(চুনতী.কম সম্প্রতি Writers Column এ আমার নামে পাতা খুলে আমাকে সম্মানিত করায় আমি খুবই অবাক হলাম। তবে নানাবিধ ব্যস্ততায় আর্টিকেল বা ফোরামে লিখা হয়ে উঠেনি অনেকদিন। আজ অনেকদিন পর আমার হারিয়ে যাওয়া পাসওয়ার্কড পুনরুদ্ধার করেই এই শূণ্য পাতাটাতে একটা লিখা দিতে চাচ্ছি। মাসুদ ভাইয়া, আমার ফুফাতো ভাই, ২০১১ সালের মে মাসের ২৮তারিখে হঠাত করে ইন্তেকাল করেন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে। চুনতীর অনেকেই উনাকে চিনতেন এবং জানতেন খুব ভালো করেই। সেই সময়ে চুনতী.কম এর ফোরামে উনার বিষয়ে লিখা হয়েছিল। উনার স্মরনে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হতে যাচ্ছে শুনে এই লেখাটি লিখেছিলাম। সেই লেখা দিয়েই চুনতী.কম এ অনেকদিন পর কলম ধরলাম।) ভূমিকাঃ প্রতিদিন ভাবি, এক কলম দু’কলম লিখব আমার এই ভাইটিকে নিয়ে, যিনি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে নিজেই জীবন থেকে চুপটি মেরে চলে গেলেন! অনেক কথাই তো লিখার ছিল, কিন্তু কিছুই লিখতে পারিনা। কি লিখব?একটি জীবন কি একটি বইএর দুটি পাতায় ফুটিয়ে তোলা যায়? মাসুদ ভাইয়া আমার আরো অর্ধশতাধিক কাজিন দের মধ্যে একজন, কিন্তু সত্যি বলতে কী, ছিলেন সবার চাইতে আলাদা। উনার মুখের হাসিটি যেমন কখনই ম্লান হতে দেখিনি, তেমনি দেখিনি উনার সাথে দেখা করতে এসে কাউকে ম্লান মুখে ফিরে যেতে। খুব অবাক লাগে, উনি যেখানেই গেছেন, অল্প ক’দিনের জন্য হলেও - সেখানেই চিহ্ন রেখে গেছেন। হয়তো উনার অবস্থান পৃথিবীতে অল্প সময়ের জন্যই ছিল বলে, প্রতিটি মুহূর্ত এভাবে কাজে লাগিয়ে গেছেন! মাসুদ ভাইয়ার সাথে আমার মনে রাখার মতন তেমন কোনো স্মৃতি নেই, আমাদের আর দশটা কাজিন উনার কাছে যেমন ছিলাম তেমনই। কাজিন রা (ছেলে মেয়ে) মিলে আড্ডা দেয়া বা মজা করা আমাদের পরিবারের প্রথার মধ্যে নেই, তাই হয়তো, কিন্তু তাই বলে সবার মধ্যে অপূর্ব আত্নার বন্ধন কখনই ছিন্ন হয়নি। আমরা ভাই বোনরা ছড়িয়ে আছি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, কিন্তু যোগাযোগ রাখি নিত্যই - উন্নত থেকে উন্নততর হতে থাকা প্রযুক্তির মাধ্যমে। ভাইয়ার স্বল্প কিন্তু কর্মবহুল জীবন নিয়ে আমার বলার কিছু নেই – অন্য যাদের লেখায় এই বইয়ের পাতা ভর্তি হবে তারাই বরং ভাল বলতে পারবেন। কিন্তু উনি মৃত্যুর পরেও কি অদ্ভুতভাবে আমার জীবনে প্রভাব রেখে গেছেন এবং এখনও রেখে যাচ্ছেন, তাই নিয়েই আজ লিখব ভাবছি। ১। ২০১১ সালের ২৮শে মে। রাত ১১টা বাজে তখন। মশারি খাটিয়ে আমি বসে আছি আর কম্পিউটারে কিছু টুক টাক কাজ করছি। এমন সময় আম্মুর মোবাইলে কল এলো। অপরিচিত নাম্বার দেখে বুঝলাম বিদেশে অবস্থানরত আম্মুর চার সন্তানের কেউ হবে। রিসিভ করলাম আমি, মেজ ভাইয়ার কন্ঠ শোনা গেলো। তখন উনি ছিলেন ফ্রান্সএ। সেদিন ই উনার চলে যাওয়ার কথা সৌদি আরব। ভাবলাম আম্মুর সাথে যাওয়ার আগে আলাপ সেরে নিচ্ছেন