ইসলামী গবেষণার উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
১৯ দিন ব্যাপী চুনতি সীরতুন্নবী (সঃ)-কে যদি একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক নজরে আমরা কল্পনা করি তাহলে চুনতি সীরত ময়দানকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল উন্মুক্ত কক্ষ হিসেবে আমরা ভাবতে পারি। সীরত মাহফিলের প্রতিদিনের টপিক এর ওপর সিডিউল ভিত্তিক বই ছাপানো হয় এটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত সিলেবাস বলা যেতে পারে। উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ের যেমন কারিকুলাম ও পাঠদান করার আলাদা দিকনির্দেশনা ও কাঠামো থাকে তেমনি এই উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম সিস্টেম আছে। সিলেবাসভিত্তিক সিডিউল অনুযায়ী এখানেও নির্ধারিত বিষয়ের বাইরে গিয়ে কোন অধ্যাপক অর্থাৎ বক্তারা পাঠদান করলে সেটা নিয়ম বহির্ভূত হয়ে যায়। তখন মাহফিল কর্তৃপক্ষের পর্যবেক্ষণ টীম এই নিয়ম ভঙ্গের জন্য পরবর্তী বছরে দাওয়াতনামার খাতায় ঐ বক্তাকে বাতিল হিসেবে গণ্য করেন। ঠিক তদ্রূপ নির্ধারিত বিষয়ের আলোকে আলোচকের দ্বিতীয়বার দাওয়াত পাওয়ার সম্ভবনা থাকে।
মাহফিলের এই সিলেবাসে দেশ-বিদেশের বাংলা ভাষাভাষী ইসলামী গবেষক, বিজ্ঞ মুহাদ্দিস, বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যাদের যথেষ্ট ইসলামিক জ্ঞান আছে এমন সব সুনামধন্য ব্যক্তিত্বদের দ্বারা বিষয়ভিত্তিক আলোচনার যে তালিকা এটা সত্যি এক অভিনবত্ব। বিষয়সমূহ মাহফিল শুরুর হওয়ার একবছর ধরে একটি গবেষক দল দ্বারা যাচাই-বাছাই করে তা সিলেবাসের অন্তর্ভূক্ত করা হয়ে থাকে। বিষয়সমূহ প্রতিটা মুসলমানদের জীবনে অতি জরুরী। যারা আলোচনা করে মানুষকে ইসলামী জ্ঞান দান করেন তাদেরকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর কিংবা শিক্ষক বলা যেতে পারে। আর যারা নাকি এই সীরতের বিশাল পেন্ডেলের বাইরেও ময়দানে বসে মনযোগ সহকারে ইসলামিক আলোচনা শুনে জীবনে তার প্রতিফলন ঘটিয়ে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয়লাভ করেন তাদেরকে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
এছাড়াও মাহফিলের পেন্ডেলে প্রতিদিন অসংখ্য শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটে যারা অন্য মাদ্রাসার স্নাতক, স্নাতকোত্তরে অধ্যয়ন করে এরা এই মাহফিল থেকে অনেক আলোচনা নিজস্ব ডায়েরিতে নোট করে। এসব নোটের বিষয় পরবর্তীতে উনারা নিজেদের গবেষণার কাজে ব্যবহার করে থাকেন। বিশেষ করে চুনতি হাকিমিয়া কামিল (এম. এ.) মাদ্রাসার এমন কিছু ছাত্রদের আমি চিনি যাদেরকে মাহফিলের পেন্ডেলে এরকম নোট করতে দেখতাম তারা বর্তমানে নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে অনেক এগিয়ে গেছেন। তারা অধিকাংশই তুখোড় মেধাবী এবং পরবতীর্তে তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার কাজে জড়িয়ে পড়েন। এম. ফিল, পিএইচডি এর মত উচ্চতর শিক্ষায় তারা এসব নোটকে কাজে লাগিয়েছেন। সফলও হয়েছেন।
