মানবজাতি মূলত দুটি জেন্ডারে বিভক্ত। তৃতীয় জেন্ডারের আলোচনা আপাতত বাদ দিলাম। সভ্যতা নির্মাণে মানব-মানবী উভয়েরই সম অবদান রয়েছে, যা কবি নজরুলের কবিতায় উঠে এসেছে "... অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর..."। বস্তুত মানবজাতির সূচনা লগ্নে নারীর হাত ধরে গুহা বা বসবাসস্থলের আশেপাশে কৃষি কাজের প্রবর্তন হয়, যার মাধ্যমে সভ্যতার ক্রমবিকাশ শুরু হয়। তবে লক্ষনীয় হলো, সমাজের শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ, মৌলিক অধিকার আদায়ে কিংবা শিল্প-সাহিত্য খাতে নারীরা পিছিয়ে ছিলো (উল্লেখ্য, ইউরোপের মতো আধুনিক সমাজে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে নারীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে)। হয়তোবা সমাজ সচেতনতার অনুপস্থিতিসহ নারী শরীরের প্রকৃতি প্রদত্ত দুর্বলতা, বিশেষত ধারাবাহিকভাবে সন্তান ধারণের প্রবণতা এজন্য দায়ী ছিলো।তবে যুগের পরিক্রমায় আধুনিক ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ বৃদ্ধির সাথে সাথে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের আবির্ভাব/উন্নতির সাথে সাথে নারী জাতি সমভাবে এগিয়ে যেতে লাগলো এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের ডিঙিয়ে যাওয়া শুরু করলো। এক্ষেত্রে বিখ্যাত বিজ্ঞানী মেরি কুরির উদাহরণ বিবেচ্য। উল্লেখ্য, তিনি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনপূর্বক দু দু'বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। মাদার তেরেসার কথাও উল্লেখ করা যায়। এছাড়াও ফাতিমা আল ফিহ্রি (৯ম শতকে মরক্কোর আল কারাউইন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক), মৈত্রায়ি (প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে বেশী আলোচিত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতী মহিলা), প্রাচীন ভারতের এক বুদ্ধিমতী গৃহবধূ 'খনা' (যার তাৎক্ষণিক আওড়ানো বুলিগুলো 'খনার বচন' হিসেবে পরিচিত), হেলেন কেলার, রানী ভিক্টোরিয়া, মহাকাশচারী ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা প্রমুখের নাম বিশ্ব ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এতদ্ব্যাতিত, রহস্য গল্পের লেখক এডগার এলান পো'র সাহিত্যকর্মের নেপথ্যে পো'র স্ত্রীর সক্রিয় সহযোগিতা রয়েছে বলে অনেকে ধারণা করে। এদিকে বিপরীতভাবে মধ্যযুগের 'ব্লাড কাউন্টেস' হিসেবে পরিচিত ঠান্ডা মাথার খুনি এলিজাবেথ বাথোরি, রহস্যময় গোয়েন্দা 'মাতা হরি' কিংবা মিশরীয় সম্রাজ্ঞী ক্লিওপেট্রাকেও ইতিহাস ভিন্নভাবে মনে রেখেছে। নারীরা মায়ের জাত। মানব বংশ নিয়ে যতই আলোচনা করা হোক না কেন, নারী জাতিই পরম্পরা সূত্রে মানবজাতির ধারক ও বাহক। এ কারণে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, "আমাকে একজন ভালো মা দাও, আমি একটি ভালো জাতি উপহার দিব"। তবে নেপোলিয়ন ভালো মা চেয়েছিলেন, যেহেতু মা' দের চারিত্রিক/বৈশিষ্ট্যগত ভালো-মন্দের উপর একটি জাতির ভালো বা মন্দ হওয়া বহুলাংশে নির্ভর করে। এখানেই মা বা নারী জাতির গুরুত্ব বুঝা যায়। তবে নারী শ্রেষ্ঠত্ববাদের পাশাপাশি নারীর মন নিয়ে ইতিহাস নানাভাবে বিচলিত হয়েছে। নারীর মন নাকি রহস্যময় ও বোধন ক্ষমতার বাহিরে, পুরুষ সমালোচকদের এটি একটি সাধারণ অভিব্যক্তি বা অভিযোগ। হয়তোবা এ অভিযোগের যথাযথ ব্যাখ্যা না পেয়ে ইতিহাসে নারীকে দুর্বল আখ্যা দেয়া হয়েছে। এ কারণে বোধ হয় শেক্সপিয়ার হ্যামলেট এ বলেছিলেন "Frailty, thy name is woman...." (দুর্বল, তুমি নারী)। অবশ্য ইতিহাসের কিছু উত্থান-পতনের নেপথ্যে থাকা নারীর সম্পৃক্ততা, তার এই দুর্বলতাকে 'ছলনা' হিসেবে চিহ্নিত করে থাকতে পারে। তবে এটি ঠিক যে, বিশ্বের অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও ঐতিহাসিক সাহিত্যকর্ম সৃষ্টির নেপথ্যে নারীর তথাকথিত ছলনা, নারী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়া কিংবা নারীর অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রভাব রয়েছে। প্রকৃতি নারীকে দৈহিক ও মানসিক দিক বিবেচনায় ভিন্ন আঙ্গিকে তৈরি করেছে। নারীর মন বোঝা একারণে একটি চরম দুর্বোধ্য বিষয় হতে পারে!! তাই ম্যাক্সিম গোর্কি সম্ভবত বলেছিলেন "নারীর মন বোঝা আর ভলগা নদীর উপর বাঁধ দেয়া একই বিষয়"। উল্লেখ্য ভলগা রাশিয়ার প্রমত্ত নদীগুলোর অন্যতম এবং এর উপর সহজে বাঁধ নির্মাণ করা যেত না। নারীর কোন প্রশ্নের উত্তর দিলেও বিপদ, না দিলেও বিপদ অর্থাৎ উভয়সন্কট পরিস্থিতি, যা সক্রেটিস বুঝতে পেরেছিলেন বোধহয়। সক্রেটিস একদা ঘরের দরজার সামনে বারান্দায় বসে এক নিবিষ্ঠে কিছু চিন্তা করছিলেন। এ সময় তার স্ত্রী তার নিকট কিছু জানতে চান। কয়েক দফা জিজ্ঞেস করার পরও একাগ্র চিন্তায় মগ্ন সক্রেটিস তার উত্তর দেননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে স্ত্রী তার মাথায় এক বালতি পানি ঢেলে দেয়। অবশ্য সক্রেটিস পরবর্তীতে বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করছিলেন, মেঘের গর্জনের পর বৃষ্টি হয়, এটি স্বাভাবিক। ঘটা করে নারীর মন দুর্বোধ্য, এমন দাবি করা হলেও নারীর মেধা, মননশীলতা ও সৃষ্টিশীল মানসিকতা অবশ্যই সভ্যতার উত্তরণে ভূমিকা রেখেছে। নারীর প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু গুণাবলী এর অন্যতম কারণ। সাম্প্রতিক সময়ে মানব মস্তিষ্ক নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হয়েছে। মানব মস্তিষ্ক আমরা জানি প্রধানত দুটি খন্ডে (lobe) বিভক্ত ; বাম খন্ড ও ডান খন্ড। এর মধ্যে দেখা গিয়েছে, পুরুষ জাতি সচরাচর বাম খন্ড বেশি ব্যবহার করে (উল্লেখ্য বাম মস্তিষ্ক শরীরের ডান পাশ ও বিপরীত ভাবে ডান মস্তিষ্ক শরীরের বাম পাশ কে বেশি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বলে দাবি করা হয়)। অন্যদিকে নারী জাতি মস্তিষ্কের বাম ও ডান উভয় অংশকে সমানভাবে ব্যবহার করে এবং এ ব্যবহারের মাত্রা পুরুষ জাতির চেয়ে চার গুণ বেশি। উল্লেখ্য, বাম পাশের মস্তিষ্ক বেশি ব্যবহৃত হওয়ায় পুরুষ জাতির ডান পার্শ্বিয় প্রবণতার আধিক্য দেখা দেয়। ফলে ডান হাতের সুবিধার্থে শার্ট/ টি শার্টের পকেট (বাম পাশে), বেল্ট ও প্যান্টের চেন সন্নিবেশ করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে নারী জাতির জন্য এরূপ বিশেষত্বের প্রয়োজন জরুরি নয়। এদিকে মানব শরীরে বিভিন্ন ধরনের হরমোন নি:সরন এর ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারী জাতির মধ্যে ভেদাভেদ রয়েছে। যেমন: নারী জাতির ক্ষেত্রে বিশেষ হরমোন রস অক্সিটোসিন, সেরোটেনিন ও ডোপামিন নি:সরনের হার তুলনামূলকভাবে বেশি, যে কারণে নারীর সুখ বা তৃপ্তির অনুভূতি মাত্রা, মস্তিষ্কের বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও একনিষ্ঠতা মনোভাবের আধিপত্য লক্ষনীয়। আরো বলতে গেলে যৌন আকাঙ্ক্ষাও বেশি। বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও একনিষ্ঠতা গুনাবলীর কারণে নারী জাতি কিছু বিশেষায়িত পেশায় (ব্যাংকিং, মহাকাশ গবেষণা, আইটি সেক্টর, ইলেকট্রনিক্স বিষয়ক ক্ষেত্র ইত্যাদি) ভালো দক্ষতা দেখিয়ে আসছে। যদিও পুরুষ জাতির মস্তিষ্কের আকৃতি নারী জাতির মস্তিষ্কের চেয়ে ১০% বেশি বড় হয়ে থাকে, এ তারতম্য মস্তিষ্কের গুনাগুন কম বেশি করে না। তবে পুরুষের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের Inferior-Parietal Lobule অংশটি তুলনামূলক বড় হয়ে থাকে, যে কারণে নারীর চেয়ে পুরুষের কথা বলার দক্ষতা, ইন্দ্রিয় সক্ষমতা ও সহজাত বুদ্ধি সামর্থ্য বেশি হওয়ার কথা থাকলেও মস্তিষ্কের বিন্যাসে তারতম্য থাকায় তা হয় না। উল্লেখ্য, পুরুষ জাতির বাম ও ডান মস্তিষ্কের স্নায়বিক তন্তু "নিউরন"গুলো উপর-নিচ ভাবে প্রায় সমান্তরালে লম্বালম্বি সন্নিবেশিত থাকে। অপরদিকে নারীজাতির মস্তিষ্কে নিউরনগুলো বাম ও ডান অংশ কে আড়াআড়িভাবে সংযুক্ত করে।
এভাবে দৈহিক গঠনের পাশাপাশি মস্তিষ্কের গঠনেও নারী-পুরুষ জাতের মধ্যে কম-বেশি ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। এ ধরনের বিপরীত ধর্মী বৈশিষ্ট্যের কারণে বোধহয় দুটো জাতের মধ্যে আকর্ষণ-বিকর্ষণ, পছন্দ-অপছন্দ, প্রেম-ভালবাসার অনুভূতি গড়ে উঠেছে, যা মানবজাতির বিস্তারের জন্য অপরিহার্য। নারী জাতির প্রতি প্রেম-ভালোবাসা শুধুমাত্র গ্রিক পুরাণের হেলেন বা ইংল্যান্ডের রাজ সিংহাসন ত্যাগী কিং এডওয়ার্ডের ওয়ালিস সিম্পসন এর ন্যায় প্রেমিকার বিশেষণে গড়ে উঠে না। এর বিস্তার আরো ব্যাপক। নারী জাতি বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মা, স্ত্রী, বোন কিংবা মেয়ে হিসেবে পরিচিতি পায়। আবারো বললে, শুধু স্ত্রী বা প্রেমিকার প্রতি পুরুষের সহজাত ভালোবাসা গড়ে উঠে তা না। বরং মা ও কন্যার প্রতি একজন পুরুষের ভালোবাসা অনেক ক্ষেত্রে আরও বেশি হতে পারে। একজন ছেলে হিসেবে মায়ের প্রতি ও বাবা হিসেবে কন্যার প্রতি ভালোবাসা, আবেগ-অনুভুতি হয়তোবা বাহ্যিকভাবে প্রকাশ না পেলেও এর প্রচ্ছন্ন তীব্রতা অত্যাধিক। আমাদের প্রচলিত উপমহাদেশীয় সমাজ ব্যবস্থায় একজন নারীর পরিবারে দু 'বার কান্নার রোল উঠে। একটি হলো কন্যা বা বোন হিসেবে মেয়ের বিয়ের পর বাবা/ভাইয়ের ঘর ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্ত ও অপরটি হলো নারীর মৃত্যুকাল। দীর্ঘ বছর লালন-পালনের পর মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে পিতা-মাতা-কন্যার মধ্যে দীর্ঘ দিনের বিরাজমান একচ্ছত্র ত্রিমুখী ভালোবাসা প্রকৃতির নিষ্ঠুর নিয়ম সূত্রে বিভাজিত হয়ে যায় (নতুন সম্পর্ক স্বামীর প্রতি ভালোবাসা গড়ে তোলার মাধ্যমে)। এটি প্রকৃতি। কন্যার প্রতি বাবা-মায়ের ভালোবাসা এভাবে বিভাজিত হওয়ার নামে মূলত প্রসারিত হচ্ছে এবং এটি মানব জাতির বিকাশের জন্য সৃষ্টিশীল। এভাবে নারী নানা পরিচয়ে বিশেষায়িত হয়ে কারো কন্যা, কারো জায়া, কারো ভগিনী ও কারো জননী হিসেবে যুগে যুগে আবির্ভূত হচ্ছে, বংশ তৈরি করছে, প্রেম-ভালোবাসা বা কখনোবা ঘৃণা সংমিশ্রিত রাগ-অনুরাগ-আবেগের সৃষ্টি করছে ও এর মধ্যেই সভ্যতা বিকাশে ভূমিকা রাখছে। ওয়াহিদ আজাদ ; ১১-০৭-২৩
Make sure you enter the(*)required information