তৃতীয় সুলতানা রহমান, চতুর্থ রফিক আহমদ চৌধুরী, পঞ্চম মুশতাক আহমদ চৌধুরী (পেয়ারা), ষষ্ঠ লিলি, সপ্তম রাবেয়া বেগম। সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবার। পরিবারের সবাই শিক্ষিত ছিলেন। চঞ্চল বুলবুল ছোট বয়সে নানা খেলায় মেতে থাকত রেলরেল, ঘুড়ি ওড়ানো, লাট্ট প্রভৃতি। বাদ্যযন্ত্রের দিকে অসম্ভব একটা টান ছিল। জাইলোফোন, মাউথ অর্গান, পিয়ানো এমনকি একটা কলের গানও বাবাকে দিয়ে কিনিয়েছিলেন। বোনদের পুতুলের বিয়েতে সবাই মিলে বিভিন্ন বাজনা বাজাত, কেউ বেসুরে বাজালে রেগে যেতেন। ছোট থেকেই মনে কোনো ঘৃণা বোধ ছিল না। আসানসোলের বাসায় বাড়িতে কাজ করত একজন মেথর, তার সন্তানের কান্না দেখে তাকে কোলে তুলে আদর করতে থাকেন। ছোট বোন সুলতানা রহমানের সঙ্গে খুব ভাব ছিল। অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল ছোট থেকেই। গ্রামে একবার দুর্গা প্রতিমা (সুলতানা রহমান আমায় বলেছিলেন) মহল্লার ছেলেরা নষ্ট করায় বুলবুলদা ভয়ানক রেগে যান। বারণ করা সত্ত্বেও নষ্ট করা থেকে বিরত করতে পারেননি। দুচোখ ভরা জল নিয়ে ছোট বোনের হাত ধরে বাড়ি ফিরে আসেন। দেশের বাড়ির পরিবেশ, প্রাকৃতিক ও সামাজিক জীবন বুলবুলকে বড় হতে সাহায্য করে। বাস্তুহারাদের স্বদেশে ফেরার দুঃখময় জীবন নিয়ে লিখে ফেলেন ‘প্রাচী’ নামে অসাধারণ এক উপন্যাস। ছবি আঁকার শখ ছিল ছোট থেকেই। পাখি, ফুল, পাহাড়, নদী, ঘরবাড়ি বিক্ষিপ্তভাবে আঁকতেন। মানিকগঞ্জে আসার পর ছবির হাত বেশ পেকে ওঠে। এক চিত্রপ্রদর্শনীতে প্রথম হয় টুনুর আঁকা ছবি। বেশকিছু ছবির পাশে লিখে রাখতেন ‘দ্য গ্রেটেস্টবয় আর্টিস্ট অব দ্য ইস্ট’। চোখে ছিল বড় হওয়ার স্বপ্ন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব ছিল তার ওপর, তাই তো তার কবিতার বই শেফালিকা উৎসর্গ করেন কবিগুরুকে। লেখেন, ‘হে বিশ্বকবি, হে কবিগুরু তোমার চরণ পরে আমার দরদ দিয়ে লেখা কবিতার সংকলন শেফালিকাকে সমর্পণ করে ধন্য হলুম... তোমার অজয় কুমার’ কবিতার বই-এ এই নামটি ব্যবহার করেন। বুলবুল চৌধুরীর মধ্যে কবি নজরুল ইসলামেরও (লন্ডনে কবিকে দেখেছিলেন) প্রভাব ছিল অনেকখানি, শখ করে তার মতো চুলও রেখেছিলেন। স্কুলজীবনেই লেখেন দুটি বই ‘শেফালিকা’ ও ‘বুলবুলি’ (কবিতার বই)।
সারা ভারতে সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্রের প্রধান জায়গা হলো কলকাতা। ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিচিত্রানুষ্ঠানে নাচের সুযোগ পান এবং ‘সূর্য’ নামে একটি নৃত্য পরিবেশন করেন। তার নাচ দেখে অতিথি হেমলতা মিত্র সুযোগ দেন সাধনা বসুর সঙ্গে নাচ করার। উৎসাহ হাজার গুণ বেড়ে যায়। প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতা কৃষ্টি কেন্দ্র বা কলকাতা কালচারাল সেন্টার। কলকাতায় এসে নৃত্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নাম নেন বুলবুল চৌধুরী। তার বোনকে বলেছিলেন, ‘নজরুলের বুলবুলকে আমার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখব বলে এ নাম গ্রহণ করি।’ ১৯৩৬ সালে আমেরিকার ‘মার্কাস কোম্পানি’ কলকাতায় কয়েক দিন নৃত্যকলা পরিবেশন করে। সেই অনুষ্ঠানে বুলবুলদা একটি নাচ করার সুযোগ পান। যা দেখে মার্কাস তাকে তার দলে নেয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস এত প্রবল ছিল যে মার্কাসকে বলেন, ‘যশ, খ্যাতি ভালোবাসি। তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি দেশ ও দেশের মানুষকে। দেশের সুপ্ত আত্মা ও মানুষের প্রাণকে জাগিয়ে তোলার মহান দায়িত্ব পালনের জন্য আমায় দেশে থাকতে হবে...।’ এই ছিলেন দেশপ্রেমী বুলবুল চৌধুরী। নাচের জন্য অনেক শারীরিক ও আর্থিক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। তবু একটার পর একটা নাচ রচনা করেছেন— আবাহন, চাঁদনী রাতে, হারেম নর্তকী, জীবন মৃত্যু, ভবঘুরের দল। প্রয়োজনে নাচ পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতেন। সে সময় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের (আইপিটিএ) কলকাতা শাখার সদস্যরা ছিলেন আশীর্বাদস্বরূপ। বুলবুলদার দলে ছিলেন অজিত সান্যাল, শম্ভু ভট্টাচার্য, গোপাল চ্যাটার্জি, বটু পাল, তিমির বরণ, খাদিম হোসেন, লক্ষ্মী, বেগম আফরোজা, চন্দ্রা সেন গুপ্ত (সাহানা), মায়া দে (ময়না), রেখা ভৌমিক (রীনা), আরতি চক্রবর্তী, ডলি ঘটক, শান্তি চ্যাটার্জি, জ্ঞান মজুমদার, গোবিন্দ ঘোষ, তড়িৎ কুমার, পিটার নিরঞ্জন ব্যানার্জি, কপিল দেব চতুর্বেদী প্রমুখ। বন্ধুর তালিকায় ছিলেন শিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, খালেদ চৌধুরী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, কাজী সব্যসাচী, স্নেহাংশু আচার্য, মাহামুদ নুরুল হুদা প্রমুখ। হাফিজের স্বপ্ন, উন্মেষ, জীবন মৃত্যু, আনারকলি, মালকোষ, ইরানের পান্থশালা, জেলে, নবান্ন (ফসল উৎস), সাপুড়ে, মন্বন্তর, চাঁদ সুলতানা, ক্ষুধিত পাষাণের নৃত্যরূপ, গাজন, বসন্ত বাহার, কৃষাণ-কৃষাণি, রূপক, হোলি, কবি হাফিজের স্বপ্ন, দি কল, সোহরাব রুস্তম, ননীচোর প্রভৃতি তার সৃষ্টি। নৃত্যশিল্পী বুলবুল যে নাচ ছাড়া আর কিছু করবেন না, তা তার শিষ্য অজিত সান্যালদের কাছেও শুনেছি। তার বাড়ির লোক গুরুজিকে বলেছিল, ‘বুলবুলকে বলুন ও কী চায়, বড় চাকরি, দেশের মন্ত্রী, যা চাইবে তা-ই পাবে, শুধু ওকে বলুন নাচ ছাড়তে।’ একই চেষ্টা করেছিলেন বোনের স্বামী হাবিব সাহেবও। ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্নেহাংশু আচার্যকে বলতেন, ‘পূর্ববঙ্গে একটা চারুকলা কেন্দ্র গঠন করব।’ অন্যদিকে রক্ষণশীল ও মুখোশধারী ধার্মিকরা তার নৃত্যচর্চায় বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। কুষ্টিয়ায় বলা হয়, ‘শরিয়তবিরোধী কাজ করতে দেব না।’ ময়মনসিংহ ত্যাগ করেন জঙ্গি সংগঠন ‘হিজবুল্লাহ’র জন্য। লাহোরে কালো পতাকা দেখানো হয়। তবু সবকিছুকে চ্যালেঞ্জ করে লড়ে যান জিহাদি বুলবুল। বেকার হোস্টেলে থাকার সময় হোস্টেলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করবেন বললে মুসলিম দলের নৃত্যানুষ্ঠানে আপত্তি তোলে অনেকেই। তবে ছাত্র সংসদের সহসভাপতি বিএম ইলিয়াসের উদ্যোগে নৃত্য পরিবেশন করেন। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এ কে ফজলুল হক, বর্ধমানের মহারাজা শরৎ বোস; সবার প্রশংসায় ধন্য হন বুলবুল। এর কিছুদিন পর প্রেসিডেন্সি কলেজ জয় করলেন কলকাতা। বুলবুল চৌধুরী শুধু বড় নৃত্যশিল্পী ছিলেন না, ছিলেন বড় অভিনেতাও। ১৯৪৪ সালে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘চোরাবালি’ নাটক পরিচালনা ও প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। আনন্দবাজার পত্রিকা লেখে, ‘পরিচালক বুলবুল চৌধুরীকে আমরা কুশলী নৃত্যশিল্পী হিসেবে জানতাম, তার অভিনয়ের কথা বলতে গেলে বলতে হয় তিনি প্রতিভাশালী অভিনেতা।’ নাট্যচক্র নাট্যগোষ্ঠীর নাটক নীলদর্পণে অভিনয় করে দর্শকের মন জয় করেন। অভিনয় করেন অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘কৃষাণ’-এ।
উদয় শঙ্করের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল অগাধ। তার বেশকিছু নৃত্যানুষ্ঠান দেখেছিলেন। তার নৃত্য, পোশাক, আবহসংগীত, আলোর প্রক্ষেপণ বুলবুলদাকে নাড়া দিয়েছিল। কৃতজ্ঞচিত্তে উদয়শঙ্করকে স্মরণ করতেন। ওরিয়েন্টাল ফাইন আর্টস অ্যাসোসিয়েশন (ওএফএ) প্রতিষ্ঠা করেন। সম্পাদক হন নিজে। বুলবুল চৌধুরীর বেশ কয়েকটি নৃত্যানুষ্ঠানে বাজান উদয়শঙ্করের যন্ত্রশিল্পী সন্তোষ গুপ্ত। তিনি বলেছিলেন অনেকের সঙ্গে বাজানোর অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ‘উদয় শঙ্করের পর বুলবুলই শ্রেষ্ঠ।’ সাধনা বসুর সঙ্গে ‘কচ ও দেবযানী’, ‘রাসলীলার’ মতো নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের ‘ডালিয়ায়’ নায়কের ভূমিকায় অভিনয় ও ‘অভিমন্যু’ নৃত্য বুলবুল চৌধুরীকে উচ্চশিখরে পৌঁছে দেয়। ১৯৩৭ সালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশন করেন সাপুড়ে, ইন্দ্রসভা, দ্য রেইন বো, ফেয়ারিজ, মদন ভস্ম, স্ট্রিট সিংগার প্রভৃতি। দেশকে বড় ভালোবাসতেন। সে সময় ভয়াবহ বন্যা হয়, তার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, দুদিন অনুষ্ঠান করে টাকা তুলে দেন বন্যার্থদের হাতে। ওই সময় করেন Death & Beauty. ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বুলবুল চৌধুরীর বাবা মোহম্মদ আজমউল্লাহ। মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহারের যক্ষ্মা নিরোধ সমিতির সাহায্যার্থে বুলবুল নৃত্যানুষ্ঠান করেন। বুলবুলের নৃত্য দেখে মুগ্ধ হন লেডি ব্রাবোর্ন, তার সঙ্গে বিশেষ সখ্য ছিল বুলবুল চৌধুরীর। অনেক বাধা পেরিয়ে ১৯৪৩ সালে বিয়ে করেন প্রতিভা মোদককে। নাম হয় আফরোজা বুলবুল। বেগম বুলবুল ছিলেন অসাধারণ একজন নৃত্যশিল্পী। ১১ বছরের বিবাহিত জীবনে দুই ছেলে (শহীদ আহমদ চৌধুরী ও ফরিদ আহমদ চৌধুরী) এক মেয়ে (নার্গিস বুলবুল চৌধুরী)। স্ত্রী আফরোজার মৃত্যু হয় ১০ মে ১৯৯০, লন্ডনে। বুলবুল চৌধুরী অবশেষে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক স্বপ্ন নিয়ে, অসম্ভব মনোবল নিয়ে, ১৮ জন শিল্পী নিয়ে ২৯ মার্চ ১৯৫৩ সালে বিলাসবহুল জলজাহাজ ভিক্টোরিয়ায় ইউরোপের উদ্দেশে রওনা দেন। লেটস উই ফরগেট, যেন আমরা ভুলে না যাই, চাঁদ সুলতানা, আনারকলি, সাপুড়ে, পান্থশালায় এক রাত্রি প্রভৃতি নৃত্য বিদেশে অকুণ্ঠ প্রশংসা