আমি সেই মহান শিক্ষকের উদ্দেশ্যে থুথু নিক্ষেপ করি। তিনি আমার সম্মানীয় শিক্ষক, তাই তাকে আমি সম্মানের সাথে থুথু নিক্ষেপ করতে চাই। আমি তাকে বলতে চাই- জনাব, আসুন, দয়া করে আমার থুথু গ্রহণ করুন। একদিন তিনি আমার এক বন্ধুকে পিঠিয়েছিলেন সাপ পেঠানোর মত। আমার বন্ধু সাপ ছিল না, দশ বছর বয়সী এক অবুঝ বালক ছিল। অবুঝ একারণে নয় যে, তার বয়স কম ছিল। সে বুঝত না, কথা বলতে হলে ঠোঁট নাড়া-ই যথেষ্ঠ। সে হাতও নাড়ত, মাথাও। সেদিন তার পড়া প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু মহান শিক্ষকের বেত প্রস্তুত ছিল। বেত এক প্রকার জড় পদার্থ। জড় পদার্থের একটি বৈশিষ্ট্য হল স্থিরতা। কিন্তু মহান শিক্ষকের বেত জড় পদার্থ হলেও তার হাতের কারামতিতে জীবন্ত হয়ে যায়। হঠাৎ প্রাণ পেয়ে বেত নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আছড়ে পড়ছিল ক্ষুদ্র-অসহায়-অবুঝ বালকের পিঠে। বালক চিৎকার দিয়ে কেঁদে কেঁদে বলেছিল -‘‘আমি শিখেছিলাম, ভুলে গিয়েছি!’’ বেতের আঘাতে বালকের সারা শরীর রক্তাক্ত হল। তার আর্ত-চিৎকার পাঠকক্ষের দরজা জানালা দিয়ে বের হয়ে শ’হাত দুরত্বের রাস্তার পথিকের কানে প্রবেশ করে তাদের চলার গতি থামিয়ে দিয়েছিল, কেবল এক হাত দুরত্বের মহান শিক্ষকের কান দিয়ে অন্তরে প্রবেশ করে তার পাশবিকতা থামাতে পারে নি। একজন তুচ্ছ দশ বছর বয়সী বালক একজন স্বর্গীয় অনুগ্রহ প্রাপ্ত পয়ঁত্রিশ বছর বয়স্ক মহান শিক্ষকের অন্তর ভেদ করবে এ-কি চাট্টিখানি কথা? বালকের কত আকুতি, হাতজোড় করে সে বলেছিল -‘‘বিশ্বাস করুন, আমি শিখেছিলাম, ভুলে গিয়েছি!’’ “বিশ্বাস? বেয়াদবের মত হাত নেড়ে কথা বলছিস আর আমাকে বিশ্বাস করতে বলছিস?” বেয়াদব শব্দটি তসবীহ জপতে জপতে আপনার মুখে উঠেছিল ফেনা আর তার পিঠে উঠেছিল রক্তের ফোয়ারা! সেদিন বালক হয়ত নিজেকে সত্যিই সাপ ভেবে নিয়েছিল। তাই চিৎকার -কান্নাকাটি বন্ধ করে সাপের মত মার খেয়ে শুধু লাফাতে লাফাতে একসময় নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল! হে মহান শিক্ষক! আপনি আমার সালাম গ্রহণ করুন। আপনার পায়ের ধুলায় মলিন করে আমাকে ধন্য করুন। আমি আপনার নিকট চীর কৃতজ্ঞ। আপনার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আপনি শিখিয়েছেন ছোট বাচ্চারা পড়া না শিখে মিথ্যা বলে, শুধু শিক্ষকরা সত্য বলে। আপনি শিখিয়েছেন, যারা পড়া শিখে না, তাদের সাপ পেটানোর মত পেটাতে হয়। আরও শিখিয়েছেন, যারা কথা বলার সময় হাত নাড়ে, তারা বেয়াদব। বঙ্গবন্ধু বেয়াদব ছিলেন। তিনি ৭ই মার্চে হাত নেড়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। তার উচিত ছিল রোবটের মত স্থির থেকে ভাষণ দেওয়া। ভাষা আন্দোলন সহ যত আন্দোলনে মিছিল-মিটিং-এ যারা হাত নেড়ে শ্লোগান দিয়েছিল, তারা সবাই বেয়াদব। আপনি শিখিয়েছেন, শব্দ উচ্চারণের জন্য কেবল দু’ঠোট নাড়া-ই শিষ্টাচার। হে মহান শিক্ষক, আপনি একজন বিজ্ঞানীও। আপনি একবার আমার পিঠে এক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ চালিয়েছিলেন। আপনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণ দেখে আমার বন্ধুরা হা হয়ে তাকিয়েছিল। শুধু একজন চোখ বন্ধ করে থেকেছিল। সে আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিল। আমাকে গরুর মত পেটাতে দেখে তার সহ্য হয় নি। চোখ বন্ধ করেও সে-দৃশ্য থেকে সে মুক্তি পায় নি। মাথা নিচু করে সে কেঁদেছে