অদূর ভবিষ্যতে এই সুবিশাল মাহফিল নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। যেখান থেকে অনেক পজিটিভ দিক উঠে আসবে। পৃথিবীর বুকে এমন একটি ইসলামী সভা আর কোথাও আছে বলে আমার মনে হয় না। এর বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। হ্যাঁ এটাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বোধগম্য এমন ভাষা হয়তো ব্যবহৃত হয় না। যেহেতু এটা শাহ সাহেব কেবলার চিন্তা চেতনা আর লক্ষ্যমাত্রার উপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হয়ে আসছে। এছাড়াও আল্লাহর খাঁজ রহমত আছে বলেই এই মাহফিল দীর্ঘ ৫২ বছর ধরে চলমান আছে। দেশের যত বড় দুর্যোগই হউক না কেন এই মাহফিল ঠিকই অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরিসর সংক্ষিপ্ত করে হলেও এই মাহফিল চুনতির জমিনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। যাহোক শাহ সাহেব কেবলা (রহ) এর জীবদ্দশা থেকে শুরু করে এখনো এটা স্থানীয় ও দেশীয় মুসলমানদের ঈমান, আকিদা ও ইসলামী জ্ঞান সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে স্থানীয় ভাষায় এবং বাংলাদেশের মাতৃভাষা বাংলাতে এই মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
আরেকটা বিষয়ে না বললেই নয় অনেকেই ভুল বুঝে এই মাহফিলে না এসেই এই মাহফিলকে তথাকথিত মাজারের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে অনেকেই এই মাহফিলকে ঘৃণা করে। প্রকৃতপক্ষে এরা শুধু হিংসাই করতে জানে। কখনো মাহফিলে সীরতের পবিত্র ময়দানে এরা পা রাখেনি। এমনকি অনেক আলেম উলামারা পর্যন্ত এই ভুল করতেন। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে এই মাহফিল সবার কাছে সঠিক বার্তা নিয়ে যাচ্ছে। এই মাহফিল যে প্রকৃত সীরতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ সেটা অনেক বিশিষ্ট আলেমেরা পর্যন্ত এই মাহফিলের বক্তা হিসেবে এসে বুঝতে পেরে নিজেদের ভুল স্বীকার করেছেন। যাহোক এই মাহফিলে সীরত আল্লাহ আজীবন বাঁচিয়ে রাখুক। আমীন। আশা করছি ভবিষ্যতে হয়তো মাহফিলের লাইভ সম্প্রচারে ইংরেজি সাবটাইটেল দ্বারা মাহফিলের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা সম্প্রচার করা সম্ভব হবে। এতে বিদেশের মাটিতেও সীরতের গুণগান শোনা যাবে। পৃথিবী ব্যাপী এই সীরত মাহফিল আলো ছড়াবে ইনশাআল্লাহ। সর্বোপরি বলা যায়, এই মাহফিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ। কুরআনের মহান বাণী, রাসুলের জীবনাদর্শ, রাসুলের বাণী প্রচারসহ রাসুল (সঃ) এর প্রতি উম্মতের প্রেমের এক সেতুবন্ধন হিসেবে এই মাহফিলকে পৃথিবীর পরিমণ্ডলে এক বিশেষ স্থান দেওয়া যেতে পারে।
মাহফিলের সৌন্দর্যের আরেক আলোচ্য বিষয় মেহমানখানা এবং মাহফিল পরিচালনা পদ্ধতি:
