ভারতের উত্তর প্রদেশে শায়িত রয়েছেন বিশ্বখ্যাত সুফি দরবেশ কঠোর শরীয়ত ভিত্তিক তরিকতের পীর হযরত আলহাজ্ব শাহ মাওলানা হাফেজ হামেদ হাসান আলভী (রহ.) (আজমগড়ী হযরত)। তিনি ১৯০০ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি চট্টগ্রামে শরীয়ত ও তরিকতের স্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। তাঁর মহান পীর ও নিজের পিতার চিশতিয়া তরিকার খলিফা হযরত শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী। যিনি ভারতে পশ্চিমবঙ্গের বান্ডেল শরীফে শায়িত রয়েছেন।হযরত শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী ওয়াইসী হিসেবে ৭ তরিকার মহান ইমামগণ থেকে আধ্যাত্মিকভাবে খেলাফত প্রাপ্ত হলেও তিনি নিজেকে গোপন রাখতেন। তাঁর মাত্র ২৮ জন মুরিদের মধ্যে ১৫ জনের তালিকা পাওয়া যায়। তাঁদের অধিকাংশ উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলার কুহন্ডা নিজের পীর হযরত সুফি আবু আহমদ মিয়া করিম বক্স (রহ.) এর বাড়ীর এলাকায়। যেহেতু তিনি তথায় যাতায়াত করতেন। আজমগড় গমন করলেও নির্দেশ ছিল তিনি মেহমান হিসেবে এসেছেন, তরিকতের শেখ হিসেবে যাতে কেউ না জানে।এই মহান আওলাদে রাসুল আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী মাত্র ৪০ বছর বয়সে ১৯০০ সালের ৬ রমজান বান্ডেলে ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর পীরের একমাত্র পুত্র আজমগড়ী হযরত ও কুহন্ডার অপর বাসিন্দা হযরত শাহ মাওলানা আবদুস সামাদকে খেলাফত দিয়ে যান। এই আওলাদে রাসূল হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুর (রহ.) এর মুজাদ্দেদিয়া তরিকার পীর হচ্ছেন ফুরফুরা সামশুলওলামা হযরত সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী (রহ.)।চট্টগ্রামে আজমগড়ী হযরত বছরে ন্যূনতম একবার প্রায় মাসখানেকের সফরে আসতেন। এতে তিনি চট্টগ্রাম মহানগরীতে হালিশহর হযরত শাহ সুফি হাফেজ মুনির উদ্দিন (রহ.) এর বাড়ী, চন্দনপুরা হযরত শাহ মাওলানা নজির আহমদ (রহ.) এর বরশ বিল্ডিং এবং সাবেক এম.এন.এ ও রাষ্ট্রদূত আতাউর রহমান খান কায়সারের পিতা আলহাজ্ব এয়ার আলী খান এম.এন.এ এর বাসভবনে তশরীফ রাখতেন।আজমগড়ী হযরত চাক্তাই থেকে লম্বা বৃহৎ আকৃতির গদু নৌকা করে সাতকানিয়া ঘাটিয়াডাঙ্গা পৌঁছতেন। তথা হতে ছোট নৌকা করে ডলু খাল দিয়ে গারাংগিয়া হয়ে আধুনগর পৌঁছতেন। আধুনগর নৌঘাট হতে ঘোড়া, পালকি অথবা পায়ে হেঁটে প্রায় ৩/৪ কি.মি দূরত্বে চুনতী হযরত শাহ ছাহেব কেবলার দাদার বাড়ী ইউসুফ মঞ্জিলে পৌঁছতেন। চুনতী এ জমিদার বাড়ীতে আজমগড়ী হযরত বাৎসরিক বেশ কয়েকদিন তাশরীফ রাখতেন। আজমগড়ী হযরত সদরঘাট থেকে কক্সবাজারগামী স্টিমারে করে বাঁশখালী ছনুয়া মনুমিয়াজী বাড়ীতে গমন করতেন। এই বাড়ীর মুহাম্মদ উল্লাহ মিয়াসহ অনেকেই আজমগড়ী হযরতের মুরিদ। আজমগড়ী হযরত অত্যধিক কষ্ট স্বীকার করে সফর করতেন। ১৯৩০/৩১ সালে ট্রেন চালু হলে তিনি ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী গমন করেন। তাঁর সম্মানার্থে ঘোড়া পালকি ট্রেন স্টেশনে এনে তাকে স্বাগত জানানো হত। অত্যধিক লোকের সমাগম দেখে তিনি একবার ঘোড়া পালকি পরিহার করে পায়ে হেঁটে প্রায় ২০/২৫ কি.