হযরত শাহ মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ.) নিজের পীরের প্রতিষ্ঠিত ছোট কলবরে বায়তুশ শরফকে বিশালত্ব দান করে যান। তিনি ছিলেন নিরহংকারী বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ধর্মীয় ও সাধারণ উচ্চ শিক্ষিতগণের জন্য অনুকরণীয় অনুসরণীয় বলে মনে করি।১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯৮ সালে ইন্তেকাল পর্যন্ত দীর্ঘ সময় এ মহান ব্যক্তিত্বের সাথে আমার আন্তরিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। ১৯৭৫ সালে সরকারী ব্যবস্থাপনায় মাত্র ৩ হাজার জনকে লটারীর মাধ্যমে নির্ধারণ করে হজ্বে গমনের ব্যবস্থা করে সরকার। আমি আবেদন করে ব্যর্থ হই, লটারীতে নাম না আসায়। ঢাকায় সৌদি দূতাবাস না থাকায় দুবাই গমন করে সপ্তাহখানেক অবস্থান করে ভিসা নিয়ে জেদ্দা হয়ে পবিত্র মক্কা পৌঁছি। দেখা হয়ে যায় হযরত শাহ মাওলানা সিদ্দিক আহমদ আজাদের সাথে। তখন মসজিদুল হারমের উম্মে হানিতে চট্টগ্রামের হজ্বযাত্রীগণের অত্যধিক আনাগোনা থাকত। হযরত আজাদ ছাহেব আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন বায়তুশ শরফের পীর হযরত শাহ মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ) এর সাথে। আব্বাজানের সন্তান হিসেবে আমাকে চিনে নেয়া স্বাভাবিক। তখন উম্মে হানিতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়াকালীন বায়তুশ শরফের এ মহান পীর ছাহেবের সাথে নিয়মিত আলাপ আলোচনায় আমরা উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তিনি এসেছেন ঢাকা থেকে লন্ডন হয়ে। হজ্বের পর উভয়ের ফিরতি ফ্লাইট ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে লন্ডন হয়ে ঢাকা। আমরা উভয়ের আকাঙক্ষা লন্ডন না গিয়ে জেদ্দা থেকে সরাসরি দেশে চলে আসা। শীতকালে হজ্ব, লন্ডন বরফ আচ্ছাদিত থাকবে স্বাভাবিক। তাঁর ফ্লাইট কোন তারিখে জেদ্দা থেকে লন্ডন হয়ে ঢাকা আমাকে জানিয়ে দিলেন। আমারও ফ্লাইট সিডিউল তাকে জানিয়ে দিলাম। হজ্বের পর পবিত্র মদিনায় ৮ দিন থেকে জেদ্দা আসি। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে যোগাযোগ করি। এক উদারপ্রাণ কর্মকর্তা প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন লন্ডন না গিয়ে আমাকে সরাসরি ঢাকা পাঠিয়ে দেয়ার জন্য। ফলে আমাকে ৫/৬ দিন জেদ্দা থাকতে হয়। ছোট জেদ্দা শহর এরিয়ায় বাস রয়েছে আধা রিয়াল দিলে যে কোন দিকে যাওয়া যায়। হযরত পীর ছাহেবের ফ্লাইট সিডিউল জানা থাকায় জেদ্দা বিমান বন্দর চলে যাই। উভয়ে দীর্ঘক্ষণ বিমান বন্দরে বসে আলাপ করলাম। গল্পের মধ্যে আমার লন্ডন ফ্লাইট বাতিল করে ঢাকা আসার প্রক্রিয়ারত জানালাম। তিনিও এ সিস্টেমটা জানলে উভয়ে এক সাথে ঢাকা আসতেন বললেন। এক সাথে হজ্ব করা হলে উভয়ের মধ্যে একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৯৭৭ সাল অক্টোবরের ২১ তারিখ শুক্রবার সকালে আমার হযরত পীর ছাহেব কেবলা (গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর) ইন্তেকাল