চুনতি সীরত মাহফিলের বৈশিষ্ট্যগত যে স্বতন্ত্র দিক রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯ দিন ব্যাপী দুপুর এবং রাতে দুই বেলায় মেহমানখানাতে চলে মেহমানদারী। মাহফিলে আগত অগণিত ধর্মপ্রিয় মুসলমানদের, শিশুদের এবং সীরত মঞ্জিলে পর্দা সহকারে মহিলাদের জন্য থাকে আলাদা আপ্যায়নের ব্যবস্থা। যেখানে স্থানীয় এবং দূর দূরান্ত থেকে আগত মুসলমানেরা দুই বেলা আহার গ্রহণ করে মাহফিলের আলোচনা শুনতে পারেন। চুনতি শাহ মঞ্জিল মহিলা আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। মানুষে মানুষে সাম্যের মেলবন্ধন সৃষ্টির এক অপরূপ উদ্যোগ ছিল এই মাহফিলে সীরতের।
মাহফিল কেন্দ্রীয় পরিচালনা কমিটি এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি, উপ কমিটির, শাহ সাহেব কেবলার অগণিত ভক্ত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সর্বোপরি বলা যায় এলাকাবাসীর অফুরন্ত সীরত প্রেম, রাসুল প্রেম, শাহ সাহেব কেবলার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এই মাহফিলের আর্থিক বিষয়টি বাজেট নির্ধারণের মাধ্যমে মাহফিলের কার্যক্রম শুরু করে। যেসব অনুদান কালেকশন হয়ে থাকে তা থেকে খরচ করে উদ্বৃত্ত অর্থ ফান্ডে স্থিতি থেকে যায়। পরবর্তী বছর তা বাজেটের সাথে সমন্বয় করা হয়ে থাকে।
যে বিষয়টি আলোচ্য সেটা হচ্ছে মসজিদে বায়তুল্লাহ অর্থাৎ মাহফিলের মূল পেন্ডেলের পূর্ব উত্তর প্রান্তে অবস্থিত একটি বিশাল হল রুম এবং এর পাশে বক্তা এবং স্পেশাল মেহমানের জন্য রয়েছে ২ তলা বিশিষ্ট একটি বিল্ডিং। দৈনিক দুই বেলায় কমছে কম হলেও ৫০০০-১০০০০ লোকের খাবারের রান্নার আয়োজন হয়ে থাকে পাশে অবস্থিত বিশাল রন্ধনশালায়। এই রন্ধনশালায় দায়িত্বে থাকেন নির্ধারিত কমিটি। কমিটির দায়িত্বরত ব্যক্তিরা একটা শিফট হিসেবে একটি রাধুনি দল পরিচালনা করে থাকেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে ফুড টেস্টসহ নানারকম প্রস্তুতি শেষে এই খাবার টেবিলে যাওয়ার উপযোগী হয়। সীরতের মেহমানখানার আরেক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে টেবিলে খাবার সার্ফ করার সুশৃঙ্খল পদ্ধতি। খুব দ্রুততার সহিত একটি বিশেষ খাবার পরিবেশন কর্মীদল টেবিলে খাবার পরিবেশন করে থাকেন। আরেকটা দল শুধু পানি পান করানোর দায়িত্বে থাকেন। এবার আসুন বক্তাদের মোহমানদারীর কথায়। প্রতিটা বক্তার জন্য আলাদা একটি দল থাকে যারা শুধু মেহমানখানায় খুব যত্ন সহকারে খাবার পরিবেশন করেন। যাতে কোন ত্রুটি বিচ্যুতি না থাকে সেদিকটা খুব সচেতনতার সাথে পরিচালনা হয়ে থাকে।
চাঁদা/অনুদান এবং মাহফিলের জন্য প্রাপ্ত উপহারসামগ্রী সংগ্রহ করার জন্য আলাদা আলাদা বুথ রয়েছে নির্দিষ্ট জায়গায়। মেহমানখানায় ঢুকার জন্য গেইটে থাকেন একটি বিশেষ দল যারা গেইটের শৃঙ্খলা রক্ষা করেন। মাহফিলের আদবের বিষয়টির দিকে যাতে মানুষ সচেতন হয় সেজন্য এই গেইট কর্মীরা একটা ভূমিকা রাখেন।
ওজু এবং শৌচাগার ব্যবস্থা:
