আমাদের দেশের যেসব জায়গায় এলিট শ্রেণির লোকেরা বসবাস করে সেসব সোসাইটিতে লক্ষ করা যায়; ভিক্ষাবৃত্তি দূর করার জন্য অনেকেই ভিক্ষুকদের নিজেদের সোসাইটিতে ঢুকতে না দেওয়ার জন্য সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দেয়৷ মাঝে মাঝে সাইনবোর্ডে দেখা যায় "ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা"! অথচ এসব অসহায় মানুষদের মধ্যে অনেকেই শারীরিক, মানসিক প্রতিবন্ধীরাও থাকে। এসব মানুষদের মধ্যে অনেকের কাজ করে জীবিকানির্বাহ করার ইচ্ছে থাকা সত্বেও তাঁদের জন্য কাজ করার মতো কোনো জায়গা নেই। যার ফলে পেটের দায়ে তাঁদেরকে ভিক্ষার থালা নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়। অথচ এসব মানুষদের কর্মসংস্থান নিয়ে যদি কেউ একটু ভাবতো তাহলে তাঁরাও সমাজে অন্য ১০ জনের মতো সমান সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারতো। তাঁদের প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে পারলেই আমাদের সমাজ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি দূর হতো। আমাদের সমাজে দেখা যায় পবিত্র মাহে রমজান আসলেই সমাজের বিত্তবানরা যাকাত দেন। যাকাত হিসেবে দেওয়া হয় শাড়ি, লুঙ্গি, রমজানে খাওয়ার জন্য কিছু খাবারদ্রব্য৷ অথচ ইসলামে এমন যাকাত নীতির কথা উল্লেখ নেই। লোক দেখানো হাজার হাজার মানুষকে শাড়ি, লুঙ্গি না দিয়ে যদি ৫ জন মানুষকেই স্বাবলম্বী করার মতো কোনো উদ্যোগ আমাদের সমাজের বিত্তবানরা নিতো তাহলে সমাজে কোনো গরীব থাকতো না। যে ভিক্ষা করছে সে ভিক্ষাই করে যাবে ইসলামে এমন কোনো কথা বলা হয়নি।
সমাজে বসবাসকারী শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী মানুষদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সমাজে সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এসব মানুষকে ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মুক্তি দিতে, এঁদের জীবিকা নির্বাহের জন্য আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এমনই একটি ভিন্নধর্মী উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভারতে বসবাসরত বাংলাদেশী মেয়ে অ্যালিনা আলম। অ্যালিনা আলমের নানার বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি গ্রামে। মরহুম ইসলাম খাঁনের নাতনি হন অ্যালিনা আলম। উল্লেখ্য মরহুম ইসলাম খাঁনও ছিলেন একজন দানশীল ব্যক্তি। যাঁর সামাজিক কার্যক্রমে সমাজের সকলশ্রেণির মানুষদের মধ্যে তিনি অভিভাবকের জায়গা করে নিয়েছিলেন। মরহুম ইসলাম খাঁনের নামে প্রতিষ্ঠিত খাঁন ফাউন্ডেশন এখনো সমাজে বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে যাচ্ছে। ইসলাম খাঁন সাহেবের পুত্র মি. মাসুদ খান এবং পুত্রবধূ সুরাইয়া জান্নাতও সমাজের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। মি. মাসুদ খান সাহেব বর্তমানে ক্রাউন সিমেন্ট লিঃ এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এছাড়াও তিনি আরো কয়েকটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সাথে সততা, সম্মান ও সুনামের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। উনার সহধর্মিণী মিসেস সুরাইয়া জান্নাত বর্তমানে বিশ্ব ব্যাংক এ কর্মরত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট।
২৩ বছর বয়সী তরুণী অ্যালিনা আলম অসহায় মানুষদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ভারতে প্রতিষ্ঠা করেন "Mitti Cafe"। নিঃস্বার্থ উৎসর্গ, কঠোর পরিশ্রম, কট্টর সংকল্প, অধ্যবসায় এবং সর্বোপরি, সফল হওয়ার আবেগ এবং তাঁর লালন করা স্বপ্নই তাকে পৌঁছে দিয়েছে তাঁর লক্ষ্যে। সমাজের অসহায় মানুষদের জন্য বাসযোগ্য একটি বিশ্ব বিনির্মানের স্বপ্ন দেখেন এই তরুণী।
