রজব মাসের ২৭ তারিখ তথা ২৬ তারিখ দিনগত রাত নবী পাক (স.) পবিত্র মক্কা থেকে মেরাজে গমন করেছিলেন বায়তুল মোকাদ্দাস তথা মসজিদে আকসা হয়ে। যদিওবা গমনের তারিখ নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে।নবী পাক (স.) পবিত্র মক্কার মসজিদুল হারামের নিকটে (বর্তমানে মসজিদের হারামের অভ্যন্তরে) ফুফু উম্মে হানির ঘর থেকে হযরত জিব্রাইল (আ.) এর নেতৃত্বে বাহন বোরাকের সহায়তায় প্রথমে জেরুজালেমের বায়তুল মোকাদ্দাসে পৌঁছেন।বোরাককে বাহিরে রেখে নবী পাক (স.) সমস্ত নবী রাসূলকে নিয়ে এখানে ২ রাত নামাজের ইমামতি করেন। অতঃপর বরকতময় সাখরা তথা পাথরে উঠে এখান থেকে বোরাকের সহায়তায় মহান আল্লাহপাকের সান্নিধ্য পেতে উর্ধ্বাকাশে গমন করেন। এতে তিনি বিভিন্ন আসমানের স্তর সমূহ অতিক্রমকালে একাধিক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন নবী রাসূলের সাক্ষাত পান।আল্লাহর রাসূল (স.) মেরাজে গমনকালে নাকি ফিরবার পথে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাসে নবী রাসূলগণকে নিয়ে ইমামতি করেছিলেন তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও যাওয়ার সময় ইমামতি করেছিলেন এ মতের গ্রহণযোগ্যতা বেশি।নবী পাক (স.) যে রাতে বায়তুল মোকাদ্দাসে আগমনের প্রোগ্রাম সে রাতে খাদেমগণের পক্ষে সমস্ত দরজা বন্ধ করার সুযোগ হলেও একটি দরজা বন্ধ করতে সক্ষম হননি। যা একটি বাস্তব অলৌকিক ঘটনা।হুদায়বিয়ার সন্ধির পর নবী পাক (স.) বিভিন্ন রাজা বাদশাহগণের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি প্রেরণ করেন। রোমের বাদশাহ ঐ সময় জেরুজালেম ছিলেন। এদিকে পবিত্র মক্কাবাসীর অনেকে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করতেন। সিরিয়া বলতে মূলকে শাম, শামের কেন্দ্রস্থল হল জেরুজালেম। অতএব পবিত্র মক্কাবাসীগণ দামেস্ক নয়, জেরুজালেমে গমন করতেন বেশি। এর পক্ষে গ্রহণযোগ্যতা বেশি। যদিওবা ইতিহাসে সিরিয়া শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। রোম বাদশাহ হযরত দেহিয়া ইবনে কালকী (র.) মহান সাহাবা এর মাধ্যমে অতি পবিত্র চিঠি পাওয়ার পর এ বিষয়ে যাচাই বাছাইয়ের জন্য পবিত্র মক্কা থেকে এখানে কোন লোকজন এসে থাকলে তাদেরকে পরবর্তী দিন উপস্থিত করানোর জন্য নির্দেশ দেন। যেহেতু পবিত্র মক্কাবাসী মূলত ব্যবসায়ী। ব্যবসার উদ্দেশ্যে এখানে নিয়মিত আসা যাওয়া করেন।ঐ সময় আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কয়েকজন মক্কাবাসী জেরুজালেমে ছিলেন। তাদেরকে রাজ প্রাসাদে হাজির করা হলে ১০/১২টি প্রশ্নের উত্তরে আবু সুফিয়ান সত্য উত্তর দিতে বাধ্য হন। তবে মেরাজ বিষয়ে নবী পাক (স.) এর বক্তব্যকে সম্পূর্ণ অসত্য বলে রোম বাদশাহকে বুঝাতে চাইছিল। এমনি অবস্থায় প্রাসাদে উপস্থিত থাকা বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রধান যাজক ব্যক্তি জোরালোভাবে বলেন মেরাজের ঘটনা বাস্তব সত্য। পবিত্র মক্কা থেকে আল্লাহর রাসূল (স.) বায়তুল মোকাদ্দাস হয়ে মেরাজে গমন করেন তাও সত্য। তার প্রমাণ স্বরূপ ঐ রাতে এশারের নামাজের পর বায়তুল মোকাদ্দাসের সমস্ত দরজা বন্ধ করা সম্ভব হলেও একটি দরজা কোন ত্রুটি না থাকা সত্বেও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তারপরও তিনি সকালে কারিগর দিয়ে ঠিক করে নিবেন বলে খোলা রেখে দিতে বাধ্য হন। ধর্ম যাজক ফজরের নামাজ পড়তে এলে দেখেন দরজা বন্ধ করা যাচ্ছে, কোন ত্রুটি নেই। ফজরের নামাজ পড়তে এসে অনুভব করে গভীর রাতে বাহিরে জন্তুর অবস্থান ছিল এবং বায়তুল মোকাদ্দাস অভ্যন্তরেও ব্যতিক্রম ধর্মী উপলদ্ধি করতে লাগলেন।বিশ্বের বুকে তিনটি বরকতময় অলৌকিক পাথর রয়েছে। পবিত্র কাবা সংশ্লিষ্ট হাজরে আসওয়াদ ও মকামে ইব্রাহীম। আর তৃতীয়টি হল বায়তুল মোকাদ্দাসে। এ পাথরটি শুন্যে অবস্থান করতেছে বলে ইতিহাসখ্যাত। এই অলৌকিক পাথরের সম্মানার্থে এক গম্বুজে ইমারত নির্মাণ করা হয়। যাকে বলা হয় মসজিদে গম্বুজে সাখরা। সাখরা অর্থ পাথর।এই পাথরের উপরে উঠে নবী পাক (স.) মেরাজে গমন করেছিলেন। যার রয়েছে দীর্ঘ বর্ণনা। এই মেরাজকে নিয়ে বিধর্মী কুরাইশগণ নানাভাবে বিদ্রুপ প্রগান্ডা করতে থাকে। কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দিক (র.) এ মেরাজের ঘটনাকে বাস্তব সত্য বলে খুশি মনে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।মেরাজ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক বলেন- তিনি পবিত্র ও মহিমাময়, তিনি স্বীয় (হযরত মুহাম্মদ (স.)) বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি, যাতে আমি তাঁকে দেখাই আমার কুদরতের কিছু নির্দশন, নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা বনী ইসরাইল আয়াত-১)এ যাত্রা পথে প্রথম আসমানে হযরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হযরত ইয়াহিয়া (আ.) ও হযরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হযরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হযরত হারুন (আ.), ষষ্ট আসমানে হযরত মুসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর সাথে সাক্ষাত ঘটে। তাঁরা সকলেই প্রিয় নবী পাক (স.) কে শ্রদ্ধাভরে সালাম ও মোবারকবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনিও তাঁদের সশ্রদ্ধ সালাম জানান এবং তাঁদের নবুয়তের স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। সিদরাতুল মুনতাহার নিকট গিয়ে পৌঁছলে হযরত জিবরাঈল (আ.) এর যাত্রা বিরতি হয়। অতঃপর নবী পাক (স.) অনাদি, অনন্ত, অবিনশ্বর, অসীম শক্তি, সামর্থ ও প্রজ্ঞার অধিকারী আল্লাহপাকের একান্ত সান্নিধ্যে এলেন। পর্দার এক পার্শ্বে বিশ্ব জাহানের চির আরাধ্য, এক ও অদ্বিতীয় মাবুদ, স্রষ্টা ও প্রতিপালক প্রভু, অন্যপার্শ্বে তাঁর একান্ত অনুগ্রহভাজন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও প্রিয়তম হযরত মুহাম্মদ (স.)