হাদীস শরীফে রয়েছে “আল উলামাউ ওয়ারাসাতুল আম্বিয়া” অর্থাৎ রাসুল সঃ বলেন, ‘আলিম সমাজই হচ্ছেন নবীগণের উত্তরাধিকার’।
হাদিসের বাণী অনুসারে মাওলানা শাহ হাবীব আহমদ ছিলেন তেমন বৈশিষ্টের একজন খালিছ আলিমে দ্বীন ও অলিয়ে বরহক। সমকালীন পীর-বুজুর্গ ও শায়খ- মাশায়েখের মধ্যে ইলমে দ্বীনের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় প্রাণ পুরুষ ছিলেন তিনি। তার কথা, আলোচনা ও দিক-নির্দেশনার মধ্যেই বুঝা যেত যে তিনি একজন ছাহেবে ইলম তথা কুরআন-সুন্নাহ বিশারদ। শরীয়ত যথাযথভাবে পালন করেই তিনি ত্বরীকতের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে গেছেন। সমাজ, দেশ ও বিশ্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে তার মতো সচেতন পীর দ্বিতীয় একজন খুঁজে পাওয়া যায় না। অমায়িক ব্যবহার, নিরহংকার চালচলন ও সবার সাথে খোলামনে কথা বলা ছিল তার চারিত্রিক ভূষণ। ছীহ ত্বরীকায় আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে সমাজে সৎ মানুষ তৈরীতে তিনি পুরো জীবন নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে গেছেন। তার মাঝে ছিল ইলম ও আমলের অপূর্ব সমন্বয়। আজ ২৬ নভেম্বর ১৩ তম ওফাত বার্ষিকী।
কামিল পাশ করে পীর সাহেব যখনই কর্মজীবনে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন তখন ১৯৪৪ সালে তার পিতা মাওলানা শাহ নীজর আহমদ রহ. ইন্তেকাল করেন। পিতার ইন্তেকালে পারিবারিক শূণ্যতা সৃষ্টি হয়। ফলে মুরব্বীদের অনুরোধে তিনি পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চুনতী হাকীমিয়া আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি প্রিন্সিপাল পদে উন্নীত হন এবং প্রায় এক দশক ধরে এ গুরু দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন শেষে অবসর গ্রহণ করে ত্বরীকতের মাধ্যমে সমাজ গঠনে মনোনিবেশ করেন। তিনি ছিলেন মুজাদ্দেদিয়া তরিকতের পীর। চুনতী গ্রামে তার জীবদ্দশায় প্রতি বৎসর হাজার হাজার ভক্ত-মুরীদের মাহফিল অনুষ্ঠিত হত। এ ত্বরীকতের মাহফিলে তিনি সবাইকে একজন খাঁটি মুসলমান হিসেবে কিভাবে চলতে হয় তা শিক্ষা দিতেন। আমলী জিন্দেগীকে উন্নত করার জন্য শরীয়ত ও ত্বরীকত দুটিরই তালিম-তরবিয়ত দান করতেন। বর্তমানে তার ছেলেদের মধ্যে একজন এ দায়িত্ব পালন করছেন। সামাজিকভাবে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি প্রায় ২৫ বছর যাবৎ চুনতী হাকিমিয়া কামিল মাদরাসা পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালনসহ আমৃত্যু উক্ত প্রতিষ্ঠান সহ চুনতী মহিলা মাদরাসা ও আধুনগর ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। জীবনের শেষ দিকে ২৫ বছর ধরে তিনি এলাকার সবচেয়ে প্রাচীনতম চুনতী জামে মসজিদের খতীবের দায়িত্ব পালন করেন।
শাহ হাবীব আহমদ হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব সফর করেন। তাছাড়া তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখেন। বার্ধক্যজনিত রোগে ২০০৬ সালের ২৬ নভেম্বর তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। চুনতী সীরাত মাঠে অনুষ্ঠিত তার নামাজে জানাযায় দূর-দুরান্ত থেকে হাজার হাজার ভক্ত-অনুরক্ত ও ছাত্র শিক্ষক যোগদান করেন। পরে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
আজকাল মুসলিম সমাজে পীর-খানকাহ যেখানে নানান ধর্মীয় অপসংস্কৃতির প্রসার ঘটাচ্ছে সেক্ষেত্রে একজন হক্কানী পীর হিসেবে মাওলানা শাহ হাবীব আহমদ ছিলেন শিরক - বিদআত সম্পর্কে খুবই সতর্ক । সমাজে সয়লাব হয়ে যাওয়া শিরক - বিদআতের মহোৎসব সম্পর্কে তিনি বলতেন “ মাওলানা নামধারী স্বার্থান্বেষী মহল সমাজে শিরক বিদআত ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাদের এ চক্রান্ত রুখে দেয়ার জন্য হক্কানী-রব্বানী আলিম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ ও ইসলামী চিন্তাবিদদের সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শাহ হাবীব আহমদ তার ভক্ত-মুরীদদের নসীহত করতেন “ শরীয়ত সব সময় মানতে হবে। ত্বরীকতকে অনিবার্যভাবে না নিলেও তাতে কোন অসুবিধা নেই। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ইসলামী আদর্শ মেনে চলে প্রকৃত কামিয়াবী হাছিল করতে হবে”।
মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনায় তিনি ছিলেন সদা সচেতন। কোথায় কোথায় মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে তা তিনি খবরাখবর রাখতেন। তার নাতী পিএইচডি গবেষক তৌফিক আল মোবারক জানান,“নানা নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা পড়তেন এবং রেডিওতে খবর শুনতেন। তার লাইব্রেরীতে ছিল বহু দুর্লভ ইসলামী বই ও বহু পত্র-পত্রিকা-ম্যাগাজিন”।
মাওলানা শাহ হাবীব আহমদ যেমনি একটি উচ্চ শিক্ষিত অভিজাত ইসলামী বংশে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তেমনি তিনি নিজেও নতুনধারায় আধুনিক ও ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতির লালনকারী একটি প্রজন্ম সৃষ্টি করে গেছেন। বস্তুতপক্ষে এখানেই তার সাফল্য। যুগপৎভাবে পরিবার গঠন ও সমাজ সংস্কারে তিনি আমাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। জনগণের মাঝে ইসলামী শরীয়ত ও ত্বরীকতের সমন্বয় সাধনে আগ্রহী করে তোলার ক্ষেত্রে তার জীবন চরিত আমাদের প্রেরণা হোক-এ প্রত্যাশা।
লেখকঃ রায়হান আজাদ
Make sure you enter the(*)required information