লোহাগাড়া ডেপুটি বাড়ি ঐতিহ্যমন্ডিত একটি প্রাচীন শিক্ষিত অঞ্চল। এটি চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়ার চুনতি ইউনিয়নে এর অবস্থান। এখনও শতভাগ শিক্ষায় অগ্রগতি নিয়ে এ ডিপুটি বাড়ির খ্যাতি বাংলাদেশ এবং দেশের বাহিরে। চট্টগ্রাম কক্সবাজার মহাসড়কের চুনতি নামক স্থানে এ ডিপুটি বাড়ি। বর্তমানে সীরাত মাহফিল ও চুনতির শাহ্ সাহেব (র.) এর ইতিহাস কারণেও প্রসিদ্ধি ভাল করেছে। এই জন্ম নেওয়া সু-সন্তানরা দেশ বিদেশের অনেক খ্যাতিনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপউপাচার্য এর দায়িত্ব পালন করছেন। সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষা ও প্রশাসনিক অবস্থানে রয়েছে এটি জনপদের লোকজন এর সু-উচ্চ স্থান। বিখ্যাত সাহিত্যিক ও কবি সুফিয়া কামালের শাশুরালয় এই ডিপুটি বাড়িতে। ইতিহাস পন্ডিত ড. মঈনউদ্দিন আহমদ খান, ভাষা সৈনিক ফরমান উল্লাহ খান, ভাষা সৈনিক লুৎফর রহমান খান এই ডেপুটি বাড়ির ইতিহাসকে আলোকিত করেছে দেশে। এই বাড়ির ঐতিহ্যমন্ডিত কৃর্তিমান মনিষী খান বাহাদুর নাসিরুদ্দীন। বর্তমান প্রজন্মকে শিক্ষার দিকে আলোকিত করে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে আজকে আমি খান বাহাদুর নাসিরুদ্দীন ও ডেপুটি বাড়ির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এই প্রবন্ধে উপস্থাপন করছি।আনুমানিক ১৮১৪ সালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার (তৎকালীন সাতকানিয়া) চুনতি গ্রামে সিদ্দিকী বংশে জন্মগ্রহণ করেন নাসিরুদ্দীন খাঁ। এই বংশ ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বক্কর সিদ্দিকীর বংশধারার সাথে মিশেছে। তাঁর পিতা শেখ আবদুর রহমান ছিলেন বিশুদ্ধভাবে পবিত্র কোরআন পাঠকারী বা ক্বারী সাহেব (যিনি কোরআন শরীফ শুদ্ধভাবে মুখস্ত বলতে পারেন)। পিতামহ শেখ আবদুল্লাহ ও প্রপিতামত শাহ আব্বাস। শাহ আব্বাস হজ্ব পালন শেষে প্রত্যাবর্তনকালে মৃত্যুবরণ করেন, তাঁর শিশুপুত্র শেখ আবদুল্লাহ চট্টগ্রামে চুনতি গ্রামে চলে আসেন। শেখ আবদুল্লাহ বিশুদ্ধভাবে কোরানের পাঠ করতে পারতেন বলে তাঁর সুনাম বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেন।ক্বারী আবদুর রহমানের দুই পুত্র- মওলানা আবদুল হাকিম ও নাসিরুদ্দীন খান বাহাদুর। মওলানা আবদুল হাকিম ভারতের কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেন ও শহীদে বালাকোট হযরত সৈয়দ আহমদ ব্রেরলভীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে কাজী ও পরবর্তীতে মুন্সেফ পদে যোগ দেন, পরবর্তীতে সরকারি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। তাঁর আট পুত্রের অন্যতম অজিউল্লাহ ‘খান বাহাদুর’ উপাধি লাভ করেন।নাসিরুদ্দীন সিদ্দিকী শিক্ষা গ্রহণ শেষে সরকারি ডেপুটি কালেক্টর পদে যোগ দেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে চট্টগ্রামে চারজন ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন- ‘শেখ ওবায়দুল্লা খান বাহাদুর, তৎপুত্র হামিদুল্লাহ খান বাহাদুর, সাতকানিয়ার গারাঙ্গিয়া নিবাসী আবদুল হামিদ খান বাহাদুর ও চুনতির নাসিরুদ্দীন খান বাহাদুর’।