দক্ষিণ চট্টগ্রামের চুনতীতে পর পর শায়িত রয়েছেন আজমগড়ী হযরতের মহান তিন খলিফা। তাঁরা হলেন হযরত শাহ মাওলানা ফজলুল হক (রহ.), হযরত শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.) ও হযরত শাহ মাওলানা হাকিম মুনীর আহমদ (রহ.)। চুনতীর প্রাচীন কবর স্থান নিয়ে পাহাড়ের উপর এ মহান তিন অলি পর পরশায়িত। একই কম্পাউন্ডে আরও শায়িত রয়েছেন হযরত হাকিম শাহ মাওলানা তোফাজ্জলুর রহমান (রহ.)ও হযরত শাহ মাওলানা হাবিব আহমদ (রহ.)।
হযরত শাহ মাওলানা ফজলুল হক (রহ.): হযরত শাহ মাওলানা ফজলুল হক (রহ.) চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন ক্ষণ জন্মা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি এককালে চট্টগ্রাম থেকে আকিয়াব পর্যন্ত শরীয়ত ও তরিক্বতে রবিশাল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার চুনতী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হযরত সাইয়েদ আহমদ বেরলভী (রহ.) এর অন্যতম খলিফা হযরত আবদুল হাকিম (রহ.) (যার নামে চুনতী মাদ্রাসার নামকরণ) এর নাতি।
তিনি প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রামে সমাপ্ত করেন। অতঃপর তাঁর মামা হযরত মাওলানা খান বাহাদুর ওয়াজিউল্লাহ ছিদ্দিকী সাহেবের ভারতের উত্তরে প্রদেশস্থ কর্মস্থলে (সাব-জজ) অবস্থান করে পরবর্তী ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। মামার মৃত্যুতে চাচা মাওলানা আবদুর রশিদ ছাহেবের তত্ত্বাবধানে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা হতে ধর্মীয় উচ্চতর শিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে এসে তিনি নিজ গ্রামস্থ চুনতী “সামিয়া মাদ্রাসার”( হাকিমিয়া মাদ্রা সার সাবেক নাম) প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ কার্তিক প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে “সামিয়া মাদ্রাসা” দারুণভাবে ক্ষতি গ্রস্ত হয়ে যায়। তখন তাঁকে রেঙ্গুন চলে যেতে পরিস্থিতি বাধ্য করে। তথায় একটি উর্দু মিডিয়াম মাদ্রাসার প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। অতি অল্প কালের মধ্যে তিনি “গ্রান্ডমুফতি” হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেন।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দে আকিয়াবে হযরত মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) (আজমগড়ী হযরত-রহ.) এর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং তাঁর হাতে তরিক্বতে দাখিল হন। পরবর্তীতে তিনি খেলাফত লাভ করেন। এর আগে কলকাতা অবস্থান কালীন হযরত সূফি গোলাম সালমানী (রহ.) ও হযরত সাইয়েদ আবদুলবারী (রহ.) এর সংস্পর্শ লাভ করেছিলেন। হযরত সূফিফতেহ আলীওয়াইসী (রহ.) এর সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল এবং ইন্তেকালে কলকাতা মানিকতলায় দাফনে শরীক হয়েছিলেন।
তিনি ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে চুনতীস্থ নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন। শরীয়ত ও তরিক্বতের খেদ মতে নিজেকে আত্ননিয়োগ করেন। আজমগড়ী হযরতের মুরিদগণ ছবক তওয়াজ্জু নিতেন। তিনি ছিলেন গরীব দরদী। তাঁর দানশীলতা ও মেহমান দারী উল্লেখ করারমত। শরীয়ত বিরোধী কাজকর্ম ও কুসংস্কার তিনি এক দমপ্রশ্রয় দিতেন না। রিয়াজত, মুজাহেদা, মুরাকাবা ছিল তাঁর নিয়মিত আমল। নিজের জীবনে ১৫ হাজার বারের অধিক কুরআন খতম করেন। তিনি এক সাথে ৭ তরিক্বার খেলাফতপ্রাপ্ত। তাঁর জীবন অসংখ্য করা মতে ভরপুর। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়পাঞ্জাব, বেলুচ সহ বিভিন্ন রেজিমেন্টের সদস্যগণ তাঁর কাছে দোয়ার জন্য আসতেন।
হযরত মাওলানা ফজলুল হক (রহ.) আজমগড়ী হযরত (রহ.) এর এতদঞ্চলের প্রথম খলিফা। তিনি আজমগড়ী হযরত (রহ.) এর চেয়ে দশ বছর বড় ছিলেন। তিনি আকিয়ার ও রেঙ্গুন থেকে দেশে ফিরে এসেশরীয়ত ও ত্বরিকত্বের খেদ মতে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। হামেদিয়া সিলসিলার বিখ্যাত খলিফা হালিশহরস্থ হযরত হাফেজমুনীর উদ্দিন (রহ.) কে আজমগড়ীহযরতনির্দেশে ত্বরিকত্বেরতা’ লিমদিতে একাধিকবার হালিশহর গমন করেন।
