-রম্য রচনাএক.কথায় কথায় ‘এস্তেমাল’ শব্দটা বেশী এস্তেমাল (ব্যবহার) করতেন বলে আমরা তাকে এস্তেমাল চাচা বলে ডাকতাম। এই যেমন ধরুন, - “ওযুর বদনা ইস্তেন্জায় (প্রশ্রাব-পায়খানায়) এস্তেমাল করা মোনসেফ (ভাল) নয়। প্রশ্রাবান্তে ঢিলা এস্তেমাল করা মস্তাহাব, বুঝিলা!” ইত্যাদি... । সহজ সরল ধার্মিক লোকটা পারতপক্ষে কারো উপকার ছাড়া কষ্মিনকালেও অপকার করেছেন বলে জানা নেই। জ্ঞান সাধনা এবং সকলের নৈতিক-চরিত্র গঠনে তাঁর বেশি ঝোঁক। উদাসীনতা এবং লাজুকতার কারণে বিয়েশাদীর ক্ষেত্রে তিনি তার সমবয়সীদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছিলেন। সে সুযোগে আমরা (অপেক্ষাকৃত কমবয়সীরা) অনেকটা তার স্নেহভাজন বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলাম।দুই.তখনকার দিনে একালের মত বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য এত ‘কেলাব-টেলাব’ (Clubs) ছিল না। ছিলনা ভাড়াটিয়া ডেকোরেশন, ভিডিও, আর বিউটি পার্লারের মত গলাকাটার ব্যবস্থা। ছিল বরকনের নিজে বাড়িতে সব আয়োজন। মোবাইল ফোন বা মেসেজ দিয়ে বিয়ের দাওয়াতের বদলে ছিল ছাপানো চিঠিসহ বাহক মারফৎ দাওয়াতে ব্যবস্থা। নাতিদীর্ঘ বিয়ের চিঠির উপরিভাগে উর্দু-ফার্সিবয়েৎ সহ বরকন্যার সংক্ষিপ্ত শজরা দিয়ে প্রায়ই লিখা থাকত- “ জনাব/জনাবা, আগামী ... ইং, মোতাবেক... আমার ... সহিত... নিবাসী ..., এর শুভবিবাহের দিন ধার্য্য হইয়াছে। অতএব... সমালয়ে পদার্পন করত: বরকন্যাকে দোয়ায়ে খায়ের দানে অধীনকে ছরফরাজ করিতে মর্জি করিবেন। পত্রদ্বারানিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনীয়।” ইত্যাদি। তখনকার দিনে ভাবীরা সানন্দে বউ সাজাতো। আর এখন ভাবীরা বউ-সাজানোতো দূরের কথা, কনের সাথে পার্লারে গিয়ে মাথার চেয়ে খোপা বড় করে, নিজে সেজেগুজে কিম্বুৎকিমাকার হয়ে আসে, আর পকেটের বারোটা বাজে বেচারা স্বোয়ামীদের ... ... ... । তখনকার দিনে ছিলনা ‘গায়ে হলুদ’ কহিয়া বিয়ের আগের রাতে যুবক-যুবতীদের অবাধ ফষ্টি-নষ্টি, সাউন্ডবক্সের বিকট আওয়াজে ব্যান্ডসঙ্গীত দিয়ে কান ঝালাপালার অশালীন ব্যবস্থা। ছিল বিবাহবাড়িতেবিয়ের বেশ কিছুদিন আগে হইতে (নন্দের জালের বাপের গোষ্ঠীসহ) নাইয়রী-নারার অসহনীয় আগমন, রং-চা আর বেলা বিস্কুটের বিনিময়ে শেরখানী (সমবেত গানের অনুষ্ঠান), রঙিন কাগজের ফুল কাটিয়া বিয়াবাড়ি সাজানো ইত্যাদি। এতদুপলক্ষে ‘গদাই’ করা মেহমানদের আপ্যায়ন, শালাশালী-দুলাভাইদের ঢং-মশকরা, যুবক-যুবতীদের হাসি, বুড়াবুড়ির কাশি; কিশোর কিশোরীদের চমক, মুরব্বীদের ধমক ইত্যাদিতে ভরপুর হইয়া বিবাহ-বাড়িতে আনন্দের হিল্লোল বহিয়া যাইত...।তিন.