মাহফিলের আগত মুসলিম ভাইদের যাতে ওজু এবং মলমূত্রত্যাগ করতে অসুবিধা না হয় সেজন্য মাহফিল উপলক্ষে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল স্থায়ী গণশৌচাগার। যেখানে অনায়াসে কোন সমস্যা ছাড়াই মানুষ ওজু এবং মলমূত্রত্যাগের কাজ সারতে পারেন। অতি দূরদূরান্ত থেকে মাহফিলে কোন মেহমান গেলে থাকার জন্য সংরক্ষিত ব্যবস্থা আছে। যদিও সেটা অতি সংক্ষিপ্ত। তথাকথিত মাজারসমূহে অনেক কবিরা গুনাহ, শিরকের মতে গোনাহের কাজে ভক্তদের লিপ্ত হতে দেখা যায়। মাজার অনেকেই সেজদাহ পর্যন্ত দিতে দেয়। কিন্তু চুনতি শাহ সাহেব কেবলা (রহ) এর মাজার তার সম্পূর্ণ বিপরীত। এই মাজারে এসব কাজ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এবং শাহ সাহেবের দৌহিত্র মুহাম্মদ ইবনে দিনার নাজাত এসব বিষয়ে অত্যনৃত সচেতন। তাই এখানে এসব কার্যকলাপ হয় না। আগত মুসলমানেরা জেয়ারত করাতে পারেন।
সীরতের কর্মীদের ভালোবাসা:
মাহফিলের সবচেয়ে যে বিষয়টি প্রতিটা মানুষকে ভাবাবে সেটা হচ্ছে সীরতের এই বিশাল আয়োজনকে স্বার্থক করতে এক বিশাল কর্মী বাহিনী গঠন করা, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শ্রম দেওয়া মানুষগুলোর নিরলস পরিশ্রম আর মাহফিলকে স্বার্থক করার দৃঢ় প্রচেষ্টার দৃশ্য দেখে মানুষ অবাক হয়ে যায়। চুনতির প্রতিটা ঘর থেকেই যে যার মতো এভাবেই এগিয়ে এসে চুনতির সীরতুন্নবী প্রতি তাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করেন। কেউ কর্মজীবী হলে দীর্ঘ ছুটি নিয়ে হলেও সীরতের কর্মী হয়ে যান। এমনই সার্বজনীন একটি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এই মাহফিলে সীরাতুন্নবী (সঃ)। সীরতের যে প্রস্তুতি সভা হয় তাতেও অগণিত চুনতিবাসীর উপস্থিতি দেখেই বুঝা যায় এটি কেমন সার্বজনীন। কারো সাথে কারো সংঘর্ষ নেই, বিভেদ নেই। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেতার নির্দেশনা অনুসরণ করে দায়িত্ব পালন করেন সীরত কর্মীরা। সীরতের সেচ্ছাসেবার কাজ সেচ্ছাশ্রমে দিয়ে থাকেন। এবং যারা এই মহান দায়িত্ব পালন করেন সবাই ছোট ছোট গ্রুপে কাজ করেন। কি প্রাণবন্ত হাসির ভেতর দিয়ে তারা সীরতের কাজগুলো সম্পন্ন করে মাহফিলের শৃঙ্খলা ও আদব রক্ষা করে সেটা সত্যি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। চুনতি মুন্সেফ বাজারে চুনতির মানুষদের বয়স ভিত্তিক ক্লাব রয়েছে। যেসব ক্লাবগুলো মূলত বন্ধুত্বের বন্ধন বজায় রাখতে গড়ে তোলা হয়েছে। এমন একটি সিস্টেম বাংলাদেশের কোন গ্রামে নেই। এতদঞ্চলে এই কালচার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এসব ক্লাবগুলোর সদস্যরা মাহফিলের নেতৃত্বে ভূমিকা রাখেন। ক্লাবগুলো থেকেও বহু আর্থিক সহযোগিতা আসে মাহফিলে।
মাহফিলের পেন্ডেলের সৌন্দর্যবর্ধন ও অনুষ্ঠান পরিচালনা টীম:
চুনতি সীরতুন্নবীর প্রধান উদ্দেশ্য হলো রাসুলের হাদিস এবং কুরআনের আলোকে মানুষের কাছে দ্বীনি বার্তা পৌঁছে দেওয়া এবং ইসলামিক জ্ঞান সমৃদ্ধ জীবন-বিধান গড়ে তোলার লক্ষ্যে অবতীর্ণ হয়েছিল এই মাহফিলে সীরাতুন্নবী। এরই ধারাবাহিকতায় চলমান এই মাহফিলে সীরাতুন্নবীর সাজানো গুছানো অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন একটি বিশেষজ্ঞ দল। যেখানে সীরতের উপর দীর্গদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষদের নিয়োজিত রাখা হয়। এছাড়াও মাহফিলের প্যান্ডেল এবং