মি দূরত্বে চুনতী ইউসুফ মঞ্জিলে পৌঁছেন।হালিশহর-চন্দনপুরা, চুনতী-ছনুয়া যেখানে আজমগড়ী হযরত অবস্থান নিতেন সেই সময় কম জনসংখ্যা অধ্যুষিত অবস্থায়ও শত শত লোকের সমাগম হত। তৎমধ্যে আলেমের সংখ্যা কম ছিল না। বৃহত্তর চট্টগ্রামে অনেক জমিদার আজমগড়ী হযরতের মুরিদ। তিনি কঠোর শরীয়তের পাবন্দ ছিলেন। অপব্যয় পছন্দ করতেন না। ধর্মীয় মতপার্থক্য বিষয় নিয়ে কেউ আলাপ করতে চাইলে অস্বস্তিবোধ করে এড়িয়ে যেতেন। তাঁর অন্যতম সিনিয়র খলিফা চুনতী হযরত শাহ মাওলানা ফজলুল হক (রহ.) ১৯৪৪ সালে ইন্তেকাল করেন। সুফি দরবেশ এ মহান পীরের ইন্তেকালে বৃহৎ আকারের ঈছালে ছওয়াব এর আনজাম চলছিল। এই সংবাদ আজমগড়ী হযরতের নিকট পৌঁছলে তিনি আজমগড় থেকে নির্দেশ পাঠান ' ইয়ে সব বন্ধ কর ' অর্থাৎ এসব কিছু বন্ধ কর। তখন চুনতীতে যাবতীয় প্রস্তুতি বন্ধ হয়ে যায়। আজমগড়ী হযরত ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ৪০ বছর ইসলামের খেদমতে কঠোর শরীয়ত ভিত্তিক সহীহ তরিকত প্রচারে ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। ১৯৩৯ সালের পর থেকে দীর্ঘ ১৬ বছর উপমহাদেশ বিভাগ, ২য় বিশ্বযুদ্ধসহ নানান প্রতিকূলতায় আজমগড়ী হযরত এদেশে আগমন করেননি।হালিশহর হাফেজ ছাহেব হুজুরের ইন্তেকালের পর পর এ অঞ্চলে তাঁর পীর ছাহেব হযরত শাহ সৈয়দ আবদুল বারী (রহ.) এর সিলসিলার বৃহত্তর স্বার্থে ১৯৫৫ সালে ভারত থেকে এদেশে আসেন। তখন তিনি অতি বার্ধক্যে উপনীত, শরীর বার্ধক্যের চাপ। এমনি অবস্থায় তিনি ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম আসেন। সাথে ছিলেন তাঁর অন্যতম খলিফা আজমগড়ের বাসিন্দা হযরত মাওলানা সাঈদ খান (রহ.)। চট্টগ্রাম ট্রেন স্টেশন থেকে কার যোগে হালিশহর হাফেজ ছাহেব হুজুর (রহ.) এর বাড়ীতে তাশরীফ রাখেন। হালিশহরে হাজারের মত লোকজন নিয়মিত থাকত। এতে আজমগড়ী হযরত বিরক্তি প্রকাশ করতেন। তিনি বলতেন তাসাউফ, সুফিবাদ, তরিকত নীরবে চুপি চুপি। এখানে এত সমাগম কেন। হালিশহর থেকে আজমগড়ী হযরত লঞ্চে কাপ্তাই গমন করেন। ১ রাত অবস্থান করেন। উর্দু ভাষী কাপ্তাই বাঁধের ঠিকাদার বাঁধ টিকাতে পারছিলেন না। আজমগড়ী হযরতের খবর পেয়ে দোয়া প্রার্থী হন। আজমগড়ী হযরত বাঁধ এলাকায় গমন করেন এবং তথায় হাঁটেন। কাপ্তাই থেকে পর দিন লঞ্চে চাক্তাই এসে চন্দনপুরা জমিদার আলহাজ্ব এয়ার আলী খান এর বাস ভবনে অবস্থান করেন। এখানে অবস্থান কালেও মানুষের উপস্থিতিতে লোকারণ্য হয়ে যায়। এ জমিদার বাড়ীতে অবস্থানকালে গারাংগিয়া হযরত ছোট হুজুর (রহ.)সহ আরও কয়েকজনকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন। অতঃপর চট্টগ্রাম থেকে বিমান যোগে ঢাকা গমন করেন। ঢাকা থেকে আজমগড় রওনা হন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে স্ত্রীও ইন্তেকাল হওয়ায় শারীরিক সেবা শ্রশুষার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এতে প্রায় ১৫০ কি.