অনেক, অথচ আমার কান্না-ই পায় নি! সে প্রশ্ন করেছিল -“তোকে এত মারল, তবু কাঁদিস নি কেন?” তার প্রশ্ন শুনে নিজেকে গন্ডার মনে হয়েছিল। আমি গন্ডার ছিলাম না, মানুষের বাচ্চা মানুষ -কেবল অচেতন হয়ে গিয়েছিলাম। তাকে বললাম -“আমি জানিও না যে মার খেয়েছি।” জিজ্ঞেস করলাম -“তুই কেন কাঁদলি?” উত্তর দিল -“তুই কাঁদিস নি, তাই হয়ত।” সে সিদ্ধান্ত নিল পড়ালেখা ছাড়বে। ঠিক আধা ঘন্টা পর প্রতিষ্ঠান তো ছাড়ল-ই, চীরদিনের জন্য পড়ালেখাও ছাড়ল। সে আপনার চোখ দিয়ে সারা পৃথিবীর শিক্ষককে দেখেছিল। আপনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের কী দূর্দান্ত ফলাফল ভেবে দেখেছেন? হে মহান শিক্ষক, আপনি কত বড় জ্ঞানী তা এখনো সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারি না। আধুনিক মনোবিজ্ঞানীরা বলে - শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলা -বিনোদনের প্রয়োজন। বিশেষ করে ৮ থেকে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় তাদের সৃজনশীলতায় সহায়ক যাবতীয় সমর্থন দেওয়া দরকার। যারা উক্ত সময়ে সমবয়সীদের সাথে না মিশে বা খেলা-ধুলা না করে, পরবর্তিতে তারা আত্মকেন্দ্রীক, ভীরু, হাবা-গোবা, অথবা মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়ে। সে সময়টাতে আপনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, খেলাধুলা হারাম। হারামকে দেখা, শুনা, অনুভব করাও হারাম। তাই আমাদের জন্য খেলাধুলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। তবু মাঝে মাঝে নিষেধ অমান্য করে খেলতে ইচ্ছে হতো। কিছুদিন বন্ধুরা মিলে গোপনে ক্রিকেট খেলেছিলাম বিকেলে। আপনি জানতে পেরে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে আমাদের পিটিয়েছিলেন। হে মহান শিক্ষক, সেদিনই শিখেছি ক্রিকেট ব্যাটের বহুমুখী ব্যবহার। একদিন অগ্রজদের পরিত্যক্ত একটি ফুটবল নিয়ে খেলেছিলাম। সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলাম সেই বল। আপনি সে বল উদ্ধার করতে না পেরে আমাদেরকে ফুটবলের মত লাথি মেরে মেরে এ-মাথা ও-মাথা করেও স্বীকার করাতে পারেন নি বলের অবস্থান। হে মহান শিক্ষক, সেদিন শিখিয়েছেন -বল ছাড়াও ফুটবল খেলা যায়! জানি না, সৃজনহীন বন্ধ্যা-মস্তিষ্ক কেন প্রয়োজন ছিল আপনাদের! আপনারা কোন জাতি গঠনের স্বপ্ন দেখে আমাদের মগজ ধোলাই করেছিলেন কে জানে! আজ আপনার খাঁচা থেকে মুক্ত হয়েছি বটে নিজের আত্মার বন্দিত্ব ঘুচাতে পারি নি। বিনোদনের জন্য সমবয়সী বন্ধুরা যখন ক্রিকেট বা ফুটবল খেলতে যায়, আমি একাকী মোবাইলে অশ্লীল ভিড়িও দেখে সময় কাটাই বিনোদনের আশায়। হে মহান শিক্ষক! অনাকাঙ্ক্ষিত রোগ-ব্যাধি আর বার্ধক্য এখন আপনার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গি। অথচ যৌবনে এত ছাত্র প্রসব করেছেন যে গণনায় কুলাতে পারেন নি। আপনার আক্ষেপ, কোন ছাত্র-ই আপনার খোঁজ নেয় না। ধারনাটা ভুল। কেউ না নিলেও আমি নেব আপনার খোঁজ। আপনি আমার মহান গুরু। আপনার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিখেছি। আপনার ঋণ শোধ হবার নয়। মাঝে মাঝে থুথু নিক্ষেপ করে ঋণ শোধ করতে ইচ্ছে হয়। নিকৃষ্ট জিনিসের জন্যই থুথু নিক্ষেপ করা হয়। আপনি উৎকৃষ্ট। আপনার উপর থুথু নিক্ষেপ শোভা পায় না। আমি থুথু নিক্ষেপ করতে পারব না। দয়া করে, আপনি নিজে এসে থুথু গ্রহণ করুন।
Make sure you enter the(*)required information