কলকাতার একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে অ্যালিনার জন্ম। সেখানেই তাঁর বেড়ে ওঠা এবং সেখানেই পড়াশোনা। কলকাতার একটা স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শেষ করে কলকাতায় মহিলাদের জন্য সেরা কলেজ সোফিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক শেষ করেন। স্নাতক শেষ করার পর তাকে চাকুরীর জন্য ডাকা হয়েছিলো। তিনি তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, দুর্দান্ত উপস্থাপনা এবং যোগাযোগ দক্ষতার সাথে সাক্ষাৎকারকারীদের আক্ষরিক অর্থেই তাদের পদ ছাড়িয়েছিলেন তবে তিনি সেটি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। প্রতিবন্ধীদের জন্য বেঙ্গালুরুসের সমর্থন ট্রাস্টের মূল বক্তব্য ছিল যা তৎকালীন কলেজ ছাত্রকে প্রতিবন্ধী মানুষের অপঠিত সম্ভাবনা দেখিয়েছিল। অ্যালেনা লক্ষ্য করেছেন যে, প্রতিবন্ধী মানুষরা সমাজে পরীয়া(দক্ষিণ ভারতের নীচু জাত) ছিলেন এবং এই জাতীয় লোকেরা কীভাবে সমাজের সম্পদে রূপান্তরিত হতে পারে তা নিয়ে তিনি চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন। তারপরেই এই ধারণাটি তাঁকে "Mitti" নামে একটি ক্যাফে শুরু করার সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছিলো, যা প্রতিবন্ধী মানুষ দ্বারা পুরোপুরিভাবে পরিচালিত হবে(যে সমস্ত মানুষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ হারিয়েছে, অন্ধ বা বধির রয়েছে বা কথা বলতে পারে না এমন মানুষদের)। সালটি ছিলো ২০১৫। শুরুর পর থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কলকাতায় বেড়ে ওঠা অ্যালেনা স্নাতকোত্তর করেছেন মুম্বাইয়ে এবং তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বেঙ্গালুরুতে গিয়েছিলেন। বিদেশী জায়গায় অচেনা লোক, সেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা ছিলোনা, এমনকি কোনো মূলধন ছাড়াই একটি সামাজিক উদ্যোগ স্থাপন এটাকে এক প্রকার দুঃসাহসিক কাজ-ই বলা যায়। আতিথেয়তা শিল্পে বা প্রতিবন্ধীদের সাথে কাজ করার তাঁর কোনো অভিজ্ঞতাও ছিলো না। শুরুতে, সংগঠনগুলো তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো। তবুও সে তাঁর অদম্য সাহস নিয়ে তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের পেছনে লেগে ছিলো। এরপর তিনি সেখানকার স্থানীয় কারো সহযোগিতায় স্থানীয় ভাষায় একটি পুস্তিকা অনুবাদ করেন। সেই পুস্তিকাটি অসহায় পরিবারের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। শুরুতে কারো সাড়া পাননি। এক সপ্তাহ পর তিনি একটি কল পেলেন। কের্তি নামে একজন প্রতিবন্ধী প্রথম অ্যালিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন। কের্তির পরিবার তাকে একটি হুইল চেয়ার কিনে দিতে অপারগ ছিলেন। মহিলাটি বললেন৷ "আপনি কি আমাকে কাজ দিবেন? অ্যালিনা সরাসরি হ্যাঁ বলে দিয়েছিলেন। কের্তিই তাঁর প্রথম কর্মচারী।
আগস্ট ২০১৭, " Mitti" ক্যাফে বিভিবি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি ক্যাম্পাসের দেশপাণ্ডে ফাউন্ডেশনের মরিচা শেডে প্রথম যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে অ্যালিনা এবং সামাজিক উদ্যোগ ফাউন্ডেশন(নন প্রফিট) ৬১ জন শারীরিক অক্ষম ব্যক্তি নিয়োগ দিয়ে পুরো কর্ণাটক জুড়ে আটটি ক্যাফে চালাচ্ছে। এই সংস্থাটি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট বেঙ্গালুরু দ্বারা সংক্রামিত হয়েছে৷ Mitti ক্যাফেগুলো অন্যান্যদের থেকে অনন্য, কারণ তারা এই ক্যাফেগুলোকে উৎপাদনের ক্রিয়াকলাপের জন্য তাদের সম্ভাব্যতা প্রদর্শন করতে এবং কর্মসংস্থানে সমান সুযোগের সচেতনতা তৈরি করতে বিভিন্নভাবে সক্ষম সম্প্রদায়ের জন্য প্ল্যাটফর্ম হিসাবে এটিকে ডিজাইন করেছে।