করেন। আমার ভগ্নিপতি ও পীর ভাই এডভোকেট ফরিদ আহমদ চৌধুরীর (মরহুম) জীপ সহ সময় বাঁচানোর জন্য আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে চলে আসি। যেহেতু ৪ টা বাজে জানাযা। জুমার পরপর উভয়ে জীপের সামনের সিটে বসে গারাংগিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পেছনে যে যেভাবে পারে উঠে গাড়ি ভর্তি হয়ে যায়। আরাকান মহাসড়ক তখন সরু ঢালাই কার্পেটিং। ফলে গাড়ির গতি কম। পটিয়ার কাছাকাছি পৌঁছতে না পৌঁছতে দেখি বায়তুশ শরফের পীর ছাহেব কেবলা নীল রংয়ের টয়োটা কারে পেছনে বাম পাশে বসা। গাড়ী চলাকালীন এক অপরে গাড়ী অতিক্রম করার সময় উভয়ে মুখোমুখি আন্তরিক দৃষ্টিতে মুচকি হাসি চলমান।উনি চেষ্টা করতেন বৎসরে একবার হলে বাঁশখালী তরিকতের সফর করতে। আরাকান রোড সাতকানিয়া হয়ে বাঁশখালী যাতায়াত যোগাযোগ প্রতিকূলতা, সড়কের অবস্থাও যেনতেন। তারপরও সফর করতেন। আমার আগ্রহে সাড়া দিয়ে ২ বার বাঁশখালী হামেদিয়া রহিমা ফাজিল মাদ্রাসায় আসেন। একবার বৃষ্টিতে রাস্তা কাঁদা হয়ে গেছে। তারপরও তিনি রিক্সায় করে কাঁদার ভিতর দিয়ে এই মাদ্রাসায় এসেছিলেন।তিনি প্রতি বছর হজ্ব সফর ছাড়তেন না। আমারও সৌভাগ্য হত হজ্বে গমন করার। এতে মসজিদুল হারমের উম্মে হানিতে আমরা উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতাপূর্ণ আলাপ হত।তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ হলে প্রথম পরামর্শ সভার আয়োজন করেন। হয়ত চট্টগ্রাম থেকে শ’খানেক ব্যক্তিত্বকে দাওয়াত দেন। তিনি আহ্বায়ক, অধ্যক্ষ এ. এ. রেজাউল করিম চৌধুরী ও মাওলানা সামশুদ্দীন যুগ্ম-আহ্বায়ক। আমারও আমন্ত্রণ পত্র পাওয়ার সৌভাগ্য হয়। যথা সময়ে জেলা পরিষদে গমন করি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. আবদুল করিম, প্রফেসর ড. মঈনুদ্দীন খান, প্রফেসর ড. শাব্বির আহমদ, মাওলানা সুলতান জউক নদভীসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বগণ বসে আছেন। এমন সময় সম্মানিত পীর ছাহেব জেলা পরিষদ হলে প্রবেশ করলেন। কয়েকজন দ্রুত গিয়ে তাকে মঞ্চে চেয়ারে বসাতে চাচ্ছেন। তিনি তাদের উপর বিরক্ত হয়ে মঞ্চের ফ্লোরে বসে পড়েন। অনুষ্ঠান শুরুর সময় তিনি মঞ্চে গিয়ে আসন গ্রহণ করেন।আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের স্বনামধন্য খতিব আওলাদে রাসূল হযরত সৈয়দ আবদুল আহাদ আল মাদানী (রহ.) ১৯৯৫ সালে রমজানের শেষের দিকে ইন্তেকাল করেন। হযরত পীর ছাহেব বিশালভাবে শোক সভার আয়োজন করেন আন্দরকিল্লা জামে মসজিদের সামনের চত্ত্বরে। ঢাকা নোয়াখালী কুমিল্লাসহ দেশের অনেক ইসলামী ব্যক্তিত্বের সমাগম হয়। এত চেয়ার দেয়া সম্ভব নয় বিধায় তার জন্য একটি চেয়ার দেয়া হয়েছে। তিনি চেয়ার সরিয়ে সকলের সাথে ফ্লোরে বসে যান।