মৌলানা ক্বারী আলহাজ্ব শাহ্ হাকীম মুনীর আহমদ (প্রকাশ হাকীম সাহেব), রহঃ ১৮৯৭ ইং সনের ২৬ শে মে তারিখে চুনতীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মাওলানা শাহ আলহাজ্ব ফয়েজ আহমদ এবং পিতামহের নাম মওলানা আলহাজ্ব ইউসুফ আলী। সেই পিতামহের নামানুসারে তাঁর পারিবারিক পরিচয় ইউসুফ মনযিল নামে খ্যাত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, চুনতী গ্রামটি পাক-ভারত উপমহাদেশ শিক্ষাদীক্ষা ও তাহজীব তমদ্দুন নিয়ে প্রখ্যাত ছিল। এটি চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত লোহাগাড়া উপজেলায় অবস্থিত। শিক্ষাজীবন ঃতৎকালে চুনতিতে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান বলতে ছিলনা বলা যায়। তবে সম্ভ্রান্ত পরিবারের দেউরীতে মক্তব হিসাবে শিক্ষার সুবন্দোবস্তু ছিল। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা যেখাইে লাভ করেন এবং বড় হয়ে চট্টগ্রাম শহরের স্বনামখ্যাত মোহছেনীয়া মাদ্রাসায় উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। ঐ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল ছিলেন তাঁরই পরম আত্মীয় খান বাহাদুর মওলানা মোহাম্মদ হাসান (রহঃ)। সেখান থেকে তৎকালীন উলা (বর্তমানে ফাজিল) পাশ করেন। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সে যুগে ওল্ড স্কীম (ঙষফ ঝপযবসব) মাদ্রাসা বলা হতো। উচ্চ শিক্ষা লাভের পর উপমহাদেশের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ ক্বারী মরহুম ইব্রাহীম (রহঃ) এর কাছে ক্বেরাত শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং বিখ্যাত ক্বারী হিসাবে সুনাম অর্জন করেন। এ সময়ে তিনি একটি হেকিমী প্রতিষ্ঠান থেকে ইউনানী ও তিব্বিয়া শাস্ত্রে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। বিবাহঃআনুমানিক ১৯২৫ ইং সনে পরম আত্মীয় সুপ্রসিদ্ধ শিক্ষাবিদ ও সমাজ সেবক খান বাহাদুর হাসান (রহঃ) সাহেবের একমাত্র কন্যা আনজুমন আরা বেগমের সাথে পরিনয় সূত্রে আবদ্ধ হন। এই সংসারে তাঁদের তিন ছেলে ও তিন মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। ছেলেদের নাম শেহাবুদ্দিন, মহিউদ্দিন ও গিয়াসুদ্দিন এবং মেয়েদের নাম আয়েশা, জয়তুনা এবং মাইমুনা। সবাই বিবাহিত এবং বর্তমানে ছেলে গিয়াসুদ্দিন ছাড়া অন্য কেউ বেঁচে নেই। প্রথমা স্ত্রীর ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন রামু উপজেলার অন্তর্গত মিঠাছরি গ্রামের মরহুম মওলানা আবদুল খালেকের ২য় কন্যা জাহেদা বেগমকে। বার্ধক্যজনিত জীবনের সেবা শুশ্রূষা পাওয়ার জন্য ২য় বিয়ে করলেও এ ঘরে কোন সন্তান সন্ততি হয় নাই। সে স্ত্রীও বর্তমানে প্রয়াত।কর্মজীবন ঃ কর্মজীবনের বেশীভাগ সময় তিনি বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) আফিয়াবে (রাখাইন) কাঠান। সেখানে বাপদাদার জমিদারী দেখাশুনা এবং কাজী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তৎসাথে সেখানকার শাহী জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্বও তাঁর উপর ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একজন অত্যন্ত ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। জীবনের এক পর্যায়ে তিনি পাক-ভারতের প্রখ্যাত অলিয়ে কামেল পীরে তরীকত হযরত মরহুম আলহাজ্ব মওলানা শাহ হামেদ হাছন আজমগরী (রহ) এর হাতে বায়েত গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে তাঁর খেলাফত প্রাপ্ত হন। কিন্তু তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ প্রচার বিমুখ। বুজর্গী গোপন রাখতে ছিলেন সব সময় সক্রীয়। তবু তাঁর খবর যারা জানতেন, তারা তার কাছে বায়েত গ্রহণ করতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। এভাবে তাঁর ছিল অসংখ্য মুরিদান। এবং সেই ছিলছিলা এখনো জারী আছে বলা যায়। বলাবাহুল্য এ তরীকার পীর বুজর্গগণের প্রচার প্রসার এখনো খুব কম মনে হয়। জনতার ভীড় থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে তাঁকে অবসর জীবনে বড়শী দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যেত বেশী। মাছ শিকারের সময় প্রায়ই জিকির ও দোয়া তসবিহ পাঠে মশগুল থাকতে দেখা যেত। অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত এ মহান সাধককে পরমুখাপেক্ষী হতে দেখা যায় নি কখনো। তাঁর আচার আচরণ ছিল খুবই মধুর এবং জীবন কাটাতেন সব সময় হাস্যোজ্জ্বল শালীন রসিকতার মধ্য দিয়ে।কর্মজীবনে তিনি বেশ কিছু সময় চুনতি হাকিমিয়া আলীয়া মাদ্রাসার ক্বারীর পদ অলংকৃত করেন। সে সময়ে উক্ত মাদ্রাসার শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ নাজেমে আলা আল্লামা ফজলুল্লাহ ও হেড মওলানা মোজাফ্ফর সাহেবকে তাঁর নিকট ক্বেরাত শিখতে দেখা যেত। এ রকম আরো অনেক ওস্তাদকে ছহি কোরআন পাঠ শিক্ষা নিতে দেখতাম। সেকালে চুনতির আশেপাশের বনভূমিতে বড় বড় বৃক্ষরাজি ছিল। ওসব বৃক্ষের গায়ে প্রায় খানাখন্দ (ঢোর) ইত্যাদি ছিল। সেখানে বর্ষার পানি জমে টাকি, চেগ ইত্যাদি জীয়ল মাছের সন্ধান পাওয়া যেত। প্রায় সময় ঐ সব জায়গাতে বড়শী দিয়ে মাছ ধরতে দেখা যেত তাঁকে।একজন মস্ত বড় হেকিম হিসেবেও সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি। তিব্বিয়া ও ইউনানী শাস্ত্রে ভাল দখল ছিল বলে তিনি নিজ বাড়ীতে প্রস্তুত করতেন দামী উপকারী সব ওষুধ। শেষ জীবনে মহান আল্লাহর এবাদত বন্দোগী ও নিজস্ব তৈরী ঔষধে দুঃস্থ মানুষের সেবা করে দিন অতিবাহিত করতেন। এলাকার দুরের কাছের মুরব্বি ও সাধারণ মানুষ মারা গেলে সবাই তাঁর ইমামতিতে মৃতের জানাজা পড়তে বেশী আগ্রহী ছিল। মোটকথা সবদিক দিয়ে সৎ, ধার্মিক, আল্লাওয়ালা একজন গ্রহণযোগ্য সম্মানী ব্যক্তি হিসাবে তাঁর ছিল যথেষ্ট সুনাম।জগৎ বিখ্যাত আশেকে রছুল (সঃ) হযরত আলহাজ্ব শাহ মৌলানা হাফেজ আহমদ (রহ) (প্রকাশ চুনতির শাহ ছাহেব) ছিলেন তাঁর আপন চাচাতো ভাই। শাহ ছাহেব কেবলা তাঁকে বড় ভাই এবং কামেল অলি হিসাবে অত্যন্ত ভক্তি করতেন। এমনকি সীরত মাহফিলে তাঁকে পেলে নিজের চেয়ার ছেড়ে বসতে দিতে দেখা যায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের শ্রদ্ধেয় এ মহান ওলি ১৯৮১ সনের ২৬ শে অক্টোবর পরলোক গমন করেন। চুনতিতে আজমগরী সাহেবের আরো চারজন খলিফা ছিলেন। তাঁরা হলেন হযরত শাহ মৌলানা নজির আহমদ (রহঃ), শাহ মাওলানা ফজলুল হক (রহ), শাহ মৌলানা হেকিম আফজলুর রহমান (রহঃ) ও শাহ মৌলানা জিয়াউল হক (রহঃ)। চুনতি জামে মসজিদের উত্তর পাশের সুন্দর টিলা পাহাড়ে ঐ চারজন পীরে কামেল এর পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। সাধারণ কবরের মত ঐ কবর সমূহে দেখা যায় না মাজার জাতীয় কোন স্থাপনা। তবে পরম সম্মানিত বুজর্গ হিসাবে কবর সমূহের চারিপাশে একসাথে পাকা দেওয়াল দিয়ে ঘেরা দেয়া হয়েছে, যাতে যুগ যুগ ধরে আজমগরী (রঃ) এর ছিলছিলার খলিফাগণের কবর পরিচিত করা যায়। নিবন্ধের লেখক এই অধমও তাঁর একজন চাচাত ভাই হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করে।
Make sure you enter the(*)required information