প্রায় ৭ একর জায়গা জুড়ে সীরত মাঠের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ সারা বছরই চলতে থাকে। এছাড়াও স্বল্প পরিসরে সংস্কার কাজও চলতে থাকে। তবে মাহফিল শুরুর ১ মাস আগে থেকেই পেন্ডেলের কাজ শুরু হয়ে যায়। যেহেতু ১৯ দিন ধরে এই মাহফিল চলতে থাকে সেহেতু একটু মজবুত করে পেন্ডেলের কাজটি সারতে হয়। স্টেজকে প্রতি বছর নতুনত্বের ছাপ দিয়ে সাজানো হয়ে থাকে। সাউন্ড ও মাইকিং সিস্টেম সব কিছুই নির্ভরযোগ্য সরবরাহকারী দ্বারা সেটাপ করা হয়। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনার দায়িত্বে নির্ধারিত সঞ্চালক থাকেন। স্টেজে আমন্ত্রিত অতিথিদের এবং পেন্ডেলের ভেতরে উপস্থিতি শ্রোতাদের সুবিধার্থে এবং মাহফিলের আদব রক্ষার্থে আরেকটি কর্মী দল সেখানে নিয়োজিত থাকেন। অনুষ্ঠানের শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করেন উনারা। মাহফিল চলাকালীন সার্বক্ষণিক উনারা নিরলসভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যান।
সীরত টিভির ভূমিকা:
১৯ দিন ব্যপী মাহফিলে সীরতুন্নবী (সঃ) এর পুরো ১৯ দিনের আলোচনাসমূহ লাইভ সম্প্রচারিত হয়ে থাকে। ফেসবুক এবং ইউটিউব এ মাহফিলের অফিসিয়াল পেইজে সীরতের ধারণকৃত ভিডিও লাইভ সম্প্রচার করা হয়ে থাকে। এতে দেশ-বিদেশের মানুষেরা সীরতের আলোচনা শোনে উপকৃত হতে পারেন। এই বিশেষ টেকনিক্যাল কাজটি সম্পাদন করে থাকে সীরতুন্নবীর নিজস্ব টিভি "সীরত টিভি"। এছাড়াও চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলা এবং কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা পর্যন্ত ডিশ ক্যাবলের মাধ্যমে সীরতের পুরো অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয় সীরত টিভি নামে চ্যানেলের দ্বারা। এই বিশেষ ডিজিটালাইজেশনের দায়িত্বে থাকেন সম্পূর্ণ আলাদা একটও দল। যাদের পরিশ্রমের ফলপ্রসু মাহফিল সীরতুন্নবীর সুনাম দিন দিন ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী।
সীরতের আর্থিক ক্রান্তিলগ্নে অলৌকিক সহযোগিতার দৃষ্টান্ত:
সীরত মাহফিলের ৫২ বছরের পথ পরিক্রমায় অনেক সময় আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। সীরত মাহফিল শুরু হয়ে গেছে ১০ দিন, ১২ দিন চলে গেছে হঠাৎ করে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। দেশে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে হঠাৎ করে নির্ধারিত বাজেট দিয়ে ব্যয় সংকুলান করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার এমনও দেখা গেছে যে বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছিল তা ঠিকঠাক অনুদান না পাওয়াতে সীরত পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। সীরতের প্রতি আল্লাহর রহমতের কি এক আশ্চর্যজনক বরকত আর্থিক এসব সমস্যা হঠাৎ করে সমাধান হয়ে গেছে। এমনও ঘটনা ঘটেছে মাহফিলে এক প্যাকেট লবন পর্যন্ত নেই। হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে লবনের গাড়ি এসে পৌঁছে গেছে৷ স্টকে গরু আছে মাত্র ১০-১২ টা অথচ আরো বেশ কয়েকদিন বাকি আছে৷ এমতাবস্থায় পরিচালনা কমিটির সবাই পেরেশানি করতেছে কি হবে। অথচ হঠাৎ ২-৪ গাড়ি গরু চলে আসছে। ক্রান্তিলগ্নে এমনও গেছে গাড়িতে গাড়িতে খাবার সীরতের গোডাউনে ঢুকেছে। চুনতি সীরতুন্নবীর অন্যতম দাতাদের মধ্যে রয়েছেন প্রবাসী ভাইয়েরা। যাদের আর্থিক সহযোগিতা সীরতকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