গারাংগিয়া হযরত ছোট হুজুর কেবলা হঠাৎ করে বায়তুশ শরফ গমন করেন। হযরত পীর ছাহেব লম্বা সোফায় বসতেন। সাথে ইচ্ছা করলে আরও ২ জন বসা যাবে। ওস্তাদ হযরত ছোট হুজুর কেবলাকে স্বাগত জানিয়ে নিজ আসন সোফায় বসায়ে দেন। হযরত পীর ছাহেব সকলের মাঝে ফ্লোরে বসে যান। তখন হযরত ছোট হুজুর কেবলা বলে বলে আহ্বান জানান “আর ফুতুন্ন্যা আর ডাকদ্দি বইব”। অর্থাৎ আমার সন্তান আমার পাশে বসবেন। কিন্তু না এই নিরহংকারী মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ওস্তাদের পাশে গিয়ে বসলেন না। সকলের মাঝে ফ্লোরেই ছিলেন। যা একালে ধর্মীয় জগতে ভাববার বিষয়।তিনি ১৯৯৮ সালে ২৫ মার্চ ইন্তেকাল করেন। সময়টা ছিল হজ্বের কিছুদিন আগে। পলোগ্রাউন্ডে তাঁর জানাযা হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীতে স্মরণ কালের ২টি জানাযা যুগ যুগ ধরে স্মরণে থাকার কথা। একটি হল প্যারেড ময়দানে হযরত শাহ মাওলানা আবদুল মালেক তথা মালেক শাহ ছাহেবের। অপরটি হল পলোগ্রাউন্ডে বায়তুশ শরফ হযরত পীর ছাহেবের। উভয় জানাযায় আমার উপস্থিত থাকা হয়।তিনি ইন্তেকাল করে গেছেন প্রায় ২৫ বছর হয়। কিন্তু ধর্মীয় জগতের এই বিশাল ব্যক্তি মানবকল্যাণে বহুবিধ যে অবদান রেখে গেছেন তা যুগ যুগ ধরে স্মরণে থাকবে। তিনি নিজের পীরের প্রতিষ্ঠিত বায়তুশ শরফকে বিশালভাবে সাজিয়ে যান।তাঁর ইন্তেকালের পর হযরত শাহ মাওলানা কুতুব উদ্দিন (রহ.) বায়তুশ শরফের পীর হন। তাকে ইলমের সাগর বলা হয়। তাঁর সাথে আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তবে তা ব্যতিক্রম হাস্য রসাত্মক। তিনি মানুষের সাথে হাসির ছলে কথা বলতে সাচ্ছন্দবোধ করতেন। আমার সাথেও তাই করা হয়। ২০ মে ২০২০ ইং তাঁর ইন্তেকালে হযরত মাওলানা আবদুল হাই নদভী বায়তুশ শরফের হাল ধরেন। পিতার অনুকরণ অনুসরণে বছরে ৪ জন গুণীজন বাছাই করে সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেন। আমাকেও গুণীজন বাছাই করে সংবর্ধনার আশা পোষণ করেন। কেন জানি আমার মন একটু ব্যতিক্রম ধর্মী অনুভূতি কাজ করছিল। দুনিয়াতে গুনীজন না হয়ে আল্লাহর কাছে গুনীজন হওয়ার প্রত্যাশা কাজ করছিল মনের গভীরে। এমনিতে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে সাচ্ছন্দবোধ করি। সংবাদপত্রে বড় চেয়ারের খায়েস ও বেপরোয়া খায়েস নিয়ে একাধিক লেখাও লিখি । আমার অনুভূতি দুনিয়া, আখিরাত সমান্তরালে চলতে পারে না। আখিরাত পেতে চাই, দুনিয়া পেতে চাই না। যা হযরত শাহ মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ.)ও ছিলেন। তিনি মানুষকে অত্যধিক সম্মান করতেন, নিজেকে সম্মানিত দেখাতে চাইতেন না। তিনি হয়ত প্রয়োজনের তাগিতে বড় বড় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন, সভাপতিত্ব করেছেন, প্রধান অতিথি ছিলেন। তা অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে করতে হয়েছে। মৌলিকভাবে তিনি দুনিয়াকে পদদলিত করে আখিরাতকে বুকে ধারণ করে দুনিয়া থেকে শেষ বিদায় নিয়ে গেছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।মহান আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। (আমিন)সূত্র : সোমবার, ৫ জুন ২০২৩ দৈনিক পূর্বকোণ
Make sure you enter the(*)required information