। তাঁদের মাঝখানে রয়েছে দুইধনুকের মত জায়গা কিংবা তার চাইতেও কম ব্যবধান। অনুষ্ঠিত হল স্রষ্টা ও সৃষ্টির অভূতপূর্ব সাক্ষাতকার।মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম নবীর উদ্দেশ্যে সালাম, রহমত ও বরকতের বাণী পৌঁছান। তোহফা স্বরূপ বরাদ্ধ করা পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত অনুরোধক্রমে কমিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত মঞ্জুর করিয়ে নেন।অতঃপর সকাল বেলা হাবিবে খোদা (স.) স্বগোত্রীয় লোকদের নিকট তাঁর এ মহান সফরের বর্ণনা প্রদান করলে তারা এটাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়। হযরত আবু বকর (র.) নবী পাক (স.) এর এ ঘটনার প্রতি তাৎক্ষনিক পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করেন। নবী পাক (স.) এর সময়ে এবং পরবর্তীকালে ইমলাম বিদ্বেষীরা মেরাজের ঘটনাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা, অবাস্তব ও অযৌক্তিক বলে আখ্যায়িত করে। তারা অবশ্য এ সংক্রান্ত নবী পাক (স.) এ নিকট বিভিন্ন প্রশ্ন করে লজ্জিতও হয়েছিল। যেমন তারা প্রশ্ন করেছিল, মক্কা মোকাররমার মসজিদুল হারাম থেকে জেরুজালেমের মসজদিুল আকসার দূরত্ব অনেক, এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কি করে সশরীরে মসজিদে আকসায় গেলেন এবং নামাজের ইমামতি করলেন। তারা এটা বিশ্বাস করতে পারেনি বিধায় তাঁকে মসজিদে আকসার দরজা, জানালা ইত্যাদি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করতে আরম্ভ করল।অতঃপর আল্লাহ পাক পুরো মসজিদে আকসা নবী পাক (স.) এর সম্মুখে তুলে ধরলেন এবং তিনি শান্তভাবে সকল প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিলেন। এমনকি তিনি জানালেন, পথিমধ্যে তাদের এক কাফেলার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়েছিল। পরবর্তীতে সেই কাফেলার কাছে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে এর সত্যতা যাচাইয়ের পর তারা মেরাজ প্রসঙ্গে দ্বিধা দ্বন্ধের মধ্যে পড়ে যায়।পবিত্র মেরাজ হল আল্লাহর রাসূলের (স.) মুজেজা। বিশ্বে যুগে যুগে নবী-রাসূল আল্লাহ প্রদত্ত মুজেজার অধিকারী ছিলেন। যেমন ইসলামের প্রাথমিক যুগে মক্কা মোকাররমার অধিকাংশ মানুষ ঈমান আনেনি। তারা আল্লাহর রাসূল (স.)কে প্রায় বিভিন্ন প্রশ্ন করত এবং বিভিন্ন মুজেজা প্রদর্শনের দাবী জানত। ঐ সময়কার একবারের ঘটনা, কাফেলেরা দাবি করল, চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করার জন্য। আল্লাহর রাসূল (স.) আঙ্গুলের ইশরা করার সাথে সাথেই চাঁদ দুটুকরা হয়ে দুদিকে ঢলে পড়ল। আবার ইশারা করাতে চাঁদ জোড়া লেগে গেল। মেরাজের এ সফর হয়েছিল সেকেন্ড এরও কম সময়ের মধ্যে। যা নবী পাক (স.) এর অন্যতম মুজেজা।ক্যাপশন: নবী পাক (স.) মসজিদে আকসা এ গম্বুজের অভ্যন্তরে সাখরা (পাথর) হয়ে মেরাজে গমন করেছিলেন।সুত্র ঃ সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ দৈনিক পূর্বকোণ
Make sure you enter the(*)required information