Mitti কর্মীরা প্রতিবন্ধী হলেও তাঁরা অনেক কিছু করতে পারে। কের্তি যখন Mitti তে কর্মী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, তিনি একটি কাপ বা কলম ধরে রাখতে পারতেন না। ফিজিওথেরাপিস্টের মাত্র কয়েক মাসের অনুপ্রেরণা এবং অনুশীলনের পর আজ ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা কের্তি Mitti এর প্রথম ক্যাফেতে একজন পরিচালক এবং ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করছেন। Mitti তে সাবিহা নামে একজন কর্মী আছেন যিনি একাধিক স্ক্লেরোসিস সহ ঘরোয়া সহিংসতা থেকে বেঁচে যাওয়াদের একজন। তাঁর মিষ্টি কথা গ্রাহকদের আরও বেশি খাবার খেতে মনোনিবেশ করে। অ্যালিনা বলেন, তাঁরা ধীর হতে পারে তবে তারা এই কাজের জন্য যথেষ্ট। তাঁরা মনে করে যে তাঁরা জায়গাটির মালিক এবং তাঁরা খুব আনন্দ নিয়েই কাজ করে। আমরা একে অপরের কাছ থেকে শিখি। তিনি আরো বলেন, তাঁদের কারণে আমাদের যাত্রা সহজ হয়েছে।
অ্যালিনা "সামাজিক ব্যবসা" কি সে সম্পর্কে গভীর উপলব্ধী করেন। যাঁর ফলে তিনি অল্প বয়সেই যা অর্জন করেছেন তা অন্যরা অনুকরণ করার স্বপ্ন দেখে। ভারতে নিজের সুনামের সাথে সাথে তিনি এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়েও পরিচিতি পাচ্ছেন। তিনি প্রতিবন্ধীকরণ অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে উদ্ভাবনের জন্য মাইক্রোসফট নিপম্যান পুরস্কারও পেয়েছিলেন। সম্প্রতি, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য গ্লোবাল প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য ১০ ভারতীয় সামাজিক উদ্ভাবকদের মধ্যে একজন হিসেবে অস্ট্রেলিয়া সরকার কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছেন। স্টার্টআপ ব্যবসায়ের বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য তিনি নিয়মিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট, বেঙ্গালুরু এবং ভারতের আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করেন। তাঁর এক বক্তৃতায় একজন শিল্পপতি তাকে তার ব্যবসায় হস্তান্তর করার জন্য প্রচুর পরিমাণে অর্থের অফার দেন যা তিনি বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। *তিনি টাইমস অব ইন্ডিয়া কর্তৃক অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। * Winner, Rotary Exemplar Award- Best Social Enterprise * Won Tiecon Young Female Entrepreneur of the Year award, for MITTI Café * Winner of Best CSR Initiative @ Annual Restaurant Congress Awards * Won Dainik Jagran Social Enterprise Competition, in the field of Poverty alleviation *Winner, Ford Foundation Social Enterprise Competition * Mitti Cafe received award from the Deputy CM of Delhi for promising Social Enterprise * Social Entrepreneur of the year by Emerge India *Won Bangalore Trote Trophy for Promising social entreprenueur * Winner, Samvidha Social Enterprise Finals,Deshpande Foundation, Hubli
অ্যালিনা আলমের মতো মানুষরাই পারে একটি সমাজকে পরিবর্তন করতে। সমাজে সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের হাতে ভিক্ষার থালার পরিবর্তে যাঁরা তুলে দিবেন সম্মান আর মর্যাদা। অ্যালিনা যে নজির গড়েছেন এটিই হতে পারে সমাজ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করার অন্যতম মাধ্যম। আমাদের তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা যেভাবে চাকরি নামক সোনার হরিণের দিকে দৌঁড়াচ্ছে এটা সচরাচর সবাই করছে। ভিন্নধর্মী, সৃজনশীল কিছু করুন, নিজেই উদ্যোক্তা হউন দেখবেন পুরো পৃথিবী বদলে গেছে। বদলে যাবে, সমাজ দেশ এবং দেশের তরুনদের দৃষ্টিভঙ্গি।
তথ্যসূত্রঃ ১। Masud khan স্যারের ওয়াল থেকে বঙ্গানুবাদ এবং ২। www.mitticafe.org
Make sure you enter the(*)required information