মি দূরত্বে উত্তর প্রদেশের বিভাগীয় শহর গুন্ডা থেকে মেয়ে ও মেয়ের জামাতা আজমগড়ের কুহন্ডা বাড়ীতে এসে গুন্ডা নিয়ে যান আজমগড়ী হযরতকে। তথায় বছর খানেকের ব্যবধানে ১৯৫৯ সালে ২০ সেপ্টেম্বর তথা ১৩৬৬ বাংলা ৩ আশ্বিন ১৩৭৯ হিজরি ১৭ রবিউল আউয়াল ইন্তেকাল করেন। আজমগড়ী হযরত গুন্ডায় সাদামাটা কবরে শায়িত। যা বিভাগীয় শহর গুন্ডা ট্রেন স্টেশন থেকে ৩/৪ কি.মি দূরত্বে জিগর মেমোরিয়াল কলেজের নিকট। অপরদিকে আজমগড়ী হযরতের জন্মস্থান আজমগড় জেলার কুহন্ডায় বাড়ীর নিকটে স্ত্রী আব্বা আম্মাসহ আত্মীয়স্বজন এবং পিতার পীর হযরত শেখ নেজাবত আলীসহ সকলে শায়িত। যা শাহগঞ্জ ট্রেন স্টেশন থেকে সড়কপথে ১২/১৩ কি.মি দূরত্বে। আজমগড়ী হযরত ইন্তেকালের আগে লাখ লাখ মুরিদ থেকে বাছাই করে ৪৪ জন সুফি দরবেশকে খেলাফত দানে ভূষিত করেন।তৎমধ্যে ১৬ জন মহান খলিফা রয়েছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে। যারা হলেন গারাংগিয়া হযরত বড় হুজুর, হযরত ছোট হুজুর, আরাকানী হযরত, চুনতী হযরত মাওলানা ফজলুল হক , হযরত মাওলানা নজির আহমদ, মাওলানা হাকিম মুনির আহমদ, হালিশহরের হাফেজ ছাহেব হুজুর, বোয়ালখালী শাকপুরা মাওলানা আবদুল জব্বার, বাঁশখালী ছনুয়া মাওলানা খলিলুর রহমান, সাতকানিয়া করিয়ানগর মাওলানা ইকামুদ্দীন ও মাওলানা ফজলুল রহমান, আনোয়ারা জুঁইদন্ডী মাওলানা শরফুদ্দীন , সাতকানিয়া পুঁটিবিলা মাওলানা হাফেজ অজিহুল্লাহ, কুতুবদিয়া বরঘোপ মাওলানা জামাল উদ্দিন, সাতকানিয়া রামপুর আবদুল মাবুদ ছাহেব ও দোহাজারী মাওলানা আবদুল হাকিম (রহ.)। সাথে সাথে চুনতী হযরত শাহ ছাহেব কেবলা ও কুতুবদিয়া হযরত আবদুল মালেক ছাহেব কেবলা আজমগড়ী হযরতের নূরে নজর ফানাফিল্লাহ ও ফানাফির রাসূল।আজমগড়ী হযরত থেকে এজাজত প্রাপ্ত মহান ১৬ জন অলি দরবেশ পীর দেশে বিদেশে ইসলামের বিশাল খেদমত করে গেছেন। তাঁরা কেউ বেঁচে নেই। তাদের অনুমতি প্রাপ্ত খলিফাগণের মধ্যেও অধিকাংশ ইন্তেকাল করে গেছেন।বান্ডেল হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের এ সিলসিলা তাঁর পীরের সন্তান এ খলিফা আজমগড়ী হযরতের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ব্যাপক ত্যাগ খেদসতের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পাশাপাশি বিশাল ভারতবর্ষে ব্যাপকতা লাভ করে। তৎমধ্যে চট্টগ্রাম অঞ্চল অন্যতম। হযরত সৈয়দ ছাহেব হুজুরের এ আজমগড়ী সিলসিলা কঠোর শরীয়ত ভিত্তিক তরিকত। এখানে ৫ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পাশাপাশি প্রতিদিন ফজর, মাগরিব, এশার নামাজের পরপর কুরআন শরীফের সূরা আয়াত এবং দরূদ শরীফের আমল পালন করা বাধ্যতামূলক। অর্থাৎ প্রতিদিন কুরআন শরীফের সূরা আয়াত পড়ার পাশাপাশি হাজারের কম বেশি বার দরূদ শরীফ পড়া বাধ্যতামূলক।এ সিলসিলাকে যে কোন আকিদা মতাবলম্বী সম্মান সমীহ করে থাকেন কঠোর শরীয়ত ভিত্তিক তরিকত বিধায়। ক্যাপশন:ভারতে উত্তর প্রদেশের গুন্ডায় শায়িত রয়েছেন আজমগড়ী হযরত।
Make sure you enter the(*)required information