হয়তো। ফোনটা ধরলেই ওপ্রান্ত থেকে খুব স্বাভাবিক গলায় ভাইয়া জানতে চাইলেন আমরা কেমন আছি, কি করছি, ইত্যাদি আর আম্মু আর আব্বুর কথা জানতে চাইলেন। আব্বু তখন অফিসের কাজে চায়না ছিলেন এবং উনার সাথে আমাদের যোগাযোগ হচ্ছিল না ক’দিন থেকে। তারপর ভাইয়া আম্মুর সাথে কথা বলতে চাইলেন। আম্মু ফোনটা নেয়ার একটু পরেই আম্মুর চেহারার দিকে তাকিয়ে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। এমনিতেই অনেক ফর্সা আম্মু একদম ফ্যাকাসে সাদা হয়ে গেছেন! ফোনটা রেখেই আম্মু বললেন, “একটা খারাপ খবর আছে। তোমাদের ফুফাতো ভাই মাসুদ – কয়দিন আগে যে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছে, আজকে নাকি ওর হাউস মেটরা ওর রুমে ওর লাশ পেয়েছে”! বিশ্বাস হলো না। বললাম একটু আগেই তো ফেসবুকে উনার ছবি দেখলাম “In Australia” নামক এল্বামে উনি উনার অস্ট্রেলিয়া জীবনের ছবি দিলেন কিছু- এইটা কি করে সম্ভব! আমি তখনি ফেসবুক খুলে দেখতে লাগলাম ওইদিন সকালে উনার পোস্ট করা ছবিগুলো আর ভাবতে লাগলাম এই মানুষটা – যে কিনা কালই ভাত খাচ্ছিল আর সেই ভাত খাওয়ার ছবি গুলো ফেসবুকে শেয়ার দিল, সে আজকে কিভাবে নাই হয়ে যেতে পারে!! তারপরেই আমরা বাসার আর যারা ছিল তাদের কে জানালাম, অন্যান্য আত্নীয় স্বজনদের জানালাম এবং কিভাবে আমার ফুফু ফুফাকে জানানো যায় এই ব্যাপারে পরিকল্পনা নিতে লাগলাম। আর এর পরের ঘটনা সবারি জানা – পরদিন সকাল হতে হতে এই “অসম্ভব” খবরটা রাষ্ট্র হয়ে গেল! তারপর অনেক আলোচনা, তর্ক, বিতর্ক – কবর কোথায় দেয়া হবে, মৃত্যুটা কোথায়, কিভাবে হয়েছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। সরব হয়ে উঠল দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বন্ধু বান্ধব, আত্নীয় স্বজন আর সেই সাথে ফেসবুক, ব্লগের পাতা। এতো অল্প বয়সী একজন মানুষের মৃত্যুতে এতো বেশি মানুষের সরব হয়ে উঠা খুব কমই দেখা যায়। শুধু নীরব হয়ে গেলেন – চিরদিনের জন্য – সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু, সবার প্রিয় মাসুদ ভাইয়া। ২। ২০১২ সালের মে মাসের ১২ তারিখ। আজ আমার খুব আনন্দের একটি দিন। আমার ফুফু আর ফুফা মেলবোর্নে আসছেন আমার কাছে। বিদেশে এসে আত্নীয় স্বজনের দেখা পাওয়া – এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি। রাতে উনাদের আনতে গেলাম এয়ারপোর্টে। ফিরার সময় আমার ফুফু ছোট্ট করে বললেন, গত বছর এই দিনেই মাসুদ মেলবোর্নে এসেছিল। আর এই বছর ...? তাই তো! এক বছরে কত আমূল পরিবর্তন আমাদের সবার জীবনে! মাসুদ ভাইয়া নিজে জীবন থেকে চুপটি মেরে বিদায় নিলেন, কিন্তু আজীবনের জন্য বদলে দিয়ে গেলেন আরো কতজনের জীবন! আজ আমি সেই মেলবোর্নেই, যেখানে উনি মাত্র দু’সপ্তাহের জন্য এসেছিলেন, কিন্তু চিহ্ন রেখে গেছেন চিরদিনের জন্য। আজ উনার কারনেই আমি এখানে –উনারই ছোটবেলার বন্ধুর সাথে শুরু করেছি নতুন জীবন। আজ উনার কারনেই আমার বাসায় অতিথি হয়ে আসছে উনার মা-বাবা। একটি বছর আগে আর পরে আমাদের অনেকের জীবনেই অনেক পরিবর্তন – শুধু উনার কারনে। আসলেই, খুব অদ্ভুত আল্লাহর হুকুম! পরদিনই ফুফু আর ফুফা কে নিয়ে গেলাম মাসুদ ভাইয়ার কবরে। বলাই বাহুল্য, ফুফু ফুফার জন্য এটা প্রথম যিয়ারত নয়। গেল বছরও উনাদের একবার সুযোগ হয়েছিল মেলবোর্নে এসে ছেলের কবর ঘুরে যাবার। বাবা/মা হয়ে সন্তানের কবর যিয়ারতের অনুভূতি কেমন হয় সেইটা ভাবতে প্রতিবারই আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। খুব অবাক হয়ে দেখলাম চরম ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক আমার ফুফু আর ফুফা কে। আল্লাহ জান্নাতে উনাদের কে উনাদের ছেলের সাথে মিলিত হবার সুযোগ দিন, আমীন। ৩। আমার বাসার খুব কাছেই Springvale Botanical Cemetery। প্রথমবার যখন এখানে আসি, খুব অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। দেশে কখনই কবর যিয়ারত করতে যাওয়া হতো না – মেয়েদের জন্য আমাদের দেশে এটা একটা “নিষিদ্ধ” প্রথা, তাই কবরের দোয়াও শেখা হয়নি। এখন প্রায়ই যাই আর দোয়াটা পড়ি, যার একটি বাক্যের অর্থঃ “নিশ্চয় আমরাও তোমাদের অন্তর্ভূক্ত হবো শীঘ্রি”! যতবারই যাই, সেই একই অনুভূতি বারবার ফিরে আসে – কত অদ্ভূত এই জীবন। সেই সুদূর বাংলাদেশ থেকে এসে মাত্র দু’সপ্তাহ এই দেশে থেকে এই দেশের মাটিতেই চিরস্থায়ী আবাস করে নিলেন মাসুদ ভাইয়া। উনার যেমন এদেশের মাটিতেই কবর লিখা ছিল,আমাদের সবার কবরও পৃথিবীর কোনো এক স্থানে লেখা আছে – আজ হোক কাল হোক, ফিরে যেতে হবে সেই মাটিতেই যা কিনা আমাদের চিরদিনের আবাস। পৃথিবীর ক্ষনিকের ঘর সাজাতে আমরা কত কিছুই না করি, সেই চিরদিনের আবাস সাজাতে আমরা তার কতটুকু করি? পরিশিষ্টঃ ইউনিভার্সিটির কম্পিউটারে লিখাটি লিখতে লিখতে নামাযের সময় হয়ে গেল। এই ইউনির সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে জর্জ বিল্ডিং এর ৩য় তলায় খুব সুন্দর একটি মসজিদ আছে – নামাযের সময় হলে তাই কোনো চিন্তা করতে হয়না। মেয়েদেরও ভালো ব্যবস্থা আছে। মসজিদের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চমকে উঠি। মনে পড়ে যায়, মাসুদ ভাইয়ার সেই শেষ ফেসবুক এলবামের কথা - সেখানে একটি ছবি ছিল এই বিল্ডিং এর – উনি লিখেছিলেন “Swinburne University of Technology The George Building (Masjid in 3rd Floor)”। সেই প্রথম সুইনবার্ন ইউনির ছবি দেখেছিলাম। তারও আগে মাসুদ ভাইয়ার মাধ্যমেই এই ইউনির নাম শুনেছিলাম। সময়ের পরিক্রমায় বহু পথ ঘুরে আজ আমিও এখানেরই ছাত্রী... প্রতিদিন এই ক্যাম্পাসে হাঁটি, এই মসজিদেই নামায পড়ি, বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকাই আর কখনো কখনো নিজের অজান্তেই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিঃ আহ, জীবন!!
Make sure you enter the(*)required information