তাঁর মহান পীর আজমগড়ী হযরত এতদাঞ্চলে তশরীফ আনলে তিনি সহায়তার ভূমিকা পালন করতেন। ছবক তওয়াজ্জুসহ নানা বিষয়ে আগত লোকজনের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহ নিজের পীরের সহায়তা করতেন। আজমগড়ী হযরত চুনতী গমন করলে নিকটতম বাড়ি ঘরেও গমন করতেন। এখানেও তিনি সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে গেছেন।
এ মহান অলি ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মে বৃহস্পতিবার নিজ গ্রামে ইন্তেকাল করেন। পর দিন শুক্রবার তাঁর জানা যায় তখন কার আমলে প্রায় ১০ হাজার লেকের সমাগম হয়েছিল। চুনতীর কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন বিশাল কবরস্থানে তিনি চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।
হযরত মাওলানা ফজলুল হক (রহ.) এর ইন্তেকালের পর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী, বাংলা মাঘ মাস ইছালেছওয়াব উপলক্ষে এক জেয়াফত তথা মেলা আয়োজন চলছিল। এ সংবাদ আজমগড়ী হযরত এর কানে যাওয়া মাত্র তিনি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন এবং ‘ ইয়ে সব্বন্ধকর’ বলে চুনতীতে সংবাদ পাঠিয়ে ছিলেন। সে থেকে এ অঞ্চলে আজমগড়ী হযরতের খলিফাগণের ইন্তেকালের পর জেয়াফত, ওরশ, মেলা ইত্যাদি করা বন্ধ হয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য, তাঁর ভাতিজা মাস্টার জাফর সাহেব বলেন তাঁরমূল নাম ফজলুল হক হলেও আজম গড়ী হযরত তাঁকে ফজলেহ কবলে ডাকতেন।
হযরত শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.): হযরত শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.) আজমগড়ী হযরত (রহ.) এর অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন খলিফা ছিলেন।
তাঁর জন্ম তারিখ বাসন তথ্য তালাশ করেও পাওয়া যায়নি। তিনি ইন্তেকাল করেছেন ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে জুলাই অথবা আগস্ট মাসে তথা বাংলা শ্রাবণ মাসে। একথা জানিয়েছেন তাঁর সুযোগ্য একমাত্র সন্তা নহযরতআলহাজ্ব মাওলানা হাবিব আহমদ। তিনি আরও জানান, তাঁর মরহুম পিতা ৫৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। এতে প্রতীয় মান হয় যে, হযরত মাওলানা নজীর আহমদ (রহ.) ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের দিকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তাঁর মায়ের কাছে এবং তাঁর নানা হযরত মাওলানা কাজী ইউসুফ ছাহেবের তত্ত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। অতঃপর চট্টগ্রাম শহরস্থ মোহসেনিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। মোহসেনিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিলপাস করার পর মায়ের একমাত্র ছেলেহওয়ায় পারিবারিক প্রতিবন্ধক তার কারণে কলকাতা বা দেওবন্দ গমন না করে চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। তার আগে তিনি কিছুদিন মোহসেনিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে ছিলেন বলে জানা যায়। তিনি সারাজীবন তরিক্বতের খেদমতের পাশাপাশি দারুল উলুম মাদ্রাসার অন্যতম আর্কষণীয় হেড মাওলানা হিসেবে জীবন কাটিয়ে দেন।
তিনি একজন উচ্চমানের পীর কামেল হয়েও চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে ওস্তাজুল আসাতুজা হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেন। শুধু তাই নয়, বৃহত্তর চট্টগ্রামে আলেম সমাজসহ সব মহলে তিনি অতি উচ্চ মানের শ্রদ্ধাভাজন আলেমে দ্বীন হিসেবে সর্বজন স্বীকৃত। প্রাথমিক জীবনে দারুল উলুম মাদ্রাসায় সামান্য বেতনে অতি সাধারণভাবে কোন মতে জীবনযাপন করতেন। কিন্তু মহান আল্লাহপাকের বিশেষ মেহের বাণীতে কবিরাজী হেকিমীফর্মুলার সংমিশ্রণে‘বরশ’ নামে এত মোদক (হালুয়া) জাতীয় ঔষধ তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এ ঔষধ বিক্রির ওসিলায় তিনি শহরে ও গ্রামে যে সেবা প্রদান করেছেন। তাঁরএ সেবার পাশাপাশি উপার্জন হতে নিদর্শন স্বরূপ চন্দনপুরাস্থ ঐতিহ্যবাহী বরশবিল্ডিং এবং চুনতীতে ১৯৩৬/৩৭ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতল পাকা ভবন নির্মাণ করেন। তিনি সহায়-সম্পদসহ ধর্মীয় ও সামাজিক কাজে বিশেষ অবদান রেখে যান। বিশেষ করে চুনতী হাকিমিয়া আলীয়ামাদ্রাসা তাঁর অমরকীর্তির স্মৃতি বহন করে চলছে।
(আগামীবারে সমাপ্ত)
সুত্র ঃ www.ahmadulislamchowdhury.info
ধন্যবাদ এডমিন প্যানেলকে।
Make sure you enter the(*)required information