১৮৩১ থেকে ১৮৩৮ সাল পর্যন্ত মি. জন হার্ভী চট্টগ্রামের কালেক্টর ছিলেন। এসময় নাসিরুদ্দীন খাঁ জরিপ কাজে হার্ভীর সহকারী ছিলেন। মি. জন হার্ভী সাহেব নানা কারণে জনসাধারণের বিরাগভাজন হন। নাসিরুদ্দীন খাঁ তাঁকে জনরোষ থেকে রক্ষা করেন, একই সাথে অভিযুক্তদেরও তিনি অব্যাহতি প্রদানের ব্যবস্থা করেন। নাসিরুদ্দীন খাঁ সকল মহলে প্রশংসিত হন, জরীপ কাজ সুষ্টুভাবে সম্পন্ন হয়। পুরস্কার স্বরূপ তিনি ডেপুটি কালেক্টরের পদে উন্নীত হন ও তাঁকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধি দেওয়া হয়। নাসিরুদ্দীন সিদ্দিকীকে ‘মুদারুল মেহান’ উপাধিও দেয়া হয়। তবে তিনি শুধু খানবাহাদুর উপাধি ব্যবহার করতেন, নাসিরুদ্দীন সিদ্দিকী হজ্বে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন কিন্তু ছুটি না পাওয়ায় তিনি চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে পবিত্র হ্জ্ব পালন করে আসেন। সরকার তাঁকে পুনরায় চাকুরিতে নিযুক্ত করতে চাইলে তিনি দূরে কোথাও যেতে অনীহা প্রকাশ করেন, তাই সরকার তাঁকে পার্শ্ববর্তী চকরিয়া থানার দারোগা পদে নিযুক্ত করেন। নাসিরুদ্দীন সিদ্দিকী অবৈতনিক এই দারোগার চাকরি গ্রহণ করে এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।ইতিহাসে জানা যায়, ‘এ সময় ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষের সিপাহিরা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ও দিল্লীর শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে নেতৃত্বে বসায়। সে বছর ১৮ নভেম্বর তারিখে চট্টগ্রামেও বিদ্রোহ করে সিপাহিরা, কথিত আছে যে, দারোগা নাসিরুদ্দীন খান বাহাদুর ব্রিটিশ সরকারকে সে সময় সহযোগিতা প্রদান করেন। ব্রিটিশ সরকার সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে শঙ্খ ও মাতামুহুরী নদীর মধ্যবর্তী স্থানের বিস্তীর্ণ খাস জমি ইজারা প্রদান করেন। ফলে তিনি একজন ভূস্বামী হিসেবে এলাকায় যথেষ্ট প্রভাব প্রতিশালী হন। তিনি দানশীল ও পরোপকারী ব্যক্তি ছিলেন। অকাতরে দান ও সাহায্য সহযোগিতা দানের জন্য তিনি হাতেম তাই বলে অভিহিত হতে থাকেন’ চট্টগ্রামের ইতিহাস- মাহাবুবুল আলম।মাত্র ৫৩ বছর বয়সে ১৮৬৭ সালের ২৭ জুলাই নাসিরুদ্দীন সিদ্দিকী খান বাহাদুর মুত্যুবরণ করেন।নাসিরুদ্দীন সিদ্দিকী খান বাহাদুরের মৃত্যুর পর ভ্রাতুষ্পুত্র অজিউল্লাহ খাঁ ‘খান বাহাদুর’ ‘গমে আ’ম’ নামে ফার্সীতে একটি শোকগাথা রচনা করেন। ‘চাচার মৃত্যুতে ‘শোকগাঁথা’ বা মর্সিয়া’তে বারজন শায়ের’ এর রচনা রয়েছে। তাঁরা হলেন- মৌলবি অজিউল্লাহ খাঁন সানী, লালা হরগোপাল তফতাহ (দিলীর মীর্জা গালিবের সাগরেদ), মৌলবি মুহসিন সাহেব কাকুরী, মওলানা আবুদল হাকিম খাঁ (মরহুমের জ্যৈষ্ঠ ভ্রাতা), শেখ মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন, মৌলবি মুহাম্মদ এয়াকুব খাঁ, মৌলবি শাহ সাহেব আলম মারহারভী, ফজল আলী খাঁ শাহজাহানপুরী, মৌলবি হামিদুল্লাহ খান বাহাদুর, সৈয়দ সালামতুল্লাহ সালামত, সৈয়দ আল মুহাম্মদ মারহারভী, শেখ আজমত আলী। উল্লেখ্য যে, নাসিরুদ্দীন সিদ্দিকী খান বাহাদুরের ভ্রাতুষ্পুত্র অজিউল্লাহ খান বাহাদুর ভারতের উত্তর প্রদেশের মৈনপুরী প্রদেশের সদরস সুদুর’ এর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সে হিসেবে উত্তর প্রদেশের সেকালের নামীদামী কবির ‘শায়ের’ সংকলনে স্থান পেয়েছে’ চট্টল মনিষী- আহমদ মমতাজ। খান বাহাদুর নাসিরুদ্দীন খাঁ ও ডেপুটি বাড়ির উজ্জ্বল ইতিহাস বর্তমান প্রজন্মের সকলে জেনে এই ধরনের পরিবার ও দেশ গঠনে এগিয়ে আসলে দেশ ও জাতির কল্যাণ অবধারিত।
Make sure you enter the(*)required information