লক্ষ মুসলমানের উপস্থিতিতে সমাপনী মোনাজাত:
চুনতি সীরত মাহফিলের অন্যতম একটি আশ্চর্যজনক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রায় ৭ এক জায়গা কানায় কানায় মুসলমান ভাইদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। লাখো মানুষ সমাপনী দিবসে আল্লাহর সমীপে নিজেদের দোষ ত্রুটির জন্য অনুতপ্ত হয়ে আমীন আমীন ধ্বনিতে দীর্ঘ মুনাজাতের মধ্যদিয়ে ঠিক ফজরের আগ মুহুর্তে এই মোনাজাত শেষ করা হয়। মুনাজাত পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন দেশের একজন হক্কানি আলেম। যার সুললিত কণ্ঠে আল্লাহর কাছে সবার পক্ষ থেকে ফরিয়াদ জানান। মোনাজাতের পক্ষে বিপক্ষেও অনেক যুক্তি হয় তবে অধিকাংশ আলেমদের মতে মোনাজাত করাটাই শ্রেয়। আল্লাহর দরবারে হাত না পাতলে কিভাবে আল্লাহর রহমত বরকত পাওয়া যাবে?
চুনতির ঘরে ঘরে চলে আত্মীয়স্বজনদের মিলনমেলা:
মাহফিলে সীরাতুন্নবী চুনতির মানুষের জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। এটি চুনতির প্রতিটি পরিবারের কাছেও সার্বজনীনতা পেয়েছে। চুনতির ঘরে ঘরে এমনিতে অতিথি আপ্যায়নের যে একটি সুনামের রেওয়াজ আছে সেটা বরাবরই তারা অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছেন এই মাহফিলকে ঘিরে। বছরের একটি মাসে এই মাহফিল আসে। মাহফিলের জন্য অপেক্ষা করেন এর সাথে সম্পৃক্ত সকল মানুষই। যাদের হৃদয়ের স্পন্দন সেই তরুণ সমাজ দুনিয়ার যেই প্রান্তেই থাকুল এই সীরতের জন্য তারা ফিরে আসার জন্য পায়তারা করতে থাকে। ঠিক একই চিত্র দেখা যায় মহিলাদের মধ্যেও। চুনতির পরিবারের সাথে সম্পর্ক হয়েছে এমন মানুষেরাও এই মাহফিলের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন৷ সবাই চুনতির আত্মীয়দের বাড়িতে যাবে। সেখানে সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হবে। তাই চুনতি অনেক পরিবার সারা বছর খেয়ে না খেয়ে হলেও সীরতুন্নবীর মাসের জন্য আলাদাভাবে অর্থ জমিয়ে রাখে। যাতে এই সময় ঘরে মেহমান আসলে ঠিকঠাক আপ্যায়ন করতে পারেন। পৃথিবীর বুকে এমন অনুষ্ঠান ঈদ উৎসব বা ধর্মীয়, সামাজিক কিছু উৎসব ছাড়া আর কি কোন দিনকে উপলক্ষ করে এমন কোন অনুষ্ঠানের নজির আছে? যেটাকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে মেহমানদের মিলনমেলা ঘটে? এমনকি মহিলারা পর্যন্ত ঘরের ছাদে, উঠোনে কিংবা ঘরের ভেতরে বসেই সমাপনী দিবসের মোনাজাতে বসে যান। চুনতির ঘরের ঘরে এমন খুশির আমেজ খুব কম সময়েই হয়ে থাকে। যদিও চুনতির সামাজিক কালচার ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ। সেটা ভিন্ন বিষয়। শুধু চুনতির বুকে সীরতের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য বিষয়টি নিয়ে বললাম।