পায়। বুলবুল চৌধুরী ইংল্যান্ড, লন্ডন, আয়ারল্যান্ড, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স জয় করেন। বিদেশী কাগজে লেখে বলিষ্ঠ ভঙ্গি, শক্তিশালী শিল্পকৃত, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের মিলন, বাস্তবতা, জীবন রূপায়ণ প্রভৃতি বিশেষণ। বিদেশে থাকাকালীন অসুস্থ হয়ে পড়েন। সবার অনুরোধেও হোমিওপ্যাথি ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসা করতেন না। দেশপ্রেমী বুলবুল অসুস্থ অবস্থায় দলের জন্য দেশের জন্য নৃত্য পরিবেশন করেছেন। ১৯৫৩ সালে ২৪ নভেম্বর বুলবুল চৌধুরী স্বদেশে ফিরে আসেন। বুলবুল চৌধুরী বারবার বলতেন, ‘আমি মরে গেলে এ দেশের আর কেউ কি নৃত্যকে জীবনের মতো ভালোবেসে সাধনা করবে না?’ সত্যি আমরা কি পেরেছি তার কথা রাখতে?
১৯৪৯ সালে বুলবুল চৌধুরী পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নেন এবং তাদের জাতীয় শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হন। তত্কালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান তার নাচ খুবই পছন্দ করতেন ও ভালোবাসতেন। তার মৃত্যুর পর মিসেস লিয়াকত আলিও বুলবুলদাকে সাহায্য করতেন। ১৯৫০ সালে করাচির মেট্রোপল হোটেলে দেশী-বিদেশী অতিথির সামনে অসাধারণ একটি ভাষণ দেন বুলবুল চৌধুরী। সেখানে নিজেকে একজন সামান্য বাঙালি শিল্পী হিসেবে পরিচয় দেন। সরকারিভাবে পাকিস্তানের জাতীয় শিল্পী হলেও অসাম্প্রদায়িক বুলবুল চৌধুরী মনে-প্রাণে বাঙালিকে ভালোবাসতেন। এ সবকিছু উল্লেখ করার পরেও বুলবুল চৌধুরীর মানবিক মনের কথা না বললে তার সম্পর্কে কম বলা হবে। তার চরিত্রের বিশেষ গুণ ছিল বিনয় ও নম্রতা। অত বড় মানুষ হয়েও ছোট কি বড়, শিল্পী কি সাধারণ মানুষ সবাইকে যথাযথ সম্মান দিতেন। ইউরোপ সফর শেষ করে কয়েক দিনের জন্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলেন। কারণ মায়ের সঙ্গে দেখা করা এবং পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রস্তুতি নেয়া। কিন্তু রোগ আরো চেপে বসেছে তার ওপর। ১৯৫৪ সালে ১৯ এপ্রিল কলকাতা চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি হন। অপারেশন করা হবে ঠিক হয়েও হয় না তার রক্ত প্রস্রাব আরম্ভ হওয়ার জন্য। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েন। তবু বলতেন, ‘আমি মরতে চাই না, আমার বাঁচতে ইচ্ছা করে, অনেক কাজ বাকি আছে।’ কিন্তু না...। সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে মাত্র ৩৫ বছরে জিহাদি শিল্পী লাখো মানুষের আশীর্বাদ নিয়ে বড় সরকারি পদ, মন্ত্রিত্ব, অর্থের প্রলোভন উপেক্ষা করে ১৯৫৪ সালের ১৭ মে সকাল ৬টা ১৪ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। সমাধিস্থ হন কলকাতার গোবা সমাধি ক্ষেত্রে। মৃত্যুর এক বছর পর ১৯৫৫ সালের ১৭ মে তার স্বপ্নের একাডেমি তৈরি হয় বাংলাদেশের ঢাকার ৭ নম্বর ওয়াইজঘাটে, বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস (বাফা)।
লেখক: চিকিৎসক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ।
Make sure you enter the(*)required information