যাহা হউক, দেরীতে হইলেও দেখিতে দেখিতে একদিন এস্তেমাল চাচার শুভবিবাহের দিন ঘনাইয়া আসিল। তাঁহার সমবয়সীরা তখন (পাকিস্তান আমলের সেই অভাবের দিনে) সংসার সমুদ্রে পাড়ি দিয়া হাবুডুবু খাইতেছিল। তাহাদের লাগাতর অনুপস্থিতির সুযোগে আমরা ভাসমান কচুরিপানার মত তাঁহার নি:সঙ্গতার শূণ্যস্থান পূরণ করিয়াছিলাম। বর্নিত তৎকালীন বিবাহের রেওয়াজ মোতাবেক আমরাই তাহার বিবাহের যাবতীয় কর্মসূচী পালন করিয়াছিলাম। তাহার (বিবাহিত) সঙ্গী সাথীরা নামকাওয়াস্তে বিবাহে যোগদান করিলেও আগেভাগে ‘ডান হাতের কর্ম’ সম্পাদন করিয়া দুলার অগোচরে লেতেরী-ফেতেরী পোলাপান লইয়া ফিরতি গাড়িতে পগারপার ... । অগত্যা আমরাই ‘কুলুজ ফেরেন্ড’(Close Friend) হিসাবে বরের সাথে ভুরিভোজনের জন্য রহিয়া গেলাম। কিন্তু কইন্যাবাড়ি সুখছড়িতে যে এত কপালের এত দুঃখ লিখা ছিল, তাহা বুঝিতে পারিলাম রাত্রি যখনগভীরতর হইতে চলিল। নিশিত রাত্রে বিভিন্ন আইটেমের শীতল খাদ্য পরিবেশন করিয়া বরের সাথে আমাদের আপ্যায়নকর্ম সম্পাদন হইল। পেটের বারোটা বাজিলেও কনকনে শীত সহ্য করিতে না পারিয়া আমরা কয়জন পাশের এক ভাবীর পিত্রালয়ে আশ্রয় গ্রহণ করিলাম। ভাগ্যিস, ভাবীও বিবাহ উপলক্ষে তখন বাপের বাড়িতে ছিলেন। আমরা লেপমুড়ে দিয়ে তখন এতই সন্তুষ্ট হইলাম যে, নিজেদের অজান্তেই গাহিয়া উঠিলাম সেই পাকিস্তানী গান- “প্যারে ভাবী, ভাবী নেহী, তু মেরা মা হে... ... ... ।”চার.এরপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। একদিন মুন্সেফবাজারে আমাকে একা পেয়ে চাচা বললেন- “ওরে মানিক কাকু! আগামীকাল তোমার চাচীর বাপের গোষ্ঠী বউ-ফিরাফিরি করিতে আসিতেছে। তোমরাতো আমার বিয়াতে অনেক খাটিলা; তোমাকে বাদ দিয়া কেমন কইর্যা! আগামী রাইতে তুমিআমার বাড়িতে খানা খাইতে খামাকা আসিবা। তবে বাবাজী, আয়োজন অল্প, তাই কাহাকেও বলিও না পিলিজ (Please) ।”ভাবলাম, ‘খানা ওমদা হইবে, তাই পেটটাকে একটু চাঙ্গা করিয়া নিই’। নিশারমা’র থলিতে ফুটবল খেলে ক্ষুধাকে ভাল করে শান্ দিলাম। খেলা শেষে চাচার বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম। পথে সঙ্গে এলো ভাগীনা জামাল আর টিপু। মুন্সেফবাজার এসে উত্তরদিকে যেতে লাগলাম। দেখি, ওরা পিছু ছাড়ে না। কিছুদূও এসে একটা পথ চাচার বাড়ির দিকে গেছে। সেখানে তিনজনই গেলাম থেমে। দেখি কেউই কোনদিকে সরে না। নানা অপ্রয়োজনীয় গালগল্পের মাধ্যমে বেশকিছু সময় কেটে গেল। একসময় অসহ্য হয়ে জিজ্ঞাস করলাম, “তোরা কোথায় যাবি বল!”-আমি একটু লালমিয়ার বাড়িতে যাব কিছু আদা-হলুদ আনতে। টিপু কহিল।-আমি একটু টুনুফকিরের বাড়িতে। একটা ঝাঁকিজাল আনতে। কহিল জামাল।-আরে বেটা আসল কথাই বল্ না! দাওয়াত আমারও ছিল। এস্তেমাল চাচা কাউকে বলতে নিষেদকরায় এতক্ষণ বলিনি।টিপু: তাই নাকি? আমাকেও তিনি এ কথা বলায় আমি তোদের এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলাম।জামাল: আমাকেও সেই একই কথা বলেছিলেন। তাই আমিও...-তবে আর দেরী কেন? চল্, চল্!হুমকী খেয়ে গেলাম সবাই চাচার বাড়িতে। দেখি ‘কিল্লাফতেহ’। সবই চিরচেনা মুখ। “খাইয়া-দাইয়া শাহাদত আঙ্গুলি দিয়া দন্তমর্দন করিতেছে। অন্যদিকে ডেকচীগুলোও খা খা করিতেছে।”বুঝিলাম, “আয়োজন অল্প, কাহাকেও বলিও না”-কথাটা এস্তেমাল চাচা পাড়াপ্রতিবেশি প্রত্যেকের কাছেই ‘এস্তেমাল’ করিয়াছিলেন।লেখক: চুনতি মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠা-অধ্যক্ষ ও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
Make sure you enter the(*)required information