মাহফিলে সীরতুন্নবী (সঃ) এবং ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সঃ)'র জশনে জুলুস প্রসঙ্গঃ
দক্ষিণ চট্টগ্রামের শেষ প্রান্তে চুনতির মাটিতে ১৯৭২ সালে শাহ মাওলানা হাফেজ আহমদ (রহ. আ.) শাহ সাহেব কেবলা যদি ঐতিহাসিক মাহফিলে সীরতুন্নবী (সঃ আঃ) এর গোড়াপত্তন না করতেন আজকে অত্র এলাকার অনেক মুসলিম জনগোষ্ঠী হয়তো ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সঃ আঃ) উদযাপনের নামে ভিন্ন একটি ঐতিহ্যের দিকে ধাবিত হত। অত্র এলাকার পথে ঘাটে হয়তো অনেক মানুষ এই একটি দিনেই নবীর শানে জশনে জুলুস করত।
শাহ সাহেব কেবলা (রহ. আ.) কেমন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, ধর্মপ্রিয়, এবং ঈমান ও আকিদার ব্যাপারে, ঐতিহ্য সম্পর্কে এতটা সচেতন ছিলেন যে যেটার সামান্য বর্ণনা করা যেতে পারে। যে ব্যাপারটি আমি তুলে ধরছি সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত। ইতিহাস অধ্যয়ন থেকে বিশ্লেষণ বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সঃ আঃ) পালন হয়ে আসছে বহুবছর আগে থেকে। যদিও কিছু কুসংস্কারকে এই অঞ্চলের মানুষ রীতিমতো ইসলামের অংশ বানিয়ে ফেলেছিল। এমনকি এর বাইরেও অনেক কুসংস্কারকে মানুষ ইসলামের বিধি হিসেবে পালন করতো। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এদেশেী পরিমণ্ডলে ইসলামকে নিয়ে যে একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার বানানো হবে সেটা হয়তো তিনি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একটি ইসলামী সমাবেশের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে ইসলামের সঠিক মর্মবাণী পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এটাতো গেল একটা দিক আবার আসা যাক জশনে জুলুসের কথায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ যে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর তবারক আর জশনে জুলুসের ভীড়ে রাসুল (সঃ আঃ) এর আদর্শ আর শিক্ষাকে ভুলে যাবে সেটা হয়তো আগে থেকে শাহ সাহেব কেবলা (রহ. আ.) অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। না হয় এদেশে জশনে জুলুসের আবির্ভাব হয় ১৯৭৪ সালে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের বলুয়ারদিঘিতে অবস্থিত খানাকায় কাদেরিয়া সায়্যেদিয়া তৈয়বিয়া এর মারফত আনজুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের উদ্যোগে জশনে জুলুস অনুষ্ঠিত হয়। কি অলৌকিকভাবে শাহ সাহেব কেবলা জশনে জুলুসের অবির্ভাবের আগেই কুরআনের শাশ্বত বাণী এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ আঃ) এর হাদিসের আলোকে সীরতুন্নবী (সঃ আঃ) মাহফিলের প্রবর্তন করেন।
আমরা লোহাগাড়ার মানুষ সীরতুন্নবী (সঃ) পেয়েছি বলেই ১৯ দিন ধরেই রাসুল (সঃ) শান ও মানকে উপলব্ধি করি। রাসুলের প্রেম আমার অন্তরে আছে বলেই আমরা ১৯ দিন ধরে লাখো মেহমানের খাবার নিশ্চিত করতে পারি। আলহামদুলিল্লাহ গত পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় ধরে এই মাহফিল শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে।
অত্র এলাকার অসংখ্য ইসলামিক বিষয়ের শিক্ষার্থী এই মাহফিল থেকেই ইসলামিক জ্ঞান অর্জন করে সারা বাংলাদেশে সেই বাণী প্রচার করছে। শাহ সাহেব (রহ. আ.) শুধু এই মাহফিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে ইসলামিক জ্ঞানদান করেননি। এই চুনতির বুকে প্রতিষ্ঠিত সীরত ময়দানের প্রান্ত ঘেঁষে অবস্থিত উপমহাদেশের মধ্যে অন্যতম প্রাচীন মাদ্রাসা চুনতি হাকিমিয়া কামিল (এম.এ) মাদ্রাসার খেদমতেও নিজেকে যুক্ত রেখে ইসলামের স্তম্ভের প্রকৃত জ্ঞানদান করেছেন।
তিনি কখনো ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর কখনো বিরোধী ছিলেন না। তবে তিনি ইসলামের নামে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীকে কেন্দ্র করে যেসব কুসংস্কারকে মানুষ ইসলামিক নিয়মে পরিণত করেছিলেন তা নিয়ে হয়তো শঙ্কিত ছিলেন। জশনে জুলুসের সাথে ইসলামের তেমন কোন সম্পর্ক নেই। তবে শাহ সাহেব কেবলা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সীরতুন্নবী (সঃ) এর প্রবর্তন করেন৷ যা বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় এখন ছড়িয়ে গেছে। চুনতির সীরতুন্নবীকে অনেকেই এখন অনুসরণ করে সীরতুন্নবী (সঃ) মাহফিল করে করে থাকেন।
মানুষকে কুসংস্কার থেকে বাঁচাতে ১৯৭২ সালের ন্যায় একই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর ১১ই ররিউল আওয়াল চুনতির মাহফিলে সীরতুন্নবী (সঃ) শুরু হয়। এবং ১৯ দিন এই মাহফিলে দেশ বিদেশে অবস্থানরত শীর্ষ স্থানীয় আলেমগণ মানুষের মাঝে ইসলামিক জ্ঞান দান করেন।
অথচ এ বছর ১২ রবিউল আওয়াল চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত জশনে জুলুস উদযাপন কমিটি নাকি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে নাম লেখানোর জন্য বিশেষ আয়োজন করেছে। এটাই কি ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর উদ্দেশ্য?এটাই কি নবী প্রেম?
অপরদিকে সীরতুন্নবীর দাওয়াত নিয়ে সীরত পরিচালনা কমিটি বাংলাদেশের এক প্রান্থ থেকে অন্যপ্রান্থে মানুষের কাছে সীরতের দাওয়াত পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন শুধু মানুষকে ইসলামের বাণী শোনানোর জন্য। রাসুলের আদর্শের বর্ণনা দিয়ে মানুষকে নবীপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করছে এই মাহফিল। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ এবং রাসূলের প্রেম থাকে অন্তরে। তা বাহ্যিক বিষয় নয়। সকাল বিকেল উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে ইসলামী সংগীত পরিবেশন করে দলে দলে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি করে জশনে জুলুস করে গিনেস বুকে নাম লেখানোর নাম রাসূল প্রেম নয়। ইসলামী শরিয়তের সাথে কতটুকু এসব দিবস উদযাপন সঙ্গতিপূর্ণ তাও ভাববার বিষয় বিষয